| তাসনীম আহমেদ |

(গত সংখ্যার পর)

২০০৩ সালের আগস্ট মাসে বৃত্তাকার প্রাচীর তৈরির কাজ শেষ হয়। কিন্তু দেখা গেল এর ভেতরের পানির কাক্সিক্ষত গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত ফ্রেশ পানি ভেতরে চলাচল না করায় পানি ক্রমশ প্রাকৃতিক গুণ হারাচ্ছিল যা এখানকার সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। যেখানে মানুষ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে পরিবেশ রক্ষার জন্য সেখানে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ বিপর্যয় মেনে নেয়া যায় না।

বিষয়টা আবার চিন্তিত করে পরিকল্পনাবিদদের। কিন্তু খুব সহজেই এর সমাধান বের হয়ে আসে। সেটা হলো- বৃত্তাকার বাউন্ডারির দুই পাশে চার স্প্যানের দুটি সেতু তৈরি করা। ফলে এই দুই সেতু দিয়ে পর্যাপ্ত ফ্রেশ ওয়াটার দ্বীপের ভেতরে যাতায়াত করতে পারবে এবং পানির কাক্সিক্ষত গুণ বজায় রাখতে পারবে। এতে দেখা গেলো পানির গুণাগুণ বজায় থাকার পাশাপাশি এটাকে সামুদ্রিক মাছেরা অভয়ারণ্য হিসেবে গন্য করে বিপুল পরিমাণে বাস করতে শুরু করেছে। দুবাই কর্তৃপক্ষ এটাকে বিশ্বের সর্ব বৃহৎ কোরাল প্রাচীর (পড়ৎধষ ৎববভ) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবং ভবিষ্যতে এখানে আন্ডার ওয়াটার পার্ক বানানোর চিন্তা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।

ব্রিজ তৈরির আগে

ব্রিজ তৈরির আগে

পাম দ্বীপের কাজ ভালোই চলছিল। ইতোমধ্যে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে ইরানের বাম শহরটি প্রায় ধুলিসাৎ হয়ে যায়। দুবাই ইরানের কাছাকাছি অবস্থিত তাই ভূমিকম্পের ঝুঁকি পাম দ্বীপের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। এছাড়াও বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মারাত্মক এক ভূমিকম্পে জাপানের একটি দ্বীপ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। বিষয়টা হল কম্পনের ফলে বালির মধ্যকার ফাঁকা স্থানের পানি বের হয়ে যায় আর ঐ স্থান নতুন বালি দিয়ে ভরে যায় ফলে বালি দেবে যায়। এ ঘটনাকে “লিকুইফ্যাকশন (liquifaction)” বলে।

ব্রিজ তৈরির পরে

ব্রিজ তৈরির পরে

বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। তাহলে এত সাধের দ্বীপ কি একটু ভূমিকম্প হলেই পানিতে তলিয়ে যাবে? যদিও দুবাই প্রবল ভূমিকম্প এলাকার মধ্যে পড়ে না তারপরও প্রকৌশলীরা এই সমস্যার সমাধান বের করেছেন। তারা আগে থেকেই বালিকে যথাসম্ভব কমপ্যাক্ট করেছেন যাতে বালি দেবে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকে। কম্পনের মাধ্যমে পানি বর্ষণ করে এভাবে কমপ্যাক্ট করাকে বলে ভাইব্রো কম্প্যাকশন (vibrocompaction)।

দ্বীপের কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়। সেটা হল, বালির অস্থিতিশীল প্রকৃতি অর্থাৎ ঢেউয়ের তোড়ে বালির ভেসে যাবার প্রবণতা। সাধারণত সমুদ্রে যেটা হয় যে দ্বীপের এক পাশ ভেঙে অন্য জায়গায় গিয়ে তা আবার জমা হয়। যেমন বলা হয়- “নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে, এইতো নদীর খেলা”। বালির এই চরিত্র পাম দ্বীপের সৌন্দর্য বা অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

তাই প্রকৌশলীরা তীর রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যাবস্থার পাশাপাশা সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা রেখেছেন যাতে কোন এক অংশ ভেসে গেলে তৎক্ষুাৎ যেখানে ঐ বালি জমা হবে সেখান থেকে তা নিয়ে ভেঙে যাওয়া অংশ পূরণ করা যায়।

ভাইব্রো কম্প্যাকশন

ভাইব্রো কম্প্যাকশন

দুবাইয়ের কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ

দুবাইয়ের কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ

এতসব কিছুর পরেও ক্রাউন প্রিন্স কি কথা রাখতে পেরেছিলেন? হ্যাঁ পেরেছিলেন। ২০০৬ সালের মধ্যেই দ্বীপের মূল ফাউন্ডেশন ও প্রাথমিক কিছু আবাসিক বাড়িঘর হস্তান্তর করতে পেরেছিলেন। ২০০৭ সালের মধ্যেই এর প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়। আবসিক বাড়িঘর, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, রাস্তাঘাট, মনোরেল ইত্যাদি সহ দ্বীপের সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয় নভেম্বর ২০১৪ সালে। এবং প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র তিনদিনেই সকল আবাসিক ভবন বিক্রি হয়ে যায়। পৃথিবীর অনেক জনপ্রিয় সেলিব্রিটিরই একটি করে কটেজ পাওয়া যাবে পাম আইল্যান্ডে।

প্রখর বুদ্ধিমান ক্রাউন প্রিন্স শুধু পাম দ্বীপের কাজ শুরু করেই বসে থাকেননি। কাজ শুরুর এক বছরের মাথায় তিনি প্রথমটির প্রায় দ্বিগুণ সাইজের ‘পাম জেবেল আলি’র কাজ শুরু করেন। এরপর প্রায় তিনগুণ সাইজের ‘পাম ডেইরা’র কাজ শুরু করেন। এবং সর্বশেষ ৩০০টি আলাদা আলাদা দ্বীপের সমন্বয়ে তীর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার সমুদ্রের ভেতরে পৃথিবীর আদলে একটি দ্বীপপুঞ্জের কাজ শুরু করেন। এই ‘পৃথিবী’ দ্বীপে পৃথিবীর সকল দেশের ও বড় বড় শহরের নামেই একটি করে দ্বীপ থাকবে যেটাকে অনেক ওপর থেকে দেখলে পৃথিবীর মানচিত্রের মত মনে হবে। ক্রাউন প্রিন্স প্রথমে পাম আইল্যান্ডকে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থাপন করলেন এবং এরপর পুরো পৃথিবীকেই দুবাইয়ের মধ্যে স্থাপন করেছেন, আমরা কি পারি না পৃথিবীকে আমাদের বাংলাদেশে কোনভাবে স্থাপন করতে? অবশ্যই পারি, শুধু একটু চেষ্টা আর সদিচ্ছা। সে সদিচ্ছা তোমার আছেতো ?