| পারভেজ মাহির চৌধুরী |

Binder1_page74_image301

মার্জিয়া প্রশ্ন করল, “ভাইয়া, ৯ এর পর ১০ হয় কেন?” প্রশ্নটা শুনে কেমন আনমনা হয়ে গেলাম। চলে গেলাম সাড়ে তিন হাজার বছর আগের প্রাচীন বাংলার বরেন্দ্র জনপদের অংকপুর গ্রামের এক কৃষকের ঘরের সামনের আঙিনায়। যার ছিল গোলা ভরা ধান, গম; ক্ষেত ভরা ভুট্টা আর আলু; এবং আরও অনেক কিছু। সবই ছিল কৃষকের, কিন্তু শান্তি ছিল না মনে। কারণ, সে এত ফল-ফসলের হিসাব রাখতে পারতো না !!

কৃষক শুধু ০(শূন্য) থেকে ৪(চার) পর্যন্ত গুণতে পারে। এর বেশি আর গুণতে পারে না। সে ০টা ধান (কোন ধান নেই), ১টা ধান(!!), ২টা ধান, ৩টা ধান, ৪টা ধান পর্যন্ত গুণতে পারে, কিন্তু যখনই আর একটা ধান চলে আসে (আমাদের ভাষায় ৫টা), তখনই সে আর গুণতে পারে না; কারণ ‘৫’ সংখ্যাটির সাথে সে পরিচিত নয়। গম, ভুট্টা, আলু সবকিছুর ক্ষেত্রেই সে একই সমস্যায় পড়তে লাগল। সে চিন্তা করতে শুরু করল, কী করা যায়…।

দিন যায়, মাস যায়, সে ভাবতে থাকে। সে ধান, গম, ভুট্টা, আলু রাখার জন্য আলাদা আলাদা ঘর তৈরি করল; কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হয় না। হঠাৎ একদিন তার মাথায় অভিনব এক বুদ্ধি এল। সে চিন্তা করল, যখনই তার কাছে ৪টার বেশি আরও ১টা ধান আসবে, তখনই সে ঐ ধানগুলোকে (অর্থাৎ ৫টি ধানকে; উল্লেখ্য, কৃষক কিন্তু ‘৫টি ধান’ বুঝে না) একটি কাগজের প্যকেটে মুড়িয়ে তাকে গমের ঘরে রেখে দিবে; অর্থাৎ ধানের এই প্যাকেটটি এখন ১টা গম হিসেবে বিবেচিত হবে। একইভাবে, যখন ৪টার বেশি আরও ১টা গম হবে (অর্থাৎ ৫টা গম), তখন সেটিকে প্যাকেট করে ভুট্টার ঘরে রেখে তাকে ১টা ভুট্টা হিসেবে চিন্তা করবে। এবং ৪টার বেশি ১টা ভুট্টা হয়ে গেলে তাকে প্যাকেট করে ১টা আলু হিসেবে চিন্তা করবে।

চিন্তার সাথে সাথে সে কাজ শুরু করে দিল। পরের বছর সে শুধু ধান চাষ করল। ধান উঠানোর পর সে উপরোক্ত পদ্ধতিতে প্যাকেট করতে লাগল এবং বছর শেষে দেখল, তার কাছে ৩টা আলু আছে (কী অবাক ব্যাপার, ধান হয়ে গেছে আলু!!!)। তাহলে, প্রকৃতপক্ষে তার কাছে কয়টি ধান আছে? আমরা দেখেছি, প্রতি ৫টি ভুট্টা প্যাকেট করে ১টি আলু বানানো হয়। তাহলে,

১টি আলু = ৫টি ভুট্টা

একইভাবে,        ১টি ভুট্টা = ৫টি গম

এবং                  ১টি গম = ৫টি ধান

সুতরাং ৩টি আলু = ৩ ´ ৫ (=১৫) টি ভুট্টা = ১৫ ´ ৫ (=৭৫) টি গম = ৭৫ ´ ৫ (=৩৭৫) টি ধান। অতএব, তার কাছে আসলে ৩৭৫টি ধান আছে (সারা বছরে মাত্র ৩৭৫টা ধান!!)। এখানে বলে রাখা ভাল, কৃষক কিন্তু এসব গুণ-ভাগ বুঝে না। ‘৩৭৫টি ধান’ এই কথাটির সাথেও সে পরিচিত নয়। ‘৩৭৫টি ধান’ না বুঝলেও সে এতটুকু বুঝতে পারছে যে, ৩টা আলুর সমপরিমাণ ধান তার কাছে আছে। ধান কম পেলেও সে এখন ধানের পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা করতে পারছে দেখে খুব খুশী।

পরের বছর সে আবার ধান চাষ করল। এবার বছর শেষে দেখা গেল, তার কাছে ৩টা আলু, ৪টা ভুট্টা, ২টা গম আর ১টা ধান আছে। তাহলে, আসলে তার কাছে কতগুলো ধান আছে?

