| আহমদ আবদুল্লাহ |

Binder1_page74_image697সহকারী সম্পাদক মেহেদী ভাইয়ার ফোন। বললেন, আমাদের ব্যাপন প্রত্রিকার প্রকাশক মোশারফ স্যারের সাথে দেখা করতে হবে। বেশি ব্যস্ততা নেই। রাজি হয়ে গেলাম। স্যারের সাথে আলাপ শেষ করলাম মাগরিবের একটু আগেই। কাছেই বিজ্ঞান জাদুঘর। প্রতি শনি ও রোববার এখানে সন্ধ্যার পরে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখানো হয়।

বললাম, ভাইয়া, বিজ্ঞান জাদুঘরতো কাছেই। চলেন,আকাশটা দেখে আসি। উনিও রাজি। বললেন,”বের যখন হয়েছিই, একটা কাজ না করে দুইটা কাজ সেরে ফেলি। ব্যাপন ভ্রমণ!” না হেসে পারলাম না। পা বাড়ালাম বিজ্ঞান জাদুঘরের দিকে। তবে, আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ। মেঘলা আকাশে আবার টেলিস্কোপে আকাশ দেখে মজা নেই। তবে, ভরসা হল আকাশে মেঘের আধিপত্য অতটা বেশি না। তাই মেঘ আমাদের ব্যাপন ভ্রমণের উৎসাহে ভাটা দিতে ব্যর্থ হলো।

পৌঁছতে পৌঁছতে আজান পড়ল। জাদুঘরের সামনেই মসজিদ। নামাজটা পড়ে নিলাম। আকাশ দেখানো হয় দুই তলা ভবনের ছাদে। গিয়ে দেখলাম, আমাদের আগেই আরো দশ বারো জন আকাশপ্রেমী হাজিরা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে, টেলিস্কোপও প্রস্তুত করা হয়ে গেছে। বিজ্ঞান জাদুঘরের এই টেলিস্কোপটির ক্ষমতা ৭৭ এক্স। অর্থ্যাৎ, কোন বস্তু যত দূরে অবস্থিত, এই আলোকযন্ত্র দিয়ে তাকে ৭৭ গুণ কাছে দেখা যাবে।

টিকেট কেটে আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেললাম। একটু পরই, টেলিস্কোপের তত্ত্বাবধায়ক যন্ত্রখানা পশ্চিমাকাশের দিকে ঘোরাতে থাকলেন। ভদ্রলোকের মুখে সুবিন্যস্ত দাঁড়ি। টেলিস্কোপে আকাশ নিশানা করতে করতে কথা বলা শুরু করলেন। যেন ক্লাস নিচ্ছেন, এমন ভঙ্গীতে শান্ত স্বরে বললেন, “এখন আমরা যেটা দেখবো, এটা হলো শুক্র গ্রহ (Venus)। সৌরজগতের আট গ্রহের মধ্যে এই গ্রহটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে, এমনকি মঙ্গলের চেয়ে কাছে। এটি সৌরজগতের সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহ। এই গ্রহ আবার ঘোরে পৃথিবীর উল্টো দিকে।”

হাত উল্টিয়ে দেখালেন, “পৃথিবী ঘোরে (নিজ অক্ষের চারপাশে আবর্তন করে) পশ্চিম থেকে পূর্বে। আর, শুক্র গ্রহ ঘোরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। সন্ধ্যার সময় একে দেখা যায় পশ্চিমাকাশে। ভোরের আগেও আবার একে দেখা যায়। তখন এর নাম হয় শুকতারা। আর, এখন এর নাম সন্ধ্যাতারা”

এবার ব্যাখ্যা দিলেন, কেন একেই আগে দেখাবেন, “গ্রহটি ভোরের দিকে ছিল পূবাকাশে। সূর্য উঠার কারণে একে আর দিনে দেখা যায়নি। সারা দিনে এটি আমাদের মাথার উপর দিয়ে সফর করে এখন পশ্চিমাকাশে এসে হাজির হয়েছে। একটু পর দিগন্তের ওপারের হারিয়ে যাবে। তাই, একে সবার আগে দেখে শেষ করতে হবে।”

