| এম.এ.সাকিফ |

Binder1_page74_image236

ওয়ার্ল্ড কাপ শুনলেই এদেশের মানুষ বুঝে ক্রিকেট অথবা ফুটবল। ক্রিকেটের তাৎপর্য বাংলাদেশে একটু অন্যরকম; তার কারণ ক্রিকেট অঙ্গনে বাংলাদেশের ভূমিকা, বাংলাদেশের অবস্থান। এই খেলার সাধারণ নিয়ম-কানুন জানেনা এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। যখন কে জিতবে কে হারবে সেই চিন্তায় সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি প্রতিটি বলের দিকে তখন নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানমনস্ক ছেলে-মেয়েদের চিন্তা, “কি দরকার শুধু শুধু কয়েকজন মানুষকে আম্পায়ার রাখার? পুরো কাজটা তো কম্পিউটার একাই নিখুঁতভাবে করতে পারে! কোন কারণে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে বসলে খেলার গাম্ভীর্যই নষ্ট। ইদানিং আবার Decision Review System(DRS) চালু হয়েছে। যার মাধ্যমে কোন আম্পায়ার যদি ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলেন তা পরে আবার পাল্টাতে হয়। তাও আবার ভঙ্গিটা এমন যেন ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছেন!”

ক্রিকেটে তাও খেলার মধ্যে সিদ্ধান্ত বনাম প্রযুক্তির প্রভাব ততটা না যতটা ফুটবলের মধ্যে দর্শকেরা অনুভব করেন। তারপরও বিজ্ঞানের যুগে খেলাধুলায় প্রযুক্তির ব্যবহার হবেনা এটা অবশ্যই মেনে নেয়া যায়না।এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপের নিয়ম কানুন ও প্রযুক্তি নিয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন যদিও নতুন তেমন কোন কিছু যোজন বিয়োজন হয়নি গত বিশ্বকাপের তুলনায়।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ৭ টি করে মোট ১৪ টি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে এবারের বিশ্বকাপ। Field Restrictions এবং powerplay তে যুক্ত হয়েছে নতুন আরেক মাত্রা। তোমরা অনেকেই হয়তো মনে করবে ব্যাটসম্যানদের জন্য এত্তো সুবিধা! 30 yards এর বাইরে সর্বোচ্চ পাঁচ জন ফিল্ডার থাকার নিয়ম পরিবর্তন হয়ে নেমে এসেছে চারে। কিন্তু ওদিকে আবার powerplay সংখ্যা তিন থেকে নেমে এসেছে দুইয়ে। এক ইনিংসে প্রথম পাওয়ারপ্লে প্রথম দশ ওভার আগের মতই, সর্বোচ্চ দুইজন ৩০ গজের বাইরে। আর ৫ ওভারের দ্বিতীয় পাওয়ারপ্লে নেয়া যাবে ৪০ ওভারের আগে যেকোন সময়, সর্বোচ্চ তিনজন ফিল্ডার ৩০ গজের বাইরে।

নতুন প্রজন্মের জন্য সম্ভবতঃ এটাই প্রথম কারণ ১৯৯২ সালের পর এটাই প্রথম বিশ্বকাপ যেখানে প্রতি ইনিংসে দুইবার নতুন বল গ্রহণের সুযোগ থাকছে। এমনকি গত বিশ্বকাপেও ৩৪ ওভার পর নতুন বল নেয়া হতো। প্রতি ইনিংসে দুই দলই একবার করে নতুন বল নেয়ার সুযোগ পাবে। যদি ভালো করে কেউ খেয়াল করে থাকো তাহলে বুঝবে প্রথম দশ ওভার উইকেট পতনের সম্ভাবনা যেমন বেশি থাকে সেজন্য ব্যাটসম্যানদের জন্যেও থাকে পাওয়ার প্লের সুবিধা। এর কারণ হলো, নতুন বল দিয়ে বোলিং করা বোলারদের জন্যে অনেকটাই সুবিধা। অপরদিকে নতুন বল থেকে রান পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে, কারণ ব্যাটে লাগলেই বল দ্রুত মুভ করে।

তাই যখন বোলিং পক্ষ নতুন বল নিবে তখন হয়তো ব্যাটিং পক্ষ পাওয়ারপ্লে নিয়ে নিবে রান বাড়ানোর জন্য। সেই হিসেবে ক্রিকেট আগের চেয়ে অনেক বেশি আকারে মাইন্ড গেইমের রূপ ধারণ করছে দৈনন্দিন। আর ক্রিকেটের হার-জিত যে শুধুমাত্র ভালো খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর করে তা নয়, বরং দলের সঠিক পরিচালনা ও নেতৃত্বের উপরেও নির্ভরশীল।