আলু ভুট্টা গম ধান
৩টি আলু = ৩ ´ ৫ = ১৫টি ভুট্টা = ১৫ ´ ৫ = ৭৫টি গম = ৭৫ ´ ৫ = ৩৭৫টি ধান
  ৪টি ভুট্টা = ৪ ´ ৫ = ২০টি গম = ২০ ´ ৫ = ১০০টি ধান
  ২টি গম = ২ ´ ৫ =   ১০টি ধান
  ১টি ধান
  মোট ধান = ৪৮৬টি ধান

অর্থাৎ এবার সে ৪৮৬টি ধান পেয়েছে। ‘৪৮৬টি ধান’ হিসাব করতে না পারলেও সে এতটুকু বলতে পারে যে, তার কাছে “৩ আলু ৪ ভুট্টা ২ গম ১ ধান” আছে। এভাবে বলাটা সহজ হলেও লিখাটা কঠিন। তাই সে এ বিষয়টিকে সংক্ষেপে লিখল, তার কাছে ‘৩ ৪ ২ ১’ টি ধান আছে। এভাবে সে গণনা করার একটা অদ্ভুত পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলল!!

এরও প্রায় আটশ বছর পরের কথা। মানুষ তার এই আবিষ্কারের কথা ভুলে গেল। এবারও একই দৃশ্য, একই রকম কৃষক, প্রচুর পরিমাণে ধান, গম, ভুট্টা, আলু। তবে এবার একটু উন্নত বুদ্ধির কৃষক; সে ০(শূন্য) থেকে ৯(নয়) পর্যন্ত গুণতে পারে। এরপর আর গুণতে পারে না। সে ০টা ধান, ১টা ধান, ২টা ধান, ……, এভাবে ৯টা ধান পর্যন্ত গুণতে পারে, কিন্তু যখনই আর একটা ধান চলে আসে (আমাদের ভাষায় ১০টা), তখনই সে আর গুণতে পারে না; কারণ ‘১০’ সংখ্যাটির সাথে সে পরিচিত নয়। সুতরাং তার কাছে যখন ৯টার বেশি আর ১টা ধান চলে আসে, তখন ঐ ধানগুলোকে (অর্থাৎ ১০টি ধানকে) কাগজের প্যাকেটে মুড়িয়ে ১টি গম হিসেবে বিবেচনা করে। একইভাবে, ১০টি গম = ১টি ভুট্টা এবং ১০টি ভুট্টা = ১টি আলু।

উন্নত বুদ্ধির এই কৃষক বছর শেষে ০টি আলু, ৪টি ভুট্টা, ৮টি গম এবং ৬টি ধান পেল। তাহলে, প্রকৃতপক্ষে, তার কাছে কয়টি ধান আছে?

আলু ভুট্টা গম ধান
০টি আলু = ০টি ভুট্টা = ০টি গম = ০টি ধান
  ৪টি ভুট্টা = ৪ ´ ১০ = ৪০টি গম = ৪০ ´ ১০ = ৪০০টি ধান
  ৮টি গম = ৮ ´ ১০ =   ৮০টি ধান
  ৬টি ধান
  মোট ধান = ৪৮৬টি ধান

অর্থাৎ সে ৪৮৬টি ধান পেয়েছে। তাহলে সে বলবে, “৪ ভুট্টা ৮ গম ৬ ধান”। সে লিখবে, তার কাছে ‘৪ ৮ ৬’ টি ধান আছে। আরে তাই তো? সত্যিই তো তার কাছে ৪৮৬টি ধান আছে!!!

লক্ষ্য করো, প্রথম কৃষকও ৪৮৬টি ধান পেয়েছিল, কিন্তু সে লিখল ‘৩ ৪ ২ ১’; অথচ দ্বিতীয় কৃষক লিখল         ‘৪ ৮ ৬’। এর কারণ হচ্ছে, প্রথম কৃষকের কাছে ৫টি অংক (০ থেকে ৪ পর্যন্ত) ছিল; যেখানে দ্বিতীয় কৃষকের কাছে ১০টি অংক (০ থেকে ৯ পর্যন্ত) আছে। সুতরাং গণনার জন্য কয়টি অংক ব্যবহার করা হচ্ছে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৫টি অংক ব্যবহার করলে ৪৮৬টি ধান হয়ে যায় ‘৩ ৪ ২ ১’ টি ধান। এ ধরনের গণনা পদ্ধতিকে বলা হয় ৫-ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি (5-based number system)। আর ১০টি অংক ব্যবহার করলে ৪৮৬টি ধান   ‘৪ ৮ ৬’ ই থেকে যায়। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ১০-ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি বা দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি (10-based or decimal number system)। ১০টি অংক ব্যবহার করে দ্বিতীয় কৃষক গণনার যে পদ্ধতি চালু করেছিল, এটিই আসলে আমাদের প্রচলিত দশমিক গণনা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ধান, গম, ভুট্টা, আলু এর পরিবর্তে আমরা একক, দশক, শতক, হাজার এই শব্দগুলো ব্যবহার করি। সেক্ষেত্রে, “৪ ভুট্টা ৮ গম ৬ ধান” এর পরিবর্তে বলা হয়, “৪ শত ৮ দশ ৬” বা আরও সংক্ষেপে “৪ শত ৮৬ (চার শত ছিয়াশি)”।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, দশমিক পদ্ধতির ‘৪৮৬’ এবং ৫-ভিত্তিক পদ্ধতির ‘৩৪২১’ আসলে একই পরিমাণ নির্দেশ করে। সুতরাং আমরা লিখতে পারি,

(৩৪২১) = (৪৮৬)১০

এখানে, ছোট্ট করে লেখা ‘৫’ আসলে ‘৩৪২১’ সংখ্যাটির ভিত্তি (base) নির্দেশ করে। এই ৫-ভিত্তিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুলো কীভাবে গঠিত হয়? আমরা ০(শূন্য) থেকে শুরু করতে পারি।

প্রথমে কৃষকের কাছে কিছু নাই।
ক্রমান্বয়ে ১টি করে ধান আসতে থাকল।
        ৪টি ধানের পর আরও ১টি ধান চলে আসায় যখন সে আর গুণতে পারে না, তখন তাকে প্যাকেট করে গমের ঘরে রেখে দিল। অর্থাৎ এখন ১টি গম থাকল এবং ধানের ঘর ০ হয়ে গেল। সুতরাং ৫-ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে ৪ এর পরের সংখ্যা হবে ১০।
আবারও ১টি করে ধান আসতে থাকল। গমের ঘরে ১টি গম কিন্তু রয়েই গেল।
এখানে আবারও ৪ এর পর আর ১টি ধান চলে এসেছে। ফলে তাকে প্যাকেট করে গমের ঘরে রাখা হল। সুতরাং এখন ২টি গম এবং ০টি ধান। সুতরাং ১৪ এর পরের সংখ্যা ২০।
এখানে, ৪টি  ধানের পরের ১টি ধান মিলিয়ে ১টি গমের প্যাকেট বানানো হলে দেখা গেল যে, গমও ৪ এর বেশি হয়ে গেছে। ফলে এই ৫টি গমকে নিয়ে প্যাকেট বানিয়ে তাকে ভুট্টার ঘরে রাখা হয়েছে। সুতরাং ৫-ভিত্তিক পদ্ধতিতে ৪৪ এর পরের সংখ্যা হল ১০০।

এবার আমরা খুবই নিম্ন বুদ্ধির এক কৃষকের কাছে যাব, যে কিনা শুধু ০(শূন্য) আর ১(এক) গুণতে পারে; অর্থাৎ তার কাছে অংক আছে মাত্র ২টি। তাহলে, তার গণনা করার পদ্ধতিকে আমরা বলতে পারি ২-ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি বা দ্বিমিক পদ্ধতি (2-based or binary number system)। প্রশ্ন হতে পারে, এরকম বোকা কৃষক হয় নাকি? আসলে আমাদের নিত্যব্যবহার্য অত্যাধুনিক যন্ত্র কম্পিউটারই হচ্ছে এই বোকা কৃষক। কারণ কম্পিউটার শুধু ‘বিদ্যুৎ আছে’ (অর্থাৎ ১) এবং ‘বিদ্যুৎ নাই’ (অর্থাৎ ০) এই দুটো জিনিসই বুঝে। সুতরাং কম্পিউটারের গণনা পদ্ধতি দ্বিমিক ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার কোন উপায়ই নেই!! শুধু কম্পিউটার নয়, যেকোন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রই আসলে এই দ্বিমিক পদ্ধতিতে গণনা করে।

নীচে ‘শূন্য’ থেকে ‘পনের’ পর্যন্ত ২-ভিত্তিক, ৫-ভিত্তিক ও ১০-ভিত্তিক সংখ্যাগুলি একটি ছক আকারে দেওয়া হলঃ

২-ভিত্তিক (দ্বিমিক) ৫-ভিত্তিক ১০-ভিত্তিক (দশমিক)

এরকম আরও দুইটি প্রচলিত সংখ্যা পদ্ধতি হচ্ছে ৮-ভিত্তিক (octal) এবং ১৬-ভিত্তিক (hexadecimal)। নিশ্চয় ভাবছ, ১৬-ভিত্তিক পদ্ধতির ১৬টি অংক কোত্থেকে আসবে? হ্যাঁ, সত্যিই ভাবনার বিষয়। এ ভাবনার ভার তোমাদের উপরই ছেড়ে দিলাম! এছাড়াও তুমি চাইলে যেকোন ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি বানিয়ে তা নিয়ে খেলাধূলা (গবেষণা) করতে পার। তোমার এমন ছোট ছোট গবেষণা হয়তো গণনার জগতে খুলে দিতে পারে নতুন কোন সম্ভাবনার দুয়ার। যা হোক, মার্জিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এতকিছু লেখা। ওকে ব্যাপন তৃতীয় সংখ্যাটি দিয়ে মুচকি হেসে বললাম, “তোর উত্তর পেয়েছিস?”