| মুসবিহা বিনতে ওয়ালী |

ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, অণু, পরমাণু এগুলো হলো এমন কয়েকটি শব্দ যেগুলো আমরা পড়াশুনার সময় একই সাথে শুনে থাকি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যপার হলো, আস্তে আস্তে আমরা যতোই উপরের ক্লাসে উঠতে থাকব, ইলেকট্রন বাদে বাকি টার্মগুলো ততোই ভ্যানিশ হতে থাকবে। একসময় এমন মনে হবে এই দুনিয়ার তাবৎ অণু পরমাণুর কোন ভ্যালুই নেই, ইলেক্ট্রনই সব। বিশেষ করে তড়িৎ বা ইলেকট্রিক্যাল বিষয়ে পড়তে গেলে এই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি হয়। অথচ ইলেকট্রন হলো খুবই হালকা (পৃথিবীর সবচেয়ে হালকা পরমাণুটির ওজনের ১৮৩৭ ভাগের ১ ভাগ ওজন হলো একটি ইলেক্ট্রনের)। এটা এতই হালকা যে এটা আসলে আদৌ কোন পদার্থ নাকি এক ধরণের রশ্মি বা শক্তিকণা এ ব্যপারে এখনো মতভেদ চলছে। তবুও কেন এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাটিকে নিয়েই এত মাতামাতি, এত এত পড়াশোনা?

আসলে ইলেকট্রনের ধর্মের উপর নির্ভর করেই একটি পদার্থের যত ব্যবহারিক প্রয়োগ। কোন বস্তুর ইলেকট্রন চলাচল, শোষণ, নির্গমণ ইত্যাদি বিভিন্ন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনাবলিকে আমরা যত বেশি কন্ট্রোল করতে পারবো সেই বস্তুর ব্যবহার্যতা আমাদের কাছে ততো বেশি। আমরা জানি ইলেকট্রনকে e দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং একে একটি ঋণাত্মক সত্তা হিসেবে ধরা হয়। এ কথাটির অর্থ হলো, যেখানে ইলেকট্রনের পরিমাণ যত কম সেখানে পজিটিভ বা ধনাত্মক ভোল্টেজ তত বেশি। আবার ইলেকট্রনগুলো চায় সব জায়গায় সমানভাবে বিরাজমান থাকতে। একবার সমভাবে বন্টিত হয়ে গেলে সেই ইলেকট্রনকে আর নড়ানো চড়ানো কঠিন। তাই আমরা প্রয়োগ করি এই ভোল্টেজ, যার মূল উদ্দেশ্য হলো ইলেকট্রনের গতিবিধিকে আমাদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করা। ভোল্টেজ হলো এক প্রকার শক্তি যেটা দিয়ে আমরা ইচ্ছা করলে কোন বিন্দু থেকে সমস্ত ইলেকট্রনকে তাড়িয়ে দিতে পারি, আবার কোন বিন্দুতে প্রচুর ইলেকট্রনকে এনে জড়ো করতে পারি। এ থেকে বুঝা গেল ভোল্টেজ দুই প্রকার। পজেটিভ ভোল্টেজ (ইলেকট্রনকে আকর্ষণকারী), এবং নেগেটিভ ভোল্টেজ (ইলেকট্রনকে বিকর্ষণকারী)। ভোল্টেজ বাড়ানো বলতে একই সাথে পজেটিভ ভোল্টেজকে বাড়ানো বুঝায় বা নেগেটিভ ভোল্টেজকে কমানো বুঝায়।

এখন প্রশ্ন হতে পারে কী হবে এই ইলেকট্রনের চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করে? উত্তর হলো, আমাদের যত লাইট, ফ্যান, টিভি, কম্পিউটার আর ইলেকট্রনিক সামগ্রী আছে সবকিছু চলছে এই ইলেক্ট্রনের নিয়ন্ত্রিত আসা যাওয়ার মাধ্যমেই। আমরা যখন লাইটের সুইচ অন করি সেই লাইটের দুই পাশের পজেটিভ (+) আর নেগেটিভ (-) ভোল্টেজ প্রান্ত কাজ করা শুরু করে। ‘+’ প্রান্ত শুরু করে ইলেক্ট্রনগুলোকে আকৃষ্ট করা। ‘-’ প্রান্ত থেকে ইলেকট্রনগুলো তখন দৌড়ে ‘+’ এর দিকে আসতে শুরু করে, পথিমধ্যে তারা আমাদের বালবের সার্কিটটা পার হয়ে আসে। যতক্ষণ বাল্ব এর সার্কিট এর মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন চলাচল করতে থাকে ততক্ষণই বাল্ব তার কাজ করতে থাকে অর্থাৎ আমাদেরকে আলো দিতে থাকে। যখন কারেন্ট চলে যায় অথবা আমরা আমাদের সুইচ বন্ধ করে দেই তখন বাল্বের সার্কিটটা আমাদের ভোল্টেজ সোর্স থেকে ডিসকানেক্ট হয়ে যায় অর্থাৎ বাল্ব এখন ইলেকট্রন চলাচলের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন। এই উদাহরণ থেকে আরো যে বিষয়টা বুঝা যায় তা হলো ভুরি ভুরি ইলেকট্রন থাকলেই শুধু হবে না, তাদেরকে চলাচল করাতে হবে, অর্থাৎ সদাসর্বদা দৌড়ের উপর রাখতে হবে। স্থির ইলেকট্রন দিয়ে আমাদের কোন কাজ নেই।

