l প্রকৌশলী সাব্বির আহমেদ l

গুগল মামাকে তো তোমরা সবাই চেনো। বর্তমান সময়ে নিজের মামাকে না চেনা যতটা অপরাধের তার চাইতে বেশি অপরাধী হয়ে পড়বে যদি গুগল মামাকে না চেনা। আমরা সবাই গুগলকে চিনি এবং আদর করে মামা ডাকি। কারণ এই মামাই তো আমাদের সব তথ্য দিয়ে থাকে।

যেকোনো তথ্যের জন্য আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল হলো এই দানবীয় সার্চ ইঞ্জিন Google। সে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। তবে আমি এবার তোমাদের একটু চমকে দেব। আচ্ছা তোমরা কি জানো, ইন্টারনেট দুনিয়ার অর্ধেকের চেয়েও বেশি তথ্যের খোঁজ গুগল মামার কাছে নেই!

হু। এটাই সত্য। আমরা ইন্টারনেটে যা দেখি তার চাইতেও অনেক বেশি তথ্য আমরা দেখি না। গুগল দিয়েও এগুলো খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। এটাকে ডিপ ওয়েব বা ইন্টারনেটের অন্ধকার অংশ বলা হয়। আজ আমরা সেই বিষয় নিয়েই জানবো।

ইন্টারনেট দুনিয়ার এই তথ্যসম্ভারকে আমরা দুই ভাগে করতে পারি।

১. Surface Web অথবা Visible Web। এটা হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের সেই অংশ, যা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এবং বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

২. Deep Web বা Invisible Web। এটা Surface Web এর উল্টো। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের যে অংশ স্ট্যান্ডার্ড সার্চ ইঞ্জিনে লিপিবদ্ধ করা নেই, সেগুলোই হলো Deep Web এর অন্তর্ভুক্ত।

ডিপ ওয়েবের ছোট একটা অংশকে বলা হয় ডার্ক ওয়েব বা ইন্টারনেটের অন্ধকার দুনিয়া। এটা হলো ইন্টারনেটের সেই অংশ যেখানে তুমি সাধারণ নিয়মে ঢুকতে পারবে না। প্রচলিত ব্রাউজারগুলো সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। সেখানে প্রবেশ করতে হলে তোমাকে বিশেষ সফটওয়্যার ও কনফিগারেশনের সাহায্য নিতে হবে।

আমাদের আজকের আলোচনা ডার্ক ওয়েবকে কেন্দ্র করে। তার আগে একটা তথ্য জেনে নেই, সার্চ ইঞ্জিন কেন ডিপ ওয়েব বা ডার্ক ওয়েবের তথ্য হাজির করতে পারে না? সার্চ ইঞ্জিনগুলো সার্চ করার কাজটি করে থাকে Web Crawler এর মাধ্যমে। Web Crawler কে Web Robot-ও বলা হয়। এটি এক ধরনের প্রোগ্রাম বা স্বয়ংক্রিয় স্ক্রিপ্ট (ইন্টারনেট বট) যা একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www) ব্রাউজ করে।

কোনো একটা ওয়েবসাইট যেন সার্চ ইঞ্জিন খুঁজে না পায় তার জন্য Robot Exclusion protocol  ব্যবহার করা হয়, যেটি বিন Web Crawler-কে সাইটগুলো লিপিবদ্ধ করা বা খুঁজে পাওয়া থেকে বিরত রাখে।

চিত্র: ওয়েব ক্রলার

ডার্ক ওয়েবের সাইটগুলো সার্ফেস ওয়েবের সাইটগুলোর মতো সাধারণ কোনো ডোমেইন (যেমন .com) ব্যবহার করে না। এরা ব্যবহার করে Pseudo বা নকল Top Level Domain। এই ডোমেইনের মধ্যে আছে .bitnet, .csnet, .onion ইত্যাদি। Pseudo Top levelDomain  এর বিশেষত্ব হচ্ছে এটি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড অফিশিয়াল Offcial Domain Name-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে সাধারণ ব্রাউজার দিয়ে এখানে প্রবেশ যায় না। বিশেষ Gateway-র মাধ্যমেই এখানে প্রবেশ করা সম্ভব। ডার্ক ওয়েবের ওয়েব এড্রেসগুলোও বেশ জটিল, যেমন http://zqktlwi4fecvo6ri.onion

সাধারণত পণ্য বেচাকেনা হয় মুদ্রা দিয়ে। যেমন ডলার, টাকা ইউরো ইত্যাদি। কিন্তু ডার্ক নেটে পণ্য কেনাবেচা হয় বিটকয়েন (Bitcoin)-এর মাধ্যমে। বিটকয়েন হলো Peer to peer crypto currency system. বিটকয়েন ব্যবহারের সুবিধা হলো এখানে কারো ব্যক্তিগত পরিচয় জরুরি নয়। একইসাথে কোনো থার্ড পার্টির লেনদেন ট্র্যাক করারও সুযোগ নেই। ফলে Tax ধার্য করারও উপায় নেই। বিটকয়েনের মূল্যমান কিন্তু অনেক বেশি। বর্তমানে ১ বিটকয়েন = ৭৭৩৩ ডলার! বিটকয়েন কী এবং এটা কীভাবে তৈরি ও ব্যবহার হয় তা নিয়ে আগামী কোন সংখ্যায় লিখবো।

কীভাবে সৃষ্টি হলো ডার্ক ওয়েব?

