| তাসনীম আহমেদ |

আপনি একটু চোখ বন্ধ করে চিন্তা করুন তো- আপনার বাড়ির বেলকুনি থেকে সমুদ্র দেখা যায়! শুধু দেখাই যায় না, কয়েক কদম ফেললেই সমুদ্রের পানি ছোঁয়াও যায়! সাগরের নোনা বাতাস সারাক্ষন আপনার জানালায় খেলা করে! বাসার ছাদ থেকে ছিপ-বড়শি ফেলে সমুদ্রের মাছ ধরতে কেমন লাগবে? শুধু তাই নয়, বাসার সামনের ঝকঝকে রাস্তার অপর পারের বাড়ির পেছনেও সমুদ্র! আমরা কত কস্ট করে কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাই সমুদ্র দেখার জন্য। কিন্তু যদি বাড়ির সামনে পেছনে সমুদ্র রেখে প্রতিরাতে ঘুমাতে যান তাহলে কেমন মজা হবে বলুনতো? কি অসম্ভব মনে হচ্ছে তাই না?? নিচের ছবিটি দেখুন।

ছবিটা কাল্পনিক নয় বাস্তব, একটু পরেই জানতে পারবে

ছবিটা কাল্পনিক নয় বাস্তব, একটু পরেই জানতে পারবে

এবার আসুন একটু অন্য দিক থেকে চিন্তা করি। আমাদের দেশের বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কত? বাংলাদেশে যদি এভাবে জনসংখায় বৃদ্ধি পায় তাহলে আগামী বিশ বছর পর জনসংখ্যা কত হবে? বর্ধিত এই জনসংখ্যার থাকার জন্য বাড়ি লাগবেনা? অবশ্যই লাগবে, আর বাড়ি বানানোর জন্য লাগবে অনেক জায়গা । এতে করে কৃষি জমির পরিমান অনেক কমে যাবে। ফলে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিবে এবং সমগ্র বাস্তুসংস্থানে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
এ সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্য বিজ্ঞানীরা দুইটা পরামর্শ দিয়েছে। একটি হল-আকাশে বাড়ি বানানো (মানে বহুতল ভবন নির্মান) আর অপরটি হল সমুদ্রে বাড়ি নির্মান! কি আজব মনে হচ্ছে তাই না? সমুদ্রে আবার বাড়ি বানাবে কীভাবে? আসলে প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব। উপরের অবাস্তব সমুদ্র স্বপ্ন আর তারপরের সমুদ্র বাড়ির সমস্যা কেবল প্রযুক্তির মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।
সমুদ্রে বাড়ি বানানোর এই আইডিয়া মুলত সেই সমস্ত দেশের জন্য প্রযোজ্য যাদের সমতল ভুমি কম এবং সমুদ্রের সাথে সরাসরি সংযোগ আছে বা সীমানা জুড়ে সমুদ্র আছে। মধ্য এশিয়ার সংযুক্ত আরব আমিরাত এরকম একটি দেশ যার বিশাল বিস্তীর্ন সীমানা জুড়ে সমুদ্র। আর দুবাই হল সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমনকি পৃথিবীর অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক শহর। দুবাইকে বলা হয় পৃথিবীর দ্বিতীয় ব্যায়বহুল শহর (Expensive city)। এই দুবাইতেই মানুষ নির্মিত পৃথিবীর সব থেকে উঁচু ভবন ‘বুর্জ খলিফা’ অবস্থিত যার উচ্চতা (২৭২২ফিট) বাংলাদেশের সব থেকে উঁচু ভবন ‘সিটি সেন্টার’ এর উচ্চতার (৫৬১ফিট) প্রায় পাঁচগুণ। এছাড়া দুবাইতে রয়েছে ‘বুর্জ আরব’ নামে সব থেকে বড় ও সব থেকে অভিজাত হোটেল যা সমুদ্রের পানির মধ্যে অবস্থিত, ‘দ্য ভিঞ্চি টাওয়ার’ নামে পৃথিবীর সব থেকে বড় ডাইন্যামিক বা রোটেটিং টাওয়ার (যার প্রত্যেক তলা একই সময়ে আলাদা আলাদাভাবে ঘুরতে পারে), ‘দুবাই মিরাকল গার্ডেন’ নামে পৃথিবীর সব থেকে বড় ফুলের বাগান। যাই হোক দুবাইয়ে যা আছে তা নিয়ে আলাদা একটা আর্টিকেল লেখা যাবে। যে জন্য দুবাইয়ের অবতারণা তা হল- সমুদ্র বাড়ি।