সবার মনে একটা কৌতুহল সাধারণত থাকেই। সেটা হলো বোলিং স্পিড। একটা বল ডেলিভার করার সাথে সাথেই স্কোরবোর্ডের নিচে লেখা উঠে bowling speed 149.6 kmph. কিন্তু কিভাবে? একটা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করায় উত্তর দিয়েছিল, পিচের সাইড থেকে কোন ক্যামেরা দিয়ে বল ডেলিভার করার মুহূর্ত থেকে ব্যাটে লাগা পর্যন্ত সময় আর দূরত্ব পরিমাপ করে বলে দেয়া যায় কত স্পিড। চিন্তা ভাবনা ভালোই, ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই। তবে আসলে বাস্তবে কি হয়? যে যন্ত্র দিয়ে স্পিড মাপা হয় তা হলো রাডার গান (Radar Gun).  এর একটি রিসিভার এবং একটি ট্রান্সমিটার থাকে। বল থেকে আসা রেডিও ওয়েভ রেকর্ড করা হয় এবং ডপলার ক্রিয়ার তত্ত্ব ব্যবহার করে এই যন্ত্র তৎক্ষণাৎ বোলিং এর স্পিড জানিয়ে দেয়। এই ‘ডপলার ক্রিয়া’ পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম পত্রের এইচ.এস.সির সিলেবাসে আছে, তারই একটা প্রয়োগ বোলিং স্পিড।

এবারের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত ব্যবহার হতে যাচ্ছে L.E.D Zing Bails। এর শুরু হয়েছিল T-Twenty Big Bash আসরে, পরবর্তিতে টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও ব্যবহার করা হয়েছিল এই bails। ষ্ট্যাম্পের সাথে এই bails ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য হলো ষ্ট্যাম্পে কোন কিছু টাচ হয়েছে কিনা তা যাচাই করা। আগে এমন হতো যে, বল ষ্ট্যাম্পে টাচ করার পরেও bail না পড়ার কারণে আউট দেয়া হতোনা। LED bails এর মাহাত্ম হল, লাইট জ্বলে উঠে এটা নিজেই signal দিবে আউট হওয়ার।

DRS (Decision Review System) গত বিশ্বকাপের মত এবারেও থেকে যাচ্ছে। কেউ Review নেয়ার পরেও আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকছে আবার কেউ সাহস করে Review না করায় পরে বুঝছে যে আসলে Review challenge করলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হতো! সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে আম্পায়ারস কল (Umpire’s Call), এই অবস্থায় কোন review পড়লে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই অপরিবর্তিত থাকে। আম্পায়ার যদি সেটাকে আউট ঘোষণা করে তাহলে সেটা আউট আর যদি নট আউট ঘোষণা করে তাহলে নট আউট, যদিও যেকোনটাই সঠিক। এই অবস্থাই অনেকসময় কোন দলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই ক্রিকেটের নিয়ম নীতি, সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই তার উপর আবার আরেক বিতর্ক DRS এর আগমন। L.B.W দেয়ার ক্ষেত্রে নিয়মের পরিবর্তন এক্ষেত্রে একটু পরিবর্তিত হয়েছে যে, ball pitching অর্থাৎ impact হওয়া থেকে wicket পর্যন্ত দূরত্ব ৩ মিটার হলেই হবে যেখানে আগে ২.৫ মিটারের বেশি দূরত্ব থাকলে not out decision দেয়া হতো। আর গতবার ২ বার review এর সুযোগ থাকলেও এবার তা ১ বারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, ইচ্ছে হলো আর সুযোগটা কাজে লাগিয়ে নেয়ার বিলাসিতা ত্যাগ করতে হচ্ছে। একবারই নেয়ার সুযোগ আছে, তাই সিরিয়াসলি না নিলে সুযোগ শেষ। আর review এ সফল হলে তো সুযোগ অপরিবর্তিত থাকছেই।

একটা বড় মজার ব্যাপার হলো নকআউটের ক্ষেত্রে কোন সুপার ওভারের নিয়ম রাখা হয়নি। যার মানে হলো, যদি ফাইনালে দুই দলের মধ্যে খেলা টাই হয় তাহলে দুই দলকেই শেয়ার করতে হবে ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফি!! আর নক আউট পর্বে যদি খেলা টাই হয় তাহলে পয়েন্ট টেবিলের পয়েন্ট বেশি অনুযায়ী হার জিত ঘোষণা হবে আর যদি তাও সমান হয় তাহলে এভারেজ রেট। আর যদি বৃষ্টি বা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কোন খেলা শুরুতে বিঘ্ন ঘটে তাহলে এই খেলা পরিত্যাক্ত ঘোষণা না করে পরের দিন অনুষ্ঠিত হবে। খেলার মাঝে প্রতিকূলতা দেখা দিলে ঐ অবস্থা থেকেই পরের দিন বাকি খেলা চলবে।