ডার্ক ওয়েব বা ডিপ ওয়েবের জন্ম নিয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। অনেক আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিটি এমন একটি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আসছিল যেখানে তারা খুব গোপনীয়তার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। সামরিক বাহিনী, বিপ্লবী, ব্যবসায়ী, হ্যাকার, এমনকি খোদ প্রশাসনই এমন এক ব্যবস্থা চেয়েছে যেখানে তারা খুব গোপনে, নিরাপদে নিজেদের ভেতর তথ্য আদান প্রদান করতে পারবে।

তুমি যদি ভেবে থাকো অনলাইনে তোমার ওপর কেউ নজরদারি করছে না, তাহলে ভুল করছো। তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি ডাউনলোড-আপলোড নজরে রাখছে তোমার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার। যেকোনো প্রয়োজনে তারা সেই তথ্য সরবরাহ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তাই স্বভাবগত চাহিদার প্রেক্ষিতেই এমন এক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে হয়েছে যেখানে প্রশাসন তদারকি করতে পারবে না। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ডিপ ওয়েব তথা ডার্ক ওয়েবের। যদিও সিকিউরিটি এজেন্সির নজরদারি থেকে বাঁচতে এটির জন্ম, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখানে অপরাধের বেশ বড় একটা শাখা গ্রথিত হয়েছে।

কী আছে এখানে?

কী নেই এখানে? এখানে এমন সব জিনিস আছে, যেটা হয়তো তুমি কল্পনাও করতে পারবেন না। উইকিলিকসের শুরু হয়েছিল ডার্ক ওয়েবেই। এখানে রয়েছে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বহু বিষয়ও।

নিষিদ্ধ এবং কপিরাইট আইনের কারণে সার্ফেস ওয়েবে নেই এমন সব বইয়ের অসাধারণ সংগ্রহ পাবে এখানে। Apel, Miicrosoft-এর বিভিন্ন প্রোডাক্ট স্বল্প দামে কিনতে চাও? সেটাও পাবে ডার্ক ওয়েবে। যেকোনো দেশের অবৈধ পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স যোগার করতে পারবে ডার্ক ওয়েব থেকে। কিনতে পারবে অবৈধ অস্ত্র। এমনকি বোমা-বারুদ তৈরির যাবতীয় টিউটোরিয়ালও পাবে অনেক ওয়েবসাইটে। এখানে প্রোফেশনাল কিলারের মতো প্রফেশনাল হ্যাকারও ভাড়া করা যায়। বোঝাই যাচ্ছে, এটা একদিকে যেমন ভালো, আবার তেমনি মন্দ।

মাদকদ্রব্য বেচাকেনার সবচেয়ে বিখ্যাত অনলাইন ব্ল্যাক মার্কেটটির ডার্ক ওয়েবে যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে। ২০১৩ সালে FBI ওয়েবসাইটটিকে বন্ধ করে দেয় এবং এর প্রতিষ্ঠাতা রস উইলিয়াম উলব্রিচকে গ্রেফতার করে। জানো তারা এই দুই বছরে কত টাকার ব্যবসা করেছে? প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলারের!

এতসব খারাপ জিনিসের ভিড়ে এবার একটা ভালো জিনিসের খবর দেই তোমাদের। বিভিন্ন ধরনের রিসার্চ পেপার ডাউনলোড করতে Sci-Hub  এর কোনো বিকল্প নেই। তোমরা যখন ভবিষ্যতে প্রজেক্ট বা থিসিস নিয়ে কাজ করবে তখন তোমরা এর গুরুত্ব ভালভাবে বুঝতে পারবে। যদি কখনো সার্ফেস ওয়েবে Sci-Hub ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে ডার্ক ওয়েবের http://scihub22266oqcxt.onion/  এই ঠিকানাটা মনে রেখো,কাজে লাগবে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না?

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নিচ্ছে না, নাকি নিতে পারছে না- এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের জানতে হবে কীভাবে এই নেটওয়ার্ক কাজ করে? ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করতে হয় অনিয়ন (onion) নেটওর্য়াকের সাহায্যে। এর Pseudo top level domain হল .onion। এই নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে তোমাকে ব্যবহার করতে হবে একটা বিশেষ ব্রাউজার।

ডার্ক ওয়েবে যদি তুমি তোমার আসল আইডেন্টিটি নিয়ে ঢুকে পড়ো অথবা কোনোভাবে তোমার আইডেন্টিটি ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে ইন্টারপোলের ঝামেলায় পর্যন্ত তোমাকে পড়তে হতে পারে। নিজেদের প্রয়োজনেই কোনো জিনিসের ভালো এবং খারাপ দুটো দিকই জানতে হয়। ভুল পথে পা বাড়ানোর আগে পা-টা সরিয়ে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই জেনে বুঝে কেউ ডার্ক ওয়েবের অন্ধকার দিকে পা বাড়াবে না এই প্রত্যাশায় শেষ করছি।