ভৌগলিক অবস্থানের কারনে পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরে চলমান সকল জাহাজই দুবাইয়ে নোঙর ফেলে। এছাড়াও সোনা, তেল, ট্যুরিজম এবং বানিজ্যিক গুরুত্বের কারনে দুবাইয়ের লোকসংখ্যা এবং বাড়িঘর ক্রমশ বাড়তে থাকে। মরুভূমি আর সমুদ্র বেষ্টিত দুবাইয়ের যায়গা ক্রমেই সংকীর্ন হয়ে আসছিল। এতে চিন্তিত হয়ে পড়েন তৎকালীন দুবাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স এবং বর্তমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ বিন রশীদ আল মাখতুম। তিনি পরিকল্পনা করলেন সমুদ্রের মধ্যে বাড়ি বানাবেন। এতে একদিকে যায়গা সমস্যারও সমাধান হবে আবার সমুদ্রের প্রতি মানুষের আকর্ষনের কারনে পর্যটন শিল্পের এক বিশাল সম্ভাবনা দেখলেন ক্রাউন প্রিন্স। কিন্তু অথৈ সমুদ্রের মধ্যে তো আর একটা দুটো বাড়ি বানানো সম্ভব নয় তাই তিনি পুরো একটা শহরই বানানোর চিন্তা করলেন। সমুদ্রের মধ্যে শহর!মাথা খারাপ! এটা কিভাবে সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরির চিন্তা করলেন তিনি। পৃথিবীর প্রথম মানুষ তৈরী দ্বীপ তৈরী করার চিন্তা করলেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন রশীদ আল মাখতুম। তার এই কল্পনার দ্বীপেরই নাম হল ‘পাম দ্বীপ(Palm Island)’ যা পৃথিবীর সব থেকে অদ্ভুত এবং প্রায় অসম্ভব রকমের একটা মেগাস্ট্রাকচার। শুরুতে একটি দ্বীপ বানানোর পরিকল্পনা থাকলেও বর্তমানে দুটি দ্বীপ দ্বারা মুলত পাম আইল্যান্ড বুঝায়। ‘পাম জুমেইরাহ(Palm Jumeirah)’ এবং ‘পাম জেবেল আলি(Palm Jebel Ali)’। আমরা মুলত প্রথমটি অর্থাৎ পাম জুমেইরাহ নিয়েই আলোচনা করব।
দ্বীপটির নাম ‘পাম দ্বীপ’ হবার কারন আছে। দুবাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স এই দ্বীপ তৈরীর দায়ীত্ব দেন ‘নাখিল (Nakheel)’ কোম্পানীকে। নাখিল কোম্পানীর চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম প্রথমে একটি বৃত্তাকার দ্বীপের চিন্তা করলেন কিন্তু এতে সমুদ্রে উন্মুক্ত পৃষ্ঠের পরিধি (exposed surface perimeter) অনেক কম হয়ে যায় অর্থাৎ দ্বীপের অনেক কম মানুষ উন্মুক্ত সমুদ্র উপভোগ করতে পারবে। এরপর সুলতান অনেক চিন্তা করে একটি অদ্ভুত সুন্দর পাম গাছ সদৃশ দ্বীপের নকশা করলেন যেটি একটি বৃত্তাকার রেখা দিয়ে ঘেরা থাকবে। এতে অনেকগুলো সুবিধার পাশাপাশি exposure perimeter প্রায় দশগুন হয়ে যায়। এই পাম গাছের মত আকৃতি বলেই একে ‘পাম আইল্যান্ড’ বলা হয়।