প্রায়ই দেখা যায় কোন caught behind এর আপিল করছে বোলিং সাইড। এরপরে slow motion এ যখন তা দেখানো হয় তখন পাশে হার্টের বিট যেরকম wave আকারে measure করা হয় সেরকম wave. এটা আসলে real time snickometer (স্নিকোমিটার), যা এবার থার্ড আম্পায়ার ব্যবহার করতে পারবে। snick মানে noise বা ঝিরঝির শব্দ, ব্যাটিং এর রিপ্লে অন করে বল ব্যাটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কোন সূক্ষ্ম শব্দ হয়েছে কিনা সেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বল ব্যাটে touch করেছে কিনা সেই সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

এবারের ওয়ার্ল্ড কাপের প্রতিটি ম্যাচের মাঠের ভিতরে বিভিন্ন স্থান অন্তত ২৯ টি ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করা হবে, যার মধ্যে আল্ট্রামোশন ক্যামেরা ও স্পাইডার ক্যাম থাকবে ১৩ টি ম্যাচে আর সকল নক আউট ম্যাচে ড্রোন ক্যামেরা থাকবে। আগে দেখা যেত পুরো স্টেডিয়ামের দুইটি প্রান্তে আটকানো weir এর মধ্যে দিয়ে একটি ক্যামেরা যাওয়া আসা করে উপর থেকে ভিডিও রেকর্ড করতে, এই কাজটাই upgrade হয়ে বর্তমানে ড্রোন ক্যামেরার আবির্ভাব।

এইবারের বিশ্বকাপে দল ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রতিটি দলই যেই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়েছে তা হলো পেসার। অস্ট্রেলিয়ার পিচ যে ফাস্ট বোলারদের জন্যেই সৌভাগ্যের সেটা অনেক আগে থেকেই ক্রিকেটাররা মেনে আসছে। তাই সব টিম তাদের দলে বাড়তি পেসার নিয়ে দল ঘোষণা করেছে। এই ধরণের পিচে ব্যাটিং কিংবা বোলিং সবসময়েই সমস্যায় ভূগে আমাদের উপমহাদেশের ক্রিকেটাররা।

বিশ্বকাপের গতবারের বারের সাথে এইবারের সংযোজন বিয়োজন দেখলে, এবার বাংলাদেশ জাতীয় দলের কি পরিবর্তন তাও দেখা যাক।

এবারের বাংলাদেশ দলে নেই আশরাফুল, কিন্তু অপরিবর্তিত রয়েছেন বিশ্বসেরা সাকিব। স্পিনারদের দাপট না থাকায় এবার নেই বাংলাদেশের আব্দুর রাজ্জাক, সোহরাওয়ার্দী শুভ সেখানে যুক্ত হয়েছেন পেসার তাসকিন ও সৌম্য সরকাররা। তবে তাই বলে যে স্পিনার নেই তা নয়। সাকিব তো রয়েছেনই, আরো রয়েছেন আরাফাত সানি, তাইজুল ইসলামরা। বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেনও পরিবর্তন হয়েছে এব্বারের বিশ্বকাপে। যেখানে গত বিশ্বকাপে দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাকিব সেখানে এবার দলের নেতৃত্ব দিবেন গতবার ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ খেলতে না পারা নড়াইল এক্সপ্রেস মাশরাফি মর্তুজা।

ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকে আজও পর্যন্ত পরিবর্তন হয়েছে অনেক নিয়ম কানুনই। প্রতি বিশ্বকাপেই প্রযুক্তিগতভাবে কিছু না কিছু পরিবর্তন আসে। কিন্তু একটি মৌলিক জায়গা রয়ে গেছে অপরিবর্তিত……………… হ্যা, সেই সময়! যখন প্রতিটি সেকেন্ডই উৎকণ্ঠা। কে জিতবে? সেই আবেগ! যখন সব ভুলে যে যার যার জায়গা থেকে জিকির আসগার শুরু করে তার সমর্থক দলের জন্য। জয়ী হওয়ার আনন্দ হয়তো প্রকৃতপক্ষে খেলোয়াড়দের চেয়ে সমর্থকেরাই বেশি অনুভব করে!