| মুসা ইয়াহিয়া |

গত সংখ্যায় আমরা পদার্থবিদ্যায় প্রথম নোবেল নিয়ে জেনেছিলাম। এবারে আমরা একটি ছোট্ট লাফ দিয়ে ১৯০১ থেকে ১৯০৩ সালে চলে যাব।  তবে, আলোচনায় এবারেও পদার্থবিদ্যাই থাকছে। গত বারের সাথে এবারের কিছুটা মিল আছে। গত বার ছিল এক্স-রে। আর এবার হচ্ছে তেজস্ক্রিয়তা। মিলটা এখানেই। সেবার অবশ্য রন্টজেন একাই নোবেল পকেটে পুরেছিলেন। কিন্তু এবার নোবেল তিন জন ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯০১ সালে প্রথম নোবেল পেয়েছেন একজন ব্যক্তি। ১৯০২ সালে পেয়েছেন দুই জন বিজ্ঞানী।  আর, ১৯০৩ সালে এ পুরস্কার পেলেন তিন জন বিজ্ঞানী। একজন একজন করে বাড়ছে। বিকিরণের উপর চুম্বকত্বের প্রভাব নিয়ে গবেষণার সুফল দিয়ে নেদারল্যান্ডের দুই স্বদেশী হেনরি লরেঞ্জ ও পিটার জ্যিম্যান ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

না, ১৯০৪ সালে ৪ জন পাননি, একজনই পেয়েছেন। সেই কিসসা আপাতত ফ্রিজে রাখলাম, কেমন?

কিন্তু ১৯০২ সাল একটু স্পেশাল। প্রথমত, এ বছর নোবেল পেয়েছেন একজন নারীও। শুধু তাই নয়, এটাই আবার প্রথম পারিবারিক নোবেল। আরেক লরেট ,পিয়েরে কুরি যে মেরি কুরিরই স্বামী। উল্লেখ্য, পদার্থিবিদ্যায় নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানীদের মধ্যে মাত্র দুই জন হলেন নারী। আরেক জন হলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী মারিয়া মায়ের। পরমাণুর কক্ষপথের গঠণের বিবরণ দিয়ে আরো দুইজন বিজ্ঞানীর সাথে তিনি ২য় মহিলা হিসেবে ১৯৬৩ সালে নোবেল পকেটে পুরেন। আবার, শুধু ১৯০৩ সালেই নয়, মেরি কুরি ১৯১১ সালে আবারও জেতেন নোবেল পুরস্কার। তবে, এবারে রসায়নে। এবারে আর কাউকে ভাগ বসাতে দেননি। রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম নামক মৌল আবিষ্কার করে একাই জিতে নেন প্রাইজটি।কি জানি! স্বামী বেঁচে থাকলে হয়তো ভাগ বসাতেন। কিন্তু তার আগেই, ১৯০৬ সালে পিয়েরে কুরি পরলোক গমন করেন।

অনেক দূরে চলে এলাম, না? চলো, মূল আলোচনায় প্রবেশ করি।

তবে, আগে তোমাদের একটা প্রশ্ন করে নিই। বল তো, কোন বিক্রিয়ায় কি এমন কোন নতুন মৌলিক পদার্থ উৎপন্ন হতে পারে যা উৎপাদের কোনটিতেই ছিল না? যারা হ্যাঁ বললে, তাদেরকে ধন্যবাদ। আর যারা ‘না’ বললে, তাদেরও ধন্যবাদ। কারণ, এখন তুমিও জানো। কিভাবে হয়? একটু পর বলছি।

আগেই বলেছি, ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন ৩ জন বিজ্ঞানী।  হেনরি বেকেরেল, পিয়েরে কুরি ও মেরি কুরি। নোবেল মনোনয়নের ক্ষেত্রে বেকরেলের অবদান হচ্ছে স্বতঃস্ফুর্ত তেজস্ক্রিয়তার ( spontaneous radioactivity) আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান। আর, কুরি দম্পতি নোবেল পেলেন বিকিরণের উপর চুম্বকত্বের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে।

১৮৯৬ সালে বেকেরেল দেখতে পান যে, ইউরেনিয়াম যৌগের নিকটে রাখা ফটোগ্রাফিক প্লেট কুয়াশাচ্ছন্ন বা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তিনি দেখান যে, ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত বিকিরণের কারণেই ফটোগ্রাফিক প্লেট ঝাপসা হয়েছে। এ ঘটনাকেই বলে তেজস্ক্রিয়তা বা তেজস্ক্রিয় অবক্ষয় (Radioactive Decay)। তিনি আরো দেখান, ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে অবিরত এই বিকিরণ নির্গত হয়। এই বিকিরণ অতি উচ্চ ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন।