পাম গাছ আকৃতির পাম আইল্যান্ড

পাম গাছ আকৃতির পাম আইল্যান্ড

শুধুমাত্র প্রাকৃতিক উপাদানে (বালু এবং পাথর) নির্মিত পাম আইল্যান্ড পৃথিবীর প্রথম মানুষ নির্মিত স্ট্রাকচার যা মহাশূন্য থেকে দেখা যায়।এই বিশাল দ্বীপ তৈরীর কাজ শুরু হয় ২০০১ সালের জুন মাসে এবং এটি ২০০৬ সালের মধ্যেই সম্পুর্ন শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু অপুর্ব সুন্দর এই দ্বিপটি তৈরীর কাজ অতটা সহজ ছিলনা। কাজ শুরুর অল্প কিছুদিন পরেই সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে বিতর্কিত সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে প্রায় পর্যটক শূন্য হয়ে যায় দুবাই এবং হুমকির মুখে পড়ে দুবাইয়ের পর্যটন শিল্প। সবাই মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে চলে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় পাম দ্বীপ নির্মানের কাজ। কিন্তু দমে যাননি ক্রাউন প্রিন্স। প্রচণ্ড মানসিক শক্তি আর দুরদর্শীতার অধিকারী ক্রাউন প্রিন্স পরিস্থিতি যাই হোক না কেন পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তার এই সাহসী পদক্ষেপের কারনেই স্বপ্ন ভঙ্গের হাত থেকে বেঁচে যায় পাম আইল্যান্ড।
পাম আইল্যান্ড তৈরীর সব থেকে কঠিন অংশ হল বৃত্তাকার বাউন্ডারী তৈরী করা যেটা ঢেউ এর আঘাত থেকে ভেতরের মুল অংশকে রক্ষা করবে। বাইরের এই সীমানা প্রাচীর মুলত তিন স্তরে তৈরী করা হয়। সবার নিচে বালি, তার উপরের ছোট আকারের পাথর এবং সবার উপরে বড় বড় পাথর। এখানে যে বড় পাথরগুলো ব্যবহার করা হয় তার একেকটার ওজন প্রায় ৬ টন করে। দ্বীপটি তৈরি করতে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন ঘনমিটার পাথর লেগেছে যা আমিরাতের বিভিন্ন পাহাড় থেকে বিস্ফোরন ঘটিয়ে সংগ্রহ করা হয়। দ্বীপটির ভেতরের মুল অংশ এবং বৃত্তাকার সীমানা প্রাচীরের উপরের অংশ বালী দিয়ে তৈরী। সমুদ্রের মধ্যে বালি স্প্রে করে পৃষ্ঠ তৈরীর প্রক্রিয়াকে ‘রেইনবোয়িং (Rainbowing)’ বলে। রেইনবোয়িং করে সমুদ্রে একটা দ্বীপ তৈরী করা খুবই কস্টসাধ্য একটা ব্যাপার। কারন প্রত্যেক মুহুর্তেই ঢেউ এসে তা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। পাম দ্বীপ তৈরি করতে মোট পঁচানব্বই মিলিয়ন ঘনমিটার বালি লেগেছে যা দিয়ে পুরো ম্যানহাটন সিটি এক মিটার ঢেকে দেয়া সম্ভব।

রেইনবোয়িং

রেইনবোয়িং

দুবাই বিস্তীর্ন মরুভূমি থাকায় সেখানে বালির কোন অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হল মরুভূমির বালি অনেক চিকন তাই এই বালি দিয়ে সাগর ভরাট সম্ভব নয়। কারন এই বালি পানিতে স্থায়ী হবার পুর্বেই তা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। প্রকৌশলীরা অনেক অনুসন্ধান করে গালফ উপসাগরের এক অংশ থেকে মোটা দানার বালির সন্ধান পান। ফলে সেখান থেকে বালি ড্রেজিং করে এনে পাম আইল্যান্ড তৈরি করা হয়।
দ্বীপ তৈরীর প্রত্যেক ধাপেই ছিল নানা প্রতিকুলতা আর চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রের ডেউয়ের ভেতরে নকশা অনুযায়ী সঠিক জায়গামত দ্বীপের ফাউন্ডেশন তৈরী করা অনেক কঠিন ছিল। এর জন্য ব্যবহার করা হয় GPS আর স্যাটেলাইট প্রযুক্তি। সার্বক্ষনিক ডুবুরী আর GPS প্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে পানির নিচের লে-আউট ঠিকমত আছে কিনা। (চলবে …)