unnamed

Negative charges' (electrons') flow

এতদূর জানার পর যে জিনিসটা আমাদের মাথায় আসতে পারে তা হলো, আমরা তো বুঝেই গেলাম ইলেকট্রনকে কীভাবে কন্ট্রোল করতে হবে। ‘+’ আর ‘–‘ ভোল্টেজ দিয়ে। এরপরেও কীসের এত পড়াশোনা? এর উত্তর হলো, ইলেকট্রনের নিয়ন্ত্রকশক্তি এই ভোল্টেজের ধর্ম। যখন অনেক বড় বড় সিস্টেমে ভোল্টেজ সাপ্লাই করা হয় যেমন- বাসাবাড়ি বা কলকারখানা তখন যে ভোল্টেজ দিয়ে আমরা কাজ চালাই সেই ভোল্টেজ এর উৎস থাকে প্রচন্ড বেগে ঘূর্ণায়মান। ফলে এই ভোল্টেজের ‘+’ আর ‘-’ সেকেন্ডে ৫০ বার দিক পরিবর্তন করে। অর্থাৎ ইলেকট্রনগুলো একবার বাম থেকে ডানে দৌড়ায় ঠিক পরক্ষণেই আবার ডান থেকে বামে দৌড়ায়। এভাবে এক সেকেন্ডে ৫০ বার দিক পরিবর্তন করে। এধরণের ইলেকট্রন প্রবাহকে বলে দিক পরিবর্তি তড়িৎ বা Alternating Current(AC)।

ইলেকট্রনের আরো কিছু চমকপ্রদ উপযোগিতার মধ্যে আছে রোধ (Resistor), ক্যাপাসিটর (Capacitor), ইন্ডাক্টর (Inductor)। এই তিনটা জিনিস ইলেকট্রন চলাচলের পথে উপস্থিত থেকে ইলেকট্রনের গতিরোধ করে বা ইলেকট্রনের গতিপথকে প্রলম্বিত করে তাদের গতিবেগ কমিয়ে দেয়। আমরা যেসব ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী ব্যবহার করি তারা সবাই হলো এই তিনটি উপাদানের সমার্থক। ইলেকট্রন তার চলাচলের পথে যখনই কোন ইলেকট্রনিক সামগ্রীর সার্কিট দেখে তখনই তারা ডিসটার্ব ফিল করে কারণ এতে তাদের গতিপথ দীর্ঘ হয় বা স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়।

রেজিস্টরের ক্ষেত্রে এর ভ্যালু যত বেশি তাকে চালু রাখতে তত বেশি পার্থক্যসম্পন্ন ভোল্টেজ সোর্স এর সাথে কানেক্ট করতে হয় অর্থাৎ তার মধ্য দিয়ে তত বেশি ইলেকট্রন প্রবাহিত হলে তবেই সেই রোধটা কাজ করবে। আর ক্যপাসিটর হলো ইলেক্ট্রনের একরকম স্টোররুম। সে ইলেক্ট্রনগুলোর অনুমতি না নিয়েই তাদেরকে স্টোর করতে শুরু করে। এর উপকারিতা হলো, হুট করে আমাদের ভোল্টেজ কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কিছু কিছু ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই এদেরকে মেইন সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন করার সময় এদের সাথে সংযুক্ত ক্যপাসিটরটা সেভিয়র (Savior) হিসেবে ভূমিকা পালন করে। আমরা সুইচ অফ করার পর ক্যাপাসিটর অল্প অল্প করে ডিসচার্জ হতে থাকে বা তার মধ্যে এতক্ষণের পুঞ্জীকৃত ইলেকট্রনগুলোকে একে একে ছাড়তে থাকে, তখন ইলেকট্রনিক সামগ্রীও মনে করে আস্তে আস্তে ভোল্টেজ কমে আসছে, তখন সে নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকে এবং একসময় অফ হয়ে যায়। এর অর্থ হলো ক্যপাসিটর সংযুক্তীকরণের মাধ্যমে আমরা কোন সার্কিট বা বর্তনীর কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্য দিয়ে হুটহাট ভোল্টেজ পরিবর্তনকে প্রতিরোধ করতে পারি। একইভাবে ইন্ডাক্টর সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে আমরা বর্তনীর কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্য দিয়ে হুটহাট কারেন্টের পরিবর্তনকে প্রতিরোধ করতে পারি।

মোটামুটিভাবে এটুকুই হলো একেবারে প্রাইমারি লেভেলের তড়িৎ বিষয়ক ধারণা। এখন এ ব্যপারগুলোকে প্রয়োগ করতে গেলে কতগুলো টার্ম এবং এদের সংজ্ঞা, গাণিতিক প্রকাশ আমাদেরকে শিখতে হবে। এগুলো হলো কারেন্ট, ভোল্টেজ, চার্জ, তড়িৎ ক্ষেত্র, রোধ, ক্যপাসিটর, ক্যপাসিটেন্স, ইন্ডাক্টর, ইন্ডাকটেন্স, সিরিজ সংযোগ, প্যারালাল সংযোগ ইত্যাদি।

পড়াশোনার আরো হায়ার লেভেলে ইলেক্ট্রনের কেবল চলাচলই না, ইলেক্ট্রনের লম্ফ-ঝম্ফকেও কন্ট্রোল করে আমরা কীভাবে আরো অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত এপ্লিকেশন অর্জন করা যায় সেগুলো জানতে পারবো। যেমন ছোট একটা উদাহরণ হতে পারে ফোটন (Photon)। ফোটনকে আমরা সাধারণত আলোককণা বা আলোর প্যকেজ হিসেবে চিনি। ইলেক্ট্রনের শোষণ –বিকিরণের মাধ্যমে কীভাবে এই ফোটন উৎপন্ন করা হয় তা আরেকটি ইন্টারেস্টিং চ্যাপ্টার।