পরবর্তীতে ১৮৯৯ সালে বিজ্ঞানী রদারফোর্ড এবং ১৯০০ সালে বিজ্ঞানী ভিলার্ড পরীক্ষা থেকে তিন রকম তেজস্ক্রিয় রশ্মি তথা আলফা, বিটা ও গামা রশ্মির সন্ধান পান। মেরি কুরি পরবর্তীতে আরো গবেষণা করে প্রমাণ করেন যে, তেজস্ক্রিয় মৌল আলফা, বিটা ও গামা -এই তিন ধরণের রশ্মি বিকিরণ করে। আলফা, বিটা বা গামা যে রশ্মিই নির্গত হোক না কেন, আদি মৌলটি সম্পূর্ণ নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি স্থায়ী মৌলে পরিণত হয় ততক্ষণ রূপান্তর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। স্থায়ী মৌল হল, যারা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিঃসরণ করে অন্য মৌলে রূপান্তরিত হয় না। আর, যেসব মৌল নিজের পরিচয় ভুলে গিয়ে অন্য মৌল হয়ে যেতে চায় তারাই হল তেজস্ক্রিয় মৌল। তেজস্ক্রিয়তার উপর মানুষের কোন হাত নেই। এটি চাপ, তাপ বা কোন প্রকার বৈদ্যুতিক বা চৌম্বক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। সাধারণত, ৮২ এর অধিক পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট মৌলসমূহ তেজস্ক্রিয় হয়। যেমন, রেডিয়াম, পোলোনিয়াম, থোরিয়াম, আকটিনিয়াম ইত্যাদি ভারী মৌলগুলো খুবই তেজস্ক্রিয় মৌল।  তবে পর্যায় সারণির নিচের দিকের বেশ কিছু সদস্যও তেজস্ক্রিয় আচরণ করে। যেমন কার্বন-১৪, ক্যালসিয়াম-৪৮; আয়রন-৫৪, ৫৫; জিরকোনিয়াম-৯৪ ইত্যাদি ।

বেকেরেলের আবিষ্কার ১৮৯৭ সালে কুরি দম্পতিকে এই ঘটনার উপর আরো বিস্তর গবেষণার দিকে উৎসাহিত করে। বেকেরেল তো শুধু ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা জেনেছিলেন। কিন্তু কুরি দম্পতি আরো কিছু পদার্থ ও খনিজ নিয়ে গবেষণা করে ১৮৯৮ সালে দেখেন যে, পিচব্লেন্ড বা Uraninite নামক খনিজ ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়। বোঝা গেল, এতে আরো কোন তেজস্ক্রিয় উপাদান আছে। তারা প্রমাণ করলেন যে, এতে ইউরেনিয়াম ছাড়া পোলোনিয়াম (পারমানবিক সংখ্যা-৮৪) ও রেডিয়াম (৮৮) নামক তেজস্ক্রিয় মৌলও আছে। এই দুটি পদার্থই ইউরেনিয়ামের (৯২) চেয়েও বেশি তেজস্ক্রিয়।

বর্তমানে তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। ভূগর্ভস্থ পাইপের গতিপথ ও এতে ছিদ্র হয়ে গেলে তা বের করার জন্য তেজস্ক্রিয়তা কাজে লাগানো হয়। তেজস্ক্রিয়তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হচ্ছে কার্বন-১৪ মৌলের তেজস্ক্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ফসিলের বয়স, এমনকি এভাবে পৃথিবীর বয়স নির্ণয়।

আচ্ছা, পৃথিবীর বয়স কত জানো? এটা হচ্ছে সাড়ে চার বিলিয়ন তথা ৪৫০ কোটির কাছাকাছি। সেনোজোয়িক, মেসোজোয়িক, প্যালিওজোয়িক ইত্যাদি যুগসমূহ পাড়ি দিয়ে কত বছরে আমাদের পৃথিবী আজকের এই অবস্থানে এসেছে তা বের করার পেছনে অবদান আছে তেজস্ক্রিয়তার।

প্রত্যেক জীবিত প্রাণির দেহেই স্বল্প পরিমাণ কার্বন-১৪ মৌল উপস্থিত থাকে। প্রাণী যখন মারা যায়, তখন এতে আর নতুন করে কোন তেজস্ক্রিয় কার্বন যুক্ত হয় না। বরং, ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় ধরে দেহে থাকা তেজস্ক্রিয় কার্বন ক্ষয় হতে থাকে। যে কোন সময়ে দেহে উপস্থিত তেজস্ক্রিয় কার্বনের পরিমাণ থেকে ঐ জীবের মৃত্যকাল বের করা যায়। আরো কত কাজে তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার আছে, তা তোমরা পাঠ্যবইয়ে ইতোমধ্যে বেশ ভালোই পড়েছো, পড়ছো। তাই জানা জিনিস আর বলতে যাচ্ছি না।

তবে, বিদায় নেবার আগে আরেকটু তেজস্ক্রিয়তা ব্যাপন করে যাই, কেমন?

