| আসিফ বিন আলতাফ |

‘ইঞ্জিন’ শব্দটির সাথে পরিচিত নয় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ইঞ্জিনের ব্যবহার আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে। বাসা বাড়ি থেকে শুরু করে জলে, স্থলে,আকাশে, অফিস আদালত কল কারখানা সব জায়গাতে ইঞ্জিনের ব্যবহার। আকাশের সেই বিশাল বড় বিমান, সমুদ্রের জাহাজ থেকে শুরু করে রাস্তায় চলা মোটরসাইকেল, সবই সম্ভব হয়েছে ইঞ্জিনের কারনে।  ইঞ্জিন আবিস্কারের ফলে সভ্যতা পেয়েছে গতি, বেড়েছে কাজের পরিধি, কমেছে কাজের সময়। আগে যে কাজটি করতে শত শত মানুষ প্রয়োজন হত সঙ্গে প্রচুর সময় লাগত, আর এখন ইঞ্জিনের মাধ্যমে একটি সুইচ টিপে দিলেই মুহূর্তেই সেই কাজটি হয়ে যাচ্ছে।

ইঞ্জিন (Engine) শব্দটি এসেছে প্রাচীন ফ্রেঞ্চ “engin” এবং ল্যাটিন “ingenium” শব্দ থেকে। আমরা জানি শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, এক রুপ থেকে অন্য রুপে নেয়া যায় মাত্র। যে যন্ত্রটি শক্তিকে কার্যকর যান্ত্রিক শক্তিতে রুপান্তর করে তাকে ইঞ্জিন বলে। সহজ ভাষায় ইঞ্জিনের সাহায্যে আমরা গতি (Motion) পাই। ইঞ্জিন আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ গতি তৈরি করতো হতো, নিজের পেশী শক্তি দিয়ে না হয় কোন প্রাণী দিয়ে। এখনও আমরা এমন যন্ত্র দেখিনা তা কিন্তু নয়। যেমন রিক্সা, ভ্যান, গরুর গাড়ী ইত্যাদি।

১৭৭২ সালে ইংলিশ বিজ্ঞানী থমাস নিউকমেন বাষ্প চালিত পাম্প আবিষ্কার করে, যে টি খনি থেকে পানি তুলতে ব্যবহার করা হত। এর পূর্বে যে কোন প্রচেষ্টা হয়নি তা কিন্তু নয়। তবে শিল্প বিপ্লবের শুরু যার হাত ধরে তার নাম হল জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯)। তাঁর ওপর দায়িত্ব ছিল থমাস নিউকমেন এর আবিষ্কৃত বাষ্প ইঞ্জিনকে আরো উন্নত করা। তাঁর ফলশ্রুতিতে যে বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয় তার মাধ্যমে মুলত শিল্প বিপ্লবের সূচনা। বাষ্পের যে চাপ তৈরী হয় তার মাধ্যমে একটি পিস্টন কে ধাক্কা দেয় এবং পিস্টনটি যুক্ত থাকে একটি কানেকটিং রড এর সাহায্যে Crank Shaft এর সাথে। এভাবেই Motion পাওয়া যায়। (পিস্টন(Piston) এমন একটি ডিভাইস যেটি Crank Shaft এর সাথে যুক্ত থাকে এবং সরল রৈখিক গতিকে ঘূর্ণন গতিতে রুপান্তর করে।) বাষ্প ইঞ্জিন দিয়ে চলত বাষ্প চালিত ট্রেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাষ্প ইঞ্জিনের সাহায্যে শিল্প বিপ্লব হয়। মানুষের জীবনে আসে গতি। উৎপাদন বেড়ে যায় বহুগুণে। বাষ্প ইঞ্জিনে কয়লা দিয়ে পানিকে বাষ্প করা হত।

আরেকটি নতুন একটা শব্দ জানা প্রয়োজন তা হল  দহন (Combustion)। যে কোন জ্বালানীকে আগুনে পোড়ালে  তাপ উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াকে দহন বলে। দহন কোথায় হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে ইঞ্জিনকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ অন্তঃ দহন (Internal Combustion) ইঞ্জিন অর্থাৎ এই ইঞ্জিনের ভেতরেই দহন হয়। এবং বহিঃ দহন (External combustion) ইঞ্জিন অর্থাৎ দহন ইঞ্জিনের বাহিরে সম্পন্ন হয়। যেমনঃ বাষ্প ইঞ্জিন। বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর অনেক সময় চলে যায়। বিভিন্ন প্রচেষ্টা চলে আরো উন্নত, এবং কম জ্বালানী দিয়ে কিভাবে ভাল ইঞ্জিন তৈরি করা যায়।