আমরা দু’ জন দেখবো সবার শেষে। তাই অলস দাঁড়িয়ে না থেকে উনার সাথে টুকটাক আলাপ করতে থাকলাম। জানি, রাতের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা হল লুব্ধক যাকে ইংরেজিতে বলে সিরিয়াস (Sirius)। কিন্তু, এই তারাটি যে আকাশের ঠিক কোন জায়গায় তা আমি জানি না। একেই বলে, গ্রন্থগত বিদ্যা আর… থাক ভাব সম্প্রসারণ পড়ে থাক জমিনেই। জিজ্ঞেস করতে উনি আঙ্গুল তুললেন দক্ষিণ-পশ্চিমাকাশের দিকে। রাতের আকাশে আমরা যত তারা দেখি সবাই মহাকাশবিজ্ঞানের ভাষায় তারকা না হলেও লুব্ধক কিন্তু আসলেই তারকা। শুকতারা বা সন্ধ্যাতারা কিন্তু তারকা নয়।  ভদ্রলোক আরো বললেন, “খালি চোখে শুক্রকে দেখতে এক ফোটা আলোর মত মনে হলেও টেলিস্কোপে মনে হবে যে একটা মোমবাতি জ্বলছে।”

উনার কথার সত্যতা পেলাম টেলিস্কোপে চোখ রেখেই। শুক্রকে পাহাড়ের মত বিশাল দেখবো, এটা আশা না করলেও মনে করেছিলাম হয়তো অন্তত কয়েক ফুট আকারের দেখবো। যাই হোক, এটাতো আর হাবল স্পেইস টেলিস্কোপ না। তাই, আপাতত এতেই খুশি। কয়েকজন ঘুরে এসে আবার দেখে নিলেন।

এবার টেলিস্কোপ ঘোরানো হলো উল্টো দিকে, মানে পূবাকাশে। পূবাকাশে তো প্রতি দিনই একটি উজ্জ্বল ‘তারা’ দেখি। কিন্তু জানি না, ওটা কী? আজ জানলাম। ওটা সৌরজগতের গ্রহদের বড় ভাই বৃহস্পতি। ভদ্রলোক আগের মতই ওটার বর্ণনা দিয়ে গেলেন। এই গ্রহটি হচ্ছে একটি গ্যাস দানব (Gas Giant)। এর উপগ্রহের সংখ্যা  ৬৩ টি । “

উনি আরো জানালেন, “এখন আমরা বৃহস্পতি ও এর তিনটি উপগ্রহ দেখতো পাবো। দুইটি একেবারে গ্রহটির সাথে লাগোয়া-উপরে ও নিচে। আরেকটি কিছুটা উপরে। এগুলো হলো যথাক্রমে  লো, ইউরোপা ও ক্যালিস্টো। আমাদের দেখার সুযোগ আসতে দেরি আছে। এই সুযোগে উনাকে আবারো প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকলাম।

“আচ্ছা, অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আকাশের কোন দিকে থাকে?”

পৃথিবী তথা আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নিকটতম বলে সাধারণ মহলে পরিচিতি থাকলেও অ্যান্ড্রোমিডার অবস্থান পৃথিবী থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে ১৯ নম্বরে। অবশ্য, এর বিশাল আকার (মিল্কিওয়ের আড়াই গুণ) ও তুলনামূলক বেশি উজ্জ্বলতার কারণেই এটি সাধারণ মানুষের কাছে বেশ পরিচিত। এর দূরত্ব অবশ্য পৃথিবী থেকে ২৫ লাখ আলোকবর্ষ। আর আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি হলো ক্যানিস ম্যাজর ডোয়ার্ফ (Canis Major Dwarf)।

অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এটি মিল্কিওয়ের সাথে মহাকর্ষীয় টানে আবদ্ধ। এই আকর্ষণের পরিণতি ঘটবে আজ থেকে চারশো কোটি বছর পর দুই গ্যালাক্সির সংঘর্ষের মাধ্যমে। লাগুগ সংঘর্ষ! তত দিন আমরা বেঁচে থাকবো না, ভয় নেই। আসলে, মরে গেলে অনেক শান্তি তাই না? কোন চিন্তা করতে হয় না। অবশ্য যদি দুনিয়ায় ভালো কাজ করে পরকালের রসদ প্রস্তুত করে রাখি, তবেই থাকা যাবে চিন্তামুক্ত।

অনেক দিন ধরে এই ব্যাটাকে (আসলে কিন্তু অ্যান্ড্রোমিডা শব্দটি এসেছে গ্রিক রূপকথার একটি মেয়ের নামে, তাই তাকে ব্যাটা বলা হয়তো ঠিক নয়) খুঁজছিলাম। কোথায় আছে ব্যাটা (থুক্কু বেটি!)। জিজ্ঞেস করতে ভদ্রলোক অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন উত্তর আকাশে। একে তো একে খালি চোখে ভালো দেখা যায় না, উপরন্তু ছাদের উত্তর দিকে চলছে কন্সট্রাকশনের কাজ। ঐ ছাদেও অনেক আলো। ফলে, উত্তরাকাশের কোন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাই, অ্যান্ড্রোমিডার ছিটেফোটাও চোখে পড়ল না।  নিজের চোখে দেখা না গেলেও, আপাতত ক্যামেরার চোখে দেখে নাও অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে।

অনেক দিন আগে শুনেছি আদম সুরতের কথা। কিন্তু, লজ্জ্বার কথা হলো, এটা আকাশের কোথায় আছে তাও আমি জানতাম না। তাই, উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা স্যার, আদম সুরত কোন দিকে আছে? আর এটাকে ইংরেজিতে কী বলে?”