তেজস্ক্রিয়তার ইংরেজি শব্দ হচ্ছে রেডিওএক্টিভিটি (Radioactivity)। অক্সিজেন, অ্যাটম, ইত্যাদি বিজ্ঞানের আরো অনেকগুলো পরিভাষার মতই এই শব্দটির নামকরণও ভুল। ইংরেজি শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো, বেতার কর্মকাণ্ড। যাই হোক, রেডিওএকটিভ শব্দটি শুনলেই মনে হবে যেন এর সাথে জড়িত আছে বেতার তরঙ্গের কোন ব্যাপার। কিন্তু, বাস্তবে রেডিওএকটিভ মৌলদের কোন বেতার তরঙ্গজনিত ব্যাপার নেই। তাহলে তারা কী? সেটা এখন তুমি জানো।

আচ্ছা, একটা মৌলের কি খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই? সে তেজস্ক্রিয় হয় কেন?

তোমরা জানোই, প্রত্যেক পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে নিউট্রন ও প্রোটন (ব্যতিক্রম হাইড্রোজেন-১)। নিউট্রনরা না ধনাত্মক, আর না ঋণাত্মক অর্ত্যাৎ আধানহীন। অন্য দিকে প্রোটনরা কিন্তু ধনাত্মক। তোমরা আরো জানো, সমজাতীয় আধান পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, আর উল্টোভাবে বিপরীতরা হয় একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের খুবই ছোট্ট জায়গায় প্রোটন ও নিউট্রনদের জায়গা করে নিতে হয়।

পরমাণুর নিউক্লিয়াসের এই ধনাত্মক প্রোটনেরা একে অপরের সাথে শত্রুতা করে। কিন্তু এত অনৈক্যের মাঝে তারা নিউক্লিয়াস গড়ে তোলে কি করে? এটা সম্ভব হয় সবচেয়ে শক্তিশালী মৌলিক বল ‘সবল নিউক্লিয় বল’ এর কল্যাণে। এই বলটি অন্য তিন মৌলিক বল তথা মহাকর্ষ, তড়িৎচৌম্বক ও দুর্বল নিউক্লিয় বলের চেয়ে শক্তিশালী হলেও এর পাল্লা সীমিত, মাত্র ১০-১৫ মিটার যা একটি মাঝারি আকারের নিউক্লিয়াসের ব্যাসের সমান। এই নিউক্লিয় বল কোন আধানের (Charge) ধার ধারে না। পরমাণুর কণিকাগুলোকে সে ধর্ম, বর্ণ, আধান নির্বিশেষে এক করে ধরে রাখে। কিন্তু, বেচারা শক্তিশালী হলেও তার রাজ্য খুবই ছোট্ট। ফলে, তার রাজ্যে এসে হানা দেয় অপর মৌলিক বল তড়িৎচৌম্বক বল যার পাল্লা অসীম। এই বল এসে পরমাণুর শান্ত পরিবেশে ভাই ভাই হয়ে থাকা প্রোটনদের মধ্যে বিভেদ ধরিয়ে দেয়, সৃষ্টি করে বিকর্ষণ বল। আমরা কি কুলম্বকে এই বলের সূত্র প্রদানের জন্যে দোষারপ করতে পারি?

এবার ধরো, ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসের কথা। এতে আছে ৯২ খানা প্রোটন। কুলম্ব বল এদের মাঝে যে অনৈক্যের বীজ বুনে দেয়, সবল নিউক্লিয় বলের পক্ষে সেই বীজের অঙ্কুরোদগম ঠেকানো সম্ভব হয় না। ফলে, নিউক্লিয়াস হয়ে ফলে অস্থিতিশীল। আর, এরই ফল এত গণ্ডগোল।

আলফা, বিটা ও গামা কী জিনিস?

আলফা হচ্ছে দুটো প্রোটন ও দুটো নিউট্রন সমন্বয়ে গড়া হিলিয়ামের মত কণিকা। একে α, α2+ দ্বারা He2+ প্রকাশ করা হয়। এতে ইলেকট্রন থাকে না বলে একে বলা যায় হিলিয়াম আয়ন। পরিবেশ থেকে ইলেকট্রন আদায় করতে পারলে একে হিলিয়াম মৌলই বলা যায়।  অন্য দিকে বিটা হচ্ছে একটি ইলেকট্রন কিম্বা তার প্রতিকণা পজিট্রন নির্গমণ। প্রতিকণাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের সব আচরণ মূল কণাদের মত কিন্তু আধান ভিন্ন। যেমন, পজিট্রন (প্রোটন নয় কিন্তু, সাবধান!) হচ্ছে ইলেক্ট্রনের প্রতিকণা।  আর, গামা রশ্মি নির্গমণের অর্থ হচ্ছে নিউক্লিয়াসের শক্তিস্তরের পরিবর্তন।

তেজস্ক্রিয়তার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সভ্যতাকে আরো উন্নত করতে পারে। কিন্তু তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রয়োগের জীবন্ত নমুনা হিসেবে আমাদের সামনে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাপানের হিরোশিমা, নাগাসাকি শহরের ধ্বংসাবশেষ। শুধু মাত্র পরকালে জাহান্নামের আজাবের ভয়ই পারে মানুষকে এ ভয়াবহ প্রক্রিয়ায় নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা থেকে ঠেকিয়ে রাখতে।

আজকে এখানেই থামলাম। পরবর্তীতে হাজির হবো  অন্য কোন নোবেলের খবর নিয়ে, ইনশা-আল্লাহ।