আচ্ছা আরেকটু চিন্তা করা যাক, আমরা যে গাড়ীগুলো ব্যবহার করি সচারচর যেমন মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক, কার ইত্যাদি। এগুলোর ইঞ্জিন কেমন? External combustion ইঞ্জিন দিয়ে কি এগুলো চালানো সম্ভব? অবশ্যই না। যদি তাই হত তাহলে বাসের পিছনে একটি চুল্লি থাকত আর সেখানে কয়েকজন কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালাতো। বিশাল বড় একটা পানি গরম করার পাত্র থাকতে হত। আরো কত কি। তাহলে মানুষ বসত কোথায়? তাই না। এই সমস্যার সমাধান হয়েছে Internal Combustion ইঞ্জিন এর সাহায্যে। এই ইঞ্জিনের সুন্দর মডেল প্রথম যিনি দিয়েছিলেন তাঁর নাম নিকোলাস অটো (Nicolaus otto)। জার্মান এই নাগরিক ১৬ বছর বয়সেই স্কুল ছেড়ে দেন। প্রথমে মুদির দোকানে কাজ করেন তারপর ভ্রাম্যমান বিক্রেতা হিসাবে কাজে যোগদান করেন। কাজের জন্য তাঁকে বিভিন্ন যায়গায় যেতে হত। ফলে যাতায়াতের অসুবিধা তাঁকে খুব ভোগাত। তখন সে সপ্ন দেখত এমন একটি যানবাহনের যেটি শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাবে কিন্তু সময় নিবে কম। ১৮৬২ সালে সে একজনের সঙ্গে কাজ শুরু করে কয়েকটি ডিজাইন করেন। কিন্তু সফল হন ১৮৭৬ সালে। এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই বর্তমানে অটোমোবাইল এর ইঞ্জিন তৈরি হচ্ছে , যদিও ডিজাইনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে এটা মানতে হবে। এই ইঞ্জিনকে গ্যাসোলিন ইঞ্জিনও বলা হয়।  গ্যাসোলিন হল একধরনের জ্বালানী শ্রেণী। যার মধ্যে বহুল ব্যবহৃত হল পেট্রোল, অকটেন ইত্যাদি। এই জন্য এদেরকে পেট্রোল ইঞ্জিন (Petrol Engine) ও বলে।

আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার এর কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন রুডলফ ডিজেল (Rudlof Diesel). প্যারিস এই বিজ্ঞানী ১৮৯২ সালে আরেক ধরনের ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন তাঁর নাম ডিজেল ইঞ্জিন (Diesel Engine)। এই ইঞ্জিনের জ্বালানী হল অন্য শ্রেণীর। বাস, ট্রাক সহ বড় বড় যানবাহন যেগুলোকে অনেক লোড নিতে হয় সেগুলোতে ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে জ্বালানী হিসেবে তেলের পরিবর্তে CNG (Compressed Natural Gas) ব্যবহার করা হয়। ইঞ্জিন ডিজাইন, ইঞ্জিন এর জ্বালানী, ইঞ্জিনের তৈরি ধোঁয়া থেকে যে দূষণ ইত্যাদি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ ও প্রচুর কাজ হচ্ছে, গবেষনা চলছে।

ইঞ্জিনের আরেকটি প্রকার হল মোটর (Motor). এখানে বিদ্যুৎ শক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তি পাওয়া যায় । আর আগের ক্ষেত্রে জ্বালানীর অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক শক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তি পাওয়া যেত।

যাই হোক ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে মানব সভ্যতা যে গতি পেয়েছে, এবং এমন অনেক কাজ করতে সক্ষম হয়েছে যা মানুষের পক্ষে সম্ভব হত না। সামনের দিনগুলোতে আরো উন্নতি হবে এই আশাবাদ রেখেই এই পর্বের লেখার ইতি টানলাম।