| রামিম বিশ্বাস |

হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো দিগি¦দিক। তানসিফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মা তাকে ডাকতে শুরু করল। তানসিফ, শিশুর চৌকাঠ পেরিয়ে সদ্য পা রেখেছে কৈশোরে। তাই এরকম অভিজ্ঞতা তানসিফের এই প্রথম। আতঙ্কিত তানসিফ কিছুক্ষণের মধ্যেই চেতনা ফিরে পেয়ে মাকে জিজ্ঞাস করল,

তানসিফ: মা, কিসের শব্দ এটা?

মা: এটা বজ্রপাতের শব্দ বাবা।

তানসিফ: বজ্রপাত কি?

মা: আগুনের ফুলকির মত। যা গাছ বা টিভি অ্যান্টেনার ওপরে এসে পড়ে। তাই বাবা, বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে থাকবি না আর কানে আঙুল দিবি।

এখন বর্ষার মওসুম। হঠাৎ করেই আকাশ কালো হয়ে ঝুম বৃষ্টি নামা শুরু হয়, সাথে মেঘের গর্জন আর আলোর ঝলকানি। ছোটদের জন্য এমনকি বড়দের জন্যও ভীতিকর পরিবেশ। তাই ওপরের অভিজ্ঞতাটুকু কমবেশি আমাদের সবার জীবনেই আছে। আর মায়ের উপদেশের কথা নাই বললাম- এটা সবার জন্যই কমন। চল এবার গল্প ছেড়ে বিজ্ঞানে ফিরি।

তোমরা সকলেই ইলেকট্রনকে চেনো, যার সম্পদ বলতে কিছুই নেই এক ‘ছড়ি’ ছাড়া (‘ছড়ি’ মানে তার আধানের মাইনাস চিহ্নকে বুঝানো হয়েছে)। কারণ!!! কারণ একটাই, দৃষ্টিহীনতা। বজ্রপাত, এই অন্ধ ইলেকট্রনের প্রবাহ ছাড়া আর কিছুই নয়। চলো এবার ব্যাখ্যার দিকে যাওয়া যাক।

তোমাদের নবম-দশম শ্রেণীর বইয়ে পৃথিবীকে ইলেকট্রনের আধার বলা থাকলেও ব্যাপারটা আসলে ওরকম না। পৃথিবী বিশাল আকারের চার্জ নিরপেক্ষ গোলক, যার বিভব শূন্য। অর্থাৎ এতে পর্যাপ্ত ধনাত্মক ও ঋনাত্মক চার্জ পরস্পরকে নাকচ করে আধান নিরপেক্ষ হয়ে আছে। তাই কোন চার্জ পৃথিবী পৃষ্ঠের সামান্য উপরে এলে তা আবেশ প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর পৃষ্ঠে বিপরীত চার্জ আবিষ্ট করে। ফলে তারা পরস্পরকে আকর্ষণ করে মিলিত হয়। আর পৃথিবী বিশাল ব্যাসাধের্র গোলক হওয়ায় ক্ষুদ্র চার্জ ইনপুট হওয়াতে তার মোট চাজের্র কোন পরিবর্তন হয় না।

এবার চল মেঘ নিয়ে কিছু জানি। প্রচন্ড গরম ও সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত জলীয় বাষ্প উপরে উঠে ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে। একসময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ স্ফটিকে পরিণত হয়। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফটিকগুলো উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং এক সময় ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি এবং মাঝারি থেকে বড় স্ফটিকে পরিণত হয়ে অভিকর্ষের টানে মাটিতে পরে (যা শিলাবৃষ্টি নামে পরিচিত)। এটা অনেকটাই তোমার মত। তুমি পরীক্ষার আগের রাতে মুখস্থ করে মাথা ভার কর, আর পরীক্ষার হলে গিয়ে সেই ভারমুক্ত হও, পরের দিনে আবার সেই একই কাহিনী।

ক্ষুদ্র স্ফটিকগুলোর ঊর্ধ্বগতি আর বড় স্ফটিকগুলোর নিম্নগতির ফলে তারা পরস্পরের সাথে ধাক্কা খায় এবং তাদের মধ্যে চাজের্র আদান-প্রদান ঘটে। ফলে মেঘের ওপরের অংশ ধনাত্মক (+) এবং নিচের অংশ ঋণাত্মক (-) চার্জে চার্জিত হয় (অনেকটা অলিম্পিক ব্যাটারির মত)।

image 05

মেঘের নিচের অংশের অন্ধ ইলেকট্রনগুলোর সংখ্যা যখন বেশি হয়ে যায়, তখন তারা “ছড়ি হাতে অন্ধ”র মত নিচের দিকে চলা শুরু করে প্রোটন বা ধনাত্মক (+) চাজের্র খোঁজে আর ভূমিতে অবস্থিত প্রোটনগুলো অন্ধ ইলেকট্রনের প্রভাবে আবিষ্ট হয়ে গাছ, উঁচু ভবনের চূড়া, টিভি অ্যান্টেনা ইত্যাদির শীর্ষ অবস্থান করে। যখনই কোন ইলেকট্রন ভূমিস্থ প্রোটনের সহিত মিলিত হয়, তখনই আমরা আলোর ঝলক (বক্ররেখার মত) দেখতে পাই যা আসলে ইলেকট্রনের গতি পথ। তাই বজ্রপাত সর্বদাই উঁচু কাঠামোর ওপর আপতিত হতে দেখা যায়। কারণ ইলেকট্রন সর্বপ্রথম, সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত প্রোটনের সাথেই মিলিত হয়।

চিত্রঃ প্রোটনের খোঁজে ইলেকট্রন

চিত্রঃ প্রোটনের খোঁজে ইলেকট্রন

চিত্রঃ ইলেকট্রন ও প্রোটনের মিলন ‘প্রত্যাবর্তন ঘাত’

চিত্রঃ ইলেকট্রন ও প্রোটনের মিলন ‘প্রত্যাবর্তন ঘাত’

চিত্রঃ ইলেকট্রন ও প্রোটনের মিলন ‘প্রত্যাবর্তন ঘাত’

চিত্রঃ ইলেকট্রন ও প্রোটনের মিলন ‘প্রত্যাবর্তন ঘাত’

এটা অনেকটা দৌড় প্রতিযোগিতার মত। একজন ত্রিভুজের ভূমি ও লম্ব বরাবর গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাল, অপরজন অতিভুজ বরাবর গিয়ে সর্বনিম্ন পথে ও সর্বনিম্ন সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাল। ফলে ২য় জন প্রথম হল এবং পুরস্কার লাভ করল। এখানেও যে ইলেকট্রন সর্বনিম্ন পথে ও সর্বনিম্ন সময়ে প্রোটনের সাথে মিলিত হয় তার গতি পথই হয় বজ্রপাতের গতিপথ এবং পুরস্কার হিসেবে দেখা পাওয়াযায় আলোর ঝলকানি। নিম্নমুখী অন্ধ ইলেকট্রনের গতি অনেক বেশি হওয়ায় (৬০,০০০ মিটার/সে) ঘটনাটি ঘটতে তাই কয়েক মিলি সেকেন্ড সময় লাগে।

যখন ইলেকট্রন ও প্রোটন মিলিত হয় তখন একটি শক্তিশালী তড়িৎ ধনাত্মক (+) হতে ঋণাত্মক (-) অর্থাৎ পৃথিবী হতে মেঘের দিকে প্রবাহিত হয়, যা বজ্রপাতের ‘প্রত্যাবর্তন ঘাত’ নামে পরিচিত। এই ঘাতটিই আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয়। এই প্রত্যাবর্তন ঘাতের ফলেই প্রচন্ড শব্দ উৎপন্ন হয়।

