| মুসা ইয়াহিয়া |

শিরোনাম দেখে কি কপাল কুঁচকে গেছে? জ্যোতির্বিদ্যায় নোবেল! এ কেমন অদ্ভূতুড়ে কথা! হ্যাঁ, জ্যোতির্বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রদানের কোন ব্যবস্থা নেই। নোবেল নেই বিজ্ঞানের আরেকটি অবিচ্ছেদ্য শাখা গণিতের জন্যেও। ফলে এই দু’টি ফিল্ড নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- কেন এই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় বাদ পড়ে যাচ্ছে। আলফ্রেড নোবেল সাহেব তাঁর নোবেলের উইলে বলে রেখেছিলেন নোবেল প্রাইজ শুধু তাঁদেরকেই দেওয়া হবে যারা পরবর্তী বছরগুলোতে মানবজাতির সর্বোত্তম কল্যাণ সাধন করবে। তিনি বলে দিয়েছিলেন পুরস্কারের ক্ষেত্রও। কিন্তু তাঁর তালিকায় জ্যোতির্বিদ্যার কোন স্থান ছিল না। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন গণিত বা বিজ্ঞানের এই শাখাটির তেমন কোন বাস্তব কল্যাণ নেই।

অবশ্য পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি, সাহিত্য- এই পাঁচটি বিষয়ের পাশাপাশি পুরস্কারের শ্রেণিতে যুক্ত হয় অর্থনীতিও। তবে এটির অর্থায়ন করে সুইডিশ সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। দুর্ভাগ্যক্রমে জ্যোতির্বিদ্যাকে নোবেলের তালিকায় প্রবেশ করানোর জন্যে কোন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি।

জ্যোতির্বিদ্যায় নোবেল না থাকলেও মহাকাশপ্রেমী ব্যাপন পাঠকদের হতাশ হবার কারণ নেই। অনেক বিজ্ঞানীই জ্যোতির্বিদ্যায় অবদান রেখে নোবেল পেয়েছেন। কারণ, জ্যোতির্বিদ্যা যে আবার পদার্থবিদ্যার ভাই ভাই!

তবে, জ্যোতির্বিদ্যায় নোবেলের ব্যবস্থা থাকলে এই পুরস্কারের জন্যে অন্যতম বড় দাবিদার হতে পারতেন এডুইন হাবল। নোবেল পুরস্কার মরণোত্তর দেবার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু তিনি তো নোবেল যুগেরই মানুষ। মহাবিশ্বের বিশাল রূপ তিনিই প্রথম মানুষের সামনে নিয়ে আসেন। প্রমাণ করেন, শুধু আমাদের মিল্কিওয়েই নয়, মহাবিশ্বে এরকম আরো বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে। তারা আবার প্রতিনিয়ত দূরেও সরে যাচ্ছে। তাঁর এই পর্যবেক্ষু থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্ব হিসেবে বিগ ব্যাংয়ের নাম উঠে আসে। তাঁর নামের স্মরণে তৈরি হাবল স্পেইস টেলিস্কোপ বর্তমানে দূর আকাশের নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ও নেবুলাদের দারুণ সব তথ্য পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে।

তাঁর সমসাময়িককালে জ্যোতির্বিদ্যাকে ফিজিক্সের অংশ মনে করা হতো না। তিনি এই ধারণা পরিবর্তনের জন্যে কাজ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনকালে সেই প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখেনি। তবে, তাঁর মৃত্যুর পরে নোবেল কমিটি জ্যোতির্বিদ্যাকে ফিজিক্সের শাখা হিসেবে মেনে নেয়।

পরবর্তীতে তাই বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী জ্যোতির্বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

১৯৮৩ সালের ফিজিক্সে নোবেল পান উপমহাদেশের বিজ্ঞানী সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর ও আমেরিকান বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফুলার। চন্দ্রশেখরের অবদান ছিল নক্ষত্রদের গঠন ও বিবর্তনের ভৌত প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাত্ত্বিক গবেষণা। অপর বিজ্ঞানী ফুলারের অবদান ছিল মহাবিশ্বে রাসায়নিক মৌলিক পদার্থগুলোর গঠনে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার প্রভাব সম্পর্কে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক গবেষণা। কেউ কেউ বলেছিলেন বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েলকেও একই বছর পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, তিনিই ছিলেন নক্ষত্রদের নিউক্লিও সংশ্লেষণ তত্ত্বের প্রবক্তা।

আরেকটু পেছনে গেলে আমরা দেখি ১৯৬৭ সালেও ফিজিক্সে নোবেলের বিষয় ছিল জ্যোতির্বিদ্যা। এ বছর নোবেল পেয়েছিলেন হ্যান্স বেথ। অবদান, নক্ষত্রদের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা। অবশ্য দিন দিন জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখা প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে বিধায় উপরিউক্ত দুটি নোবেলের বিষয়ই এখন সরাসরি জ্যোতির্বিদ্যায় (astronomy)  না পড়ে কসমোলজি তথা মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিবর্তন বিষয়ক বিদ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

