।কায়েস জামান।

সেতু বলতেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে কোনো নদীর এপার থেকে অপর পাড়ে যাওয়ার রাস্তা কিংবা ব্যস্ততম শহরে এক রাস্তার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া আরেক রাস্তা। যেখান দিয়ে চলাচল করবে চাকাওয়ালা শত শত গাড়ি।

সেতু অনেক রকমের হতে পারে। ঝুলন্ত সেতু, কাঠের সেতু, গাছের সেতু, ট্রাসের সেতু আর গতানুগতিক টাইপের সেতু তো রয়েছেই। কিন্তু যেই পানির ওপর সংযোগের জন্য সেতু নির্মাণ করা হয়, সেই পানির কোনো সেতু হতে পারে কী? পারে। বিচিত্র বিশ্বের এ এক বিচিত্র সংযোজন। পানির তৈরি সেতু! ওয়াটার ব্রিজ। তবে এটা ভাবলে ভুল হবে যে, সেতুটি তৈরিতে কেবল পানি ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত, সেতুর মাধ্যমে জলপথ তৈরি করার কারণে এ সেতুটিকে “পানির সেতু” বলা হয়।

এই তো, মাত্র কিছুদিন আগেই, ঢাকার কাজীপাড়ায় এক বিরল দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল! সেখানে দেখতে পাওয়া যায় শেওড়াপাড়া টু কাজীপাড়া পারাপার হচ্ছে নৌকায়! দেখে মনে হচ্ছে, কোনো নদীতে চলাচল করছে নৌকা, এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে মাঝি খেয়া পারাপার করছে। কবিদের কবিতার মতো এক আনা দু আনা পয়সা নিয়ে খেয়া পারাপার করছে, ব্যাপারটা মূলত এমন কিছু ছিলনা। শেওড়াপাড়া কাজীপাড়া অঞ্চলে হরহামেশাই একটু বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়। তার ওপরে ওই এলাকায় আবার মেট্রোরেলের কাজ চলছে। যে পরিমাণ পানি জমে সেখানে, তাতে অনায়াসেই আসলে নৌকাতেই বৈতরণী পার হওয়া যায়। যাহোক, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হলে পানি জমে যায়, আর তা নতুন কিছু নয়, আর এমন হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয় কিন্তু। তবে আরো একটা জায়গাতে জলাবদ্ধতা আসলেই সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। জায়গাটার নাম মগবাজার ফ্লাইওভার। সবাই তখন ভেবেছিল, এটা হয়তো মগবাজার ওয়াটার ব্রিজ এবং জাহাজ নয় বরং অলৌকিক গাড়িগুলোই পাড় হচ্ছে বুঝি। আসলে ওটা কিন্তু ফ্লাইওভার, সত্যিকার ওয়াটার ব্রিজ নয়।

ফুটপাতের মতো বিশালাকায় রাস্তা, চারপাশে অনেক মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে। কেউ বা অপেক্ষা করছে বেঞ্চিতে বসে, ছোট ছোট বেঞ্চ একটু একটু দূরত্বে। রাস্তার উপরে দাড়িয়ে আছি আমিও আর ছোট বড় জাহাজ আমার পাশে এসে নোঙ্গর করছে, আমাকে নিয়ে কোনো এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। আমরা চোখ বুঝেও হয়তো এমন স্বপ্নই দেখি কখনো অ্যাডভেঞ্চারের উদ্দেশ্যে কিংবা রোমান্সের উদ্দেশ্যে যাবার সময়। আসলেই স্বপ্ন কতো না মধুর হয়। আমাদের জন্য স্বপ্ন হলেও জার্মানদের জন্য এমনটা কিন্তু সত্যি, পুরোদস্তুর বাস্তব এবং অতীব স্বাভাবিক কোন চেনাজানা পরিবেশ।

এদিকে হয়তো আমাদের অনেকেরই কাছে অজানা যে, পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থেই ওয়াটার ব্রিজ আছে। অজানা একটা ব্যতিক্রমী সেতুর কথাই আজ তোমাদের জানবো। হ্যাঁ, ম্যগডেবার্গ ওয়াটার ব্রিজ। জার্মানির ম্যগডেবার্গের অবস্থিত একটি জলসেতু। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলে! তাই তো! জল সেতু! শুধু তাই না, ম্যাগডেবার্গের এই জলসেতু একই সাথে পৃথিবীর দীর্ঘতম জলসেতুও বটে।

তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন আরও সেতু আছে, যেগুলো তৈরি হয়েছে বিভিন্ন খাল বা নদীর মাঝে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তে। ফলে সেতুগুলোর মধ্যে বয়ে চলে কৃত্রিম খাল। আর সেই খালের উপর দিয়ে চলাচল করে নৌকা বা ছোটখাটো জাহাজ। এ ধরনের সেতুগুলোকে সাধারণত জলসেতু, ইংরেজিতে- ‘ওয়াটার ব্রিজ’ বা ‘এক্যুইডাক্ট‘ বলা হয়।

 

                                                                         মানচিত্রে ওয়াটার ব্রিজ

জার্মানির বার্লিন শহরের কাছাকাছি একটি শহর ম্যাগডেবার্গ-এ অবস্থিত বলে এটিকে ম্যাগডেবার্গ ক্যানেল ব্রীজ বা ম্যাগডেবার্গ ওয়াটার ব্রীজ বলে ডাকা হয়। স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন এই ব্রিজ। জার্মানীর পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে এলবে নদীর উপর এই ব্রীজটি অবস্থিত। পুর্ব ও পশ্চিম জার্মানীর দুটি বিখ্যাত খাল হলো এলবে হ্যাভেল খাল ও মিটেলল্যান্ড খাল। এই দুইটি খালের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে সৃষ্টি করে নির্মিত হয়েছে ম্যাগডেবার্গ ওয়াটার ব্রিজ।

অসম্ভব সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন কাঠামো এই সেতুটির। এর মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে জার্মানