| আব্দুল্লাহ আল নোমান |

সবসময় এক গাদা ট্যাবলেট-ক্যাপসুল কার বাসায় না পাওয়া যায়! আর যদি কেউ অসুস্থ থাকে তাহলে তো কথাই নেই। তখন তো ঔষুধ-পত্তরের ছড়াছড়ি অবস্থা। জ্বর হলে প্যারাসিটামল, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথায় ওমিপ্রাজোল এগুলোও কমবেশি সবার জানা। কিন্তু বন্ধুরা এ ঔষুধগুলো কিভাবে এলো সেটা তোমরা জানো কি? কিভাবে মানুষ জানল কোনটা কিসের ঔষধ; আর ঐ ঔষধটাই বা মানুষ পেল কোথায়? এবার একটা গল্প শোনো।

কুইনিনের নাম শুনেছো নিশ্চয়ই তোমরা। এটি ম্যালেরিয়া সারানোর ঔষুধ। সেই প্রাচীনকাল থেকে এটি ম্যালেরিয়ার কার্যকর নিরাময় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কথিত আছে যে, সেকালে এক ভদ্রলোক তার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে ভ্রমণকালে জঙ্গলের মধ্যে রাতে অবস্থান করছিলেন। তো রাতে পানি গরম করার সময় কিছু কুইনিনের বাকল পানিতে পড়ে যায়। তারপর সে পানি পান করে তার স্ত্রী সুস্থ বোধ করে। তখন ভদ্রলোক আরো কিছু কুইনিন-গরম পানি তার স্ত্রীকে খাইয়ে দেখলেন। লক্ষুীয় উন্নতি দেখে তিনি বুঝতে পারলেন এটাতে ম্যালেরিয়ার নিরাময়কারী কোন উপাদান আছে।

তখন থেকেই কুইনিন ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

কি, বিশ্বাস হয় গল্পটা? আরে ধুর, গল্প তো শুধুই গল্প। শয়ে শয়ে ঔষুধ বাজারে আছে এখন। সবগুলোর জন্যে যদি মানুষকে জঙ্গলে গিয়ে পানি গরম করতে হয় তাহলে ঔষুধ বিজ্ঞানীরা সবাই লোকালয় ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে উঠত।

এবার তাহলে একটি সত্য ঘটনাই শোন। অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং-এর নাম তোমরা অনেকেই জেনে থাকবেই। সেকালের মানুষরা অবশ্য তাকে চিনতো না। তিনি সামান্য একজন চিকিৎসক ছিলেন মাত্র। তখন সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা মাথা কুটে মরছেন একটি কার্যকর এন্টিবায়োটিক তথা জীবাণুনাশক ঔষধের জন্যে। এ সময় তিনিও জীবাণু নিয়েই কাজ করছিলেন।

একদিন গবেষণাগারে তিনি দেখলেন বাইরে থেকে কিছু ছত্রাক বাতাসে উড়ে এসে জীবাণুর পাত্রে পড়েছে আর সব জীবাণু মরে পড়ে আছে। অন্য কেউ হলে হয়ত পাত্রটি ফেলে দিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করতেন। কিন্তু তিনি ভাবলেন নিশ্চয়ই ছত্রাকের মধ্যে এমন কোন উপাদান আছে যেটা জীবাণুকে মারতে পারে। এরপর সেই ছত্রাক নিয়ে গবেষণা করে তিনি পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেন; প্রথম কার্যকরও সেবনযোগ্য এন্টিবায়োটিক যেটি তখনকার দুনিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই বদলে দেয়।

তার এ আবিষ্কার তাকে এনে দেয় জগৎজোড়া খ্যাতি; এমনকি এজন্যে তাকে নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়। বিজ্ঞানের জগতে এ ধরনের ঘটনাকে বলে সেরেন ডিপিটি বা সুখকর দুর্ঘটনা। একটি দুর্ঘটনা যদি নোবেল পুরস্কার এনে দেয় তাহলে সেটিতো সুখকরই। নয় কি?

তবে আধুনিক ঔষুধ বিজ্ঞান শুধু সেরেন ডিপিটি নির্ভর নয়; বরং পদ্ধতিগত এবং নিয়মতান্ত্রিক গবেষণার মাধ্যমেই এখন নতুন ঔষধ আবিষ্কার করা হয়।

এ গবেষণার শুরুটা হয় দুইভাবে; প্রথমত হতে পারে গবেষণাপত্র খোঁজার মাধ্যমে। যেমন, যদি কেউ ক্যান্সার নিরাময়কারী ঔষুধ তৈরি করতে চান তাহলে ক্যান্সার বিষয়ক গবেষণাপত্র খুঁজে একটি রাসায়নিক যৌগ খুঁজে বের করেন যার ক্যান্সার নিরাময়কারী গুণ আছে।

দ্বিতীয়ত, সেরকম কোন যৌগ খুঁজে না পাওয়া গেলে একদল বিজ্ঞানী সেই অসুখটা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং সেখান থেকে একটি টার্গেট বাছাই করে তার বিরুদ্ধে একটি রাসায়নিক অণু তৈরি করেন।

প্রথম ধাপে প্রাপ্ত অণুটি প্রায় সময়ই দেখা যায় ঔষুধ হিসেবে ব্যবহার উপযোগী নয়। বেশির ভাগ সময়ই সেটি হয় অতিমাত্রায় বিষাক্ত যে সামান্য ওষুধেই রোগীর ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে অথবা সেটি এতটাই দুর্বল থাকে যে রোগ নিরাময় করতে হলে রোগীকে এক গামলা ঔষুধ গেলাতে হবে।

আর বন্ধুরা জানতো, ঔষুধ বিজ্ঞানে একটি কথা আছে যে, All drugs are poison but in low dose অর্থাৎ সব ঔষুধই কিছু মাত্রায় বিষাক্ত। এজন্য প্রথম পর্যায়ে প্রাপ্ত যৌগকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্যে তাকে রাসায়নিকভাবে সংস্কার করতে হয় যাতে তার বিষাক্ততা অন্তত সহনীয় মাত্রার হয় এবং তার রোগ নিরাময়কারী গুণও উন্নত করা হয়।

এ সমস্যাকে মোকাবেলা করার জন্যে বিজ্ঞানীরা প্রথম যৌগের অনুকরণে লক্ষাধিক সম্ভাব্য রাসায়নিক যৌগ তৈরি করেন এবং বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঔষুধ হিসেবে তাদের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। যৌগ সমূহের ভৌত-রাসায়নিক ধর্ম, তাদের বিপাক পদ্ধতি সহ নানাবিধ খুঁটিনাটি বিষয় এ পর্যায়ে বের করা হয়।

এ পর্যায় থেকে কিছু সম্ভাবনাময় যৌগকে বাছাই করে পরবর্তী ধাপের জন্য মনোনীত করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে ঐ যৌগসমূহকে বিভিন্ন প্রাণীদেহে প্রয়োগ করা হয় যেমন খরগোশ, গিনিপিগ, ইঁদুর ইত্যাদি। এর মাধ্যমে তাদের ঔষুধ হিসেবে কার্যকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা নেওয়া হয়। যেসব যৌগ অতিমাত্রায় ক্ষতিকর অথবা কম কার্যকর তাদেরকে এ পর্যায়ে বাদ দেওয়া হয়।

শুনতে নিষ্ঠুর মনে হলেও, কিছু প্রাণীকে এই যৌগসমূহের উচ্চ মাত্রায় প্রয়োগের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয় শুধু তাদের বিষক্রিয়া নির্ণয়ের জন্য।

এরপর হল সবচে’ গুরুত্বপুর্ণ ধাপ। যৌগসমূহকে মানবদেহে প্রয়োগের পালা; যাকে বলা হয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল।

ইতঃপূর্বেকার ধাপগুলো থেকে বেছে ২-৫টি যৌগকে মানবদেহে প্রয়োগের জন্য নির্বাচিত করা হয়। যাদের ক্রিয়া এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এতটুকু আশ্বস্ত হয়েছেন যে এদের ঔষধ হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে প্রবল।

এটি মূলত তিনটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়-

প্রথম ধাপে যৌগগুলো সামান্য পরিমাণে কয়েকজন সুস্থ স্বেচ্ছাসেবীর দেহে প্রয়োগ করা হয় (সাথে তাদেরকে মোটা অঙ্কের বখশিশও দেওয়া হয়)। এরপর দেহে তাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা হয়। একই সাথে যৌগসমূহ দেহে কিভাবে বিপাকীয় রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবর্তন হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে কোন ক্ষতিকর উপজাত তৈরি হচ্ছে কিনা সেটা লক্ষ্য করা হয়। প্রথম ধাপে মূলত যৌগসমূহ মানবদেহের জন্য নিরাপদ কিনা সেটা দেখা হয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসমূহ নির্ণয় করা হয়।

image 52

দ্বিতীয় ধাপে যৌগগুলোকে বেশ কিছু সংখ্যক অসুস্থ্ রোগীর দেহে প্রয়োগ করা হয় এবং দেখা হয় সেগুলো আসলে রোগ নিরাময়ে কতটা কার্যকরী। তৃতীয় ধাপে উত্তীর্ণ ঔষধসমূহকে এবার আরো বিস্তৃতভাবে হাজারেরও অধিক রোগীর মধ্যে প্রয়োগ করা হয় এবং তাদের সক্রিয়তা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এটিই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপ।

এতগুলো দীর্ঘ পরীক্ষার পরই কেবল একটি অথবা দুটি ঔষধ উত্তীর্ণ হতে পারে এবং তাদেরকে বাজারজাত করা হয়।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি চলে ১০ -১৫ বছর ধরে। আর খরচ হয় ৮০০-১০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এতো দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং বিশাল খরচের কারণে কেবলমাত্র হাতেগোনা কয়েকটি আন্তর্জাতিক ঔষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠানই এই ঔষুধ আবিষ্কারের গবেষণা প্রকল্প হাতে নিতে সক্ষম। তবে আমরা আশা করতে পারি অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশের গবেষণাগার থেকেও নতুন নতুন ঔষুধের আবিষ্কার সম্ভব হবে। হুম, যদি তোমরা চাও…।