এই শতাব্দীতেও জ্যোতির্বিদ্যায় নোবেল পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সালটি ২০০২। নোবেল পেয়েছেন তিনজন বিজ্ঞানী। এঁরা হলেন, রে ডেভিস, মাসাতোশি কোশিবা ও রিকার্ডো গিয়াকোনি। গিয়াকোনি ছিলেন হাবল স্পেইস টেলিস্কোপের প্রথম পরিচালক। এক্সরে অ্যাস্ট্রোনমিতে অবদান রেখে তিনি নোবেল প্রাইজের জন্যে মনোনীত হন। অন্যদিকে কোশিবা ও ডেভিস সাহেব যৌথভাবে নিউট্রিনো অ্যাস্ট্রোনমি নামক শাখার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা কাজের অংশ হিসেবে শনাক্ত করেন মহাজাগতিক নিউট্রিনো (Cosmic Neutrino)।

১৯৭৮ সালের নোবেল পুরস্কারেও ভাগ বসিয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যা। এ বছর নোবেল জেতেন আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন নামে দুই বিজ্ঞানী। তাঁরা মহাবিশ্বের জন্মের সময় নির্গত কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সংশ্লিষ্ট মিলিমিটার বেতার তরঙ্গ (Millimeter Radio Wave) আবিষ্কার করেন। প্রসঙ্গত অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ভাষায় কৃষ্ণবস্তু কেবল কালো জিনিসকেই বলা হয় না। এরা হচ্ছে সেই সব মহাজাগতিক বস্তু (বিশেষত নক্ষত্র) যারা এদের ওপর পতিত শতভাগ বিকিরণ শোষণ করতে পারে।

১৯৭৪ সালের নোবেলেও পদচারণা ছিল জ্যোতির্বিদ্যার। এবারে নোবেল জেতেন যুক্তরাজ্যের দুই বিজ্ঞানী- মার্টিন রাইল ও অ্যান্টনি হিউইশ। অবশ্য এই বছরের নোবেল পুরস্কার নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। হিউইশকে নোবেল দেওয়া হয়েছিল পালসার আবিষ্কারের জন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল দাবি করলেন পালসারের প্রকৃত আবিষ্কারক আসলে জোকেলিন বেল। ফলে বিতির্কটি নিয়ে বেশ হৈচৈ হয়ে যায়। প্রসঙ্গত জানা প্রয়োজন পালসার কাকে বলে? পালসার শব্দটি এসেছে pulsating radio star  কথা থেকে। আবার, pulsate অর্থ হচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে সংকুচিত ও প্রসারিত হওয়া। এরা মূলত এক ধরনের রোটেটিং তথা আবর্তনশীল নিউট্রন স্টার। আর নিউট্রন নক্ষত্র কাকে বলে তা আশা করি তুমি জানো। যারা জানো না, কানে কানে শুনে রাখো, একটি নক্ষত্রের অভ্যন্তর ভাগের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে এতে আর বহির্মুখী প্রসারণ চাপ থাকে না বলে বাইরের অংশ সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে আলাদা হয়ে যায় এবং অবশিষ্টাংশ নিজস্ব অভিকষের্র চাপে গুটিয়ে ছোট্ট আকার ধারণ করে। ফলে এদের ব্যাসার্ধ দাঁড়ায় মাত্র সাত মাইল যেখানে ভর হয় সূর্যের ২ গুণ। এটাই হলো নিউট্রন নক্ষত্র। এই নক্ষত্রে যখন চৌম্বকক্ষেত্র উপস্থিত থাকে তখন এটি নিয়মিতভাবে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়। হৃৎপিন্ডের উঠা নামাকে আমরা যেমন পালস বলি, তেমনি একই ধরনের কারণে এরা নাম পেয়েছে পালসার।

একই বছরে নোবেল পাওয়া আরেক বিজ্ঞানী মাট্রিন রাইলকে নিয়ে অবশ্য বিতর্ক হয়নি। তিনি রেডিও টেলিস্কোপ বিশেষ করে অ্যাপারচার সিনথেসিসে অবদান রেখে প্রাইজের জন্যে মনোনীত হন। অ্যাপারচার সিনথেসিস বিষয়টি হচ্ছে বিশেষত তড়িচ্চৌম্বক তরঙ্গ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার কৌশল বিশেষ।

জ্যোতির্বিদ্যার নোবেল পাওয়ার ঘটনা আরো একবার ঘটেছিল ১৯৯৩ সালে। এবারেও পুরস্কারটি ভাগাভাগি হয় দুইজন বিজ্ঞানীর মধ্যে। দু’জনই আমেরিকান বিজ্ঞানী- রাসেল অ্যালান হালস ও জোসেফ টেইলর জুনিয়র। তাঁরা একটি নতুন ধরনের পালসার আবিষ্কার করেন। এই পালসারদের বৈশিষ্ট্য হলো, এরা আরেকটি নিউট্রন নক্ষত্রের সাথে যৌথভাবে উভয়ের ভরকেন্দ্রকে প্রদক্ষিু করে যার ফলে একটি বাইনারি স্টার ব্যবস্থা তৈরি হয়।

এই হলো জ্যোতির্বিদ্যায় নোবেলের খবরাখবর। আমরা এক বুক স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছি এক দিন আমাদের ব্যাপন বন্ধুদের মধ্যে থেকেই কেউ হয়ত বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে আনবে, নাম উজ্জ্বল করবে বাংলাদেশের।