যখন ইলেকট্রন ও প্রোটন মিলিত হয় তখন একটি শক্তিশালী তড়িৎ ধনাত্মক (+) হতে ঋণাত্মক (-) অর্থাৎ পৃথিবী হতে মেঘের দিকে প্রবাহিত হয়, যা বজ্রপাতের ‘প্রত্যাবর্তন ঘাত’ নামে পরিচিত। এই ঘাতটিই আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয়। এই প্রত্যাবর্তন ঘাতের ফলেই প্রচন্ড শব্দ উৎপন্ন হয়।

যখন ইলেকট্রন ও প্রোটন মিলিত হয় তখন একটি শক্তিশালী তড়িৎ ধনাত্মক (+) হতে ঋণাত্মক (-) অর্থাৎ পৃথিবী হতে মেঘের দিকে প্রবাহিত হয়, যা বজ্রপাতের ‘প্রত্যাবর্তন ঘাত’ নামে পরিচিত। এই ঘাতটিই আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয়। এই প্রত্যাবর্তন ঘাতের ফলেই প্রচন্ড শব্দ উৎপন্ন হয়।

একটি ব্যাপার কি লক্ষ্য করেছ, বজ্রপাতে আলোর ঝলকানি দেখার কিছুক্ষু পর কিন্তু শব্দ শোনা যায় অথচ ঘটনা দুটি ঘটে এক সাথেই। তোমরা জানো, আলোর বেগ ৩০০,০০০,০০০ মিটার/সে এবং বাতাসে শব্দের বেগ ৩৪০ মিটার/সে এর মত। যেহেতু শব্দের তুলনায় আলোর বেগ অনেক বেশি তাই দুটি ঘটনা একসাথে ঘটার পরও আলো আমাদের কাছে আগে এসে পৌঁছায়। তাই আমরা আগে আলোর ঝলক দেখি এবং পরে শব্দ শুনি।

পৃথিবীতে মোট চার ধরনের বজ্রপাত রয়েছে

১। মেঘ ও ভূমির মধ্যে : মেঘ ও ভূমির মধ্যে চার্জের ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয়। যা আমরা উপরে আলোচনা করলাম।

২। মেঘ ও বাতাসের মধ্যে :  মেঘের ধনাত্মক চার্জ ও মেঘের চারপাশে বাতাসে অবস্থিত বিপরিত চার্জের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়।

 ৩। মেঘ ও মেঘের মধ্যে : দুটি ভিন্ন মেঘের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়।

৪। একই মেঘের মধ্যে : একই মেঘের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়।

তবে সম্প্রতি ঊর্ধ্বমুখী অর্থাৎ ভূমি থেকে মেঘের দিকে গমনকারী বজ্রপাত দেখা গিয়েছে যার রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, মেঘে বরফ স্ফটিকের ক্রিয়ায় উপরের প্রান্তে ঋণাত্মক এবং নিচের প্রান্তে ধনাত্মক আধানের তৈরি হয়, যা ভূমির ইলেকট্রনকে নিজের দিকে টানে। ফলে ইলেকট্রন গুলো উপরের দিকে ভ্রমণ করে এবং আমরা ঊর্ধ্বমুখী আলোর ঝলকানি দেখি।

এসো জেনে নিই বজ্রপাত সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য

  • পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন বজ্রপাত হতে দেখা যায়।
  • সিঙ্গাপুরে বজ্রপাতের হার সবচেয়ে বেশি।
  • পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ফ্লোরিডায় বেশি বজ্রপাত দেখা যায়।
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং” গড়ে বছরে ২৩ বার বজ্রপাতের শিকার হয় এবং একদা ২৪ মিনিটের ব্যবধানে ৮ বার বজ্রপাতের শিকার হয়েছিল।

এখন তোমরা নিশ্চয়ই উপরের উদ্দীপকে তানসিফের মায়ের উপদেশগুলোর কারণ উপলব্ধি করতে পারছো। তোমাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন রেখে বিদায় নিচ্ছি। কেন এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বেশি বজ্রপাতের শিকার হয়? উত্তর পাঠাতে ভুলোনা কিন্তু।