উনি ইশারা করলেন মাথার উপরের দিকে। কয়েকটি তারকা মিলে একজন মানুষের মত আকৃতি তৈরি করেছে। এরই নাম আদম সুরত। ইংরেজিতে বলে ওরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জ (Orion  constellation)। আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ আছে মোট ৮৮টি। কয়েকটা তারকা পাশাপাশি অবস্থান করে যে আকৃতি তৈরি করে তাই হলো Constellation। তথাকথিত রাশিচক্রের ১২ টি রাশিও এ রকম ১২টি নক্ষত্রপুঞ্জের নামে নেওয়া। যেমন সিংহের মত দেখতে Leo Constellation, কাঁকড়ার মত দেখতে Cancer Constellation ইত্যাদি। তবে, এই আকৃতিগুলোর তেমন কোন বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব নেই। কারণ, যে তারকাগুলো নিয়ে এ রকম চিত্র বানানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর একেকটি পৃথিবী থেকে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত। দূরত্ব পৃথিবী থেকে অনেক দূরে বলেই তাদেরকে একই রেখায় আছে বলে মনে হয়। এগুলোকে ভিত্তি করে পত্রিকায় প্রকাশিত তথাকথিত রাশিচক্রেরও কোনই বৈজ্ঞানিক বা ধর্মীয় ভিত্তি নেই।

পৃথিবীর প্রথম মানব আদমের (আ.) নামে নামাঙ্কিত আদম সুরত দেখতে দেখতে আমার টেলিস্কোপে বৃহস্পতি দেখার সুযোগ চলে এলো। এক চোখ বন্ধ করে আরেক চোখ ফেললাম টেলিস্কোপের লেন্সে। হ্যাঁ, সত্যিই গ্রহরাজ বৃহস্পতি তার সাথে তিনটি উপগ্রহ নিয়ে আমার চোখের সামনে হাজির। উপগ্রহগুলো হলো লো, ইউরোপা ও ক্যালিস্টো। ছবিতে বৃহস্পতি ও ইনসেটে উপগ্রহুগুলো সহ দেখালাম। আমার চোখে তুমি দেখে নাও।

“বৃহস্পতির মাঝে লাল দাগগুলো কিসের?” প্রশ্ন করলাম ভদ্রলোককে। জানালেন, ওগুলো গ্যাস দানব গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের ঝড়ের চিহ্ন। “বৃহস্পতিকে কি সব সময় সন্ধ্যায় পূর্বাকাশে পাবো?” আবারো উনাকে বিরক্ত করলাম। জানালেন, সন্ধ্যার দিকে শুক্র ছাড়া সব গ্রহকেই পূবাকাশে পাওয়া যাবে। কারণ, শুক্র ছাড়া সব গ্রহই আবর্তন করে পশ্চিম থেকে পূর্বে। তাই, সবাই যখন পূবাকাশে, শুক্র তখন পশ্চিমাকাশে।

মনে করেছিলাম, আজই হয়তো লুব্ধকও দেখবো। কিন্তু, না এই দুটোই। আজ আর দেখানো হবে না। ফলে, সৌরজগতেই সফরের ইতি ঘটে গেল। তা না হলে, শিরোনাম দিতে পারতাম, “সৌরজগৎ ছাড়িয়ে” বা “তারকার বাড়িতে দাওয়াত’ ইত্যাদি।

তবে, মেহেদী ভাই টেলিস্কোপ দেখিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। বিমানেও চড়ালেন। পাশেই পুরাতন বিমান বন্দরের জাদুঘর। ২০ টাকা দিয়ে টিকেট নিয়ে ভেতরে গিয়ে আরো ৩০ টাকার টিকেট কিনে চড়ে বসলাম বিমানে। ৩০ টাকায় বিমানে চড়া, কি মজা তাই না? উনাকে পাইলট বানিয়ে আমি বসে পড়লাম কো-পাইলটের সিটে। কিছুক্ষণ ভাব ধরে বসে থেকে ৩০ টাকার হক আদায় করে নেমে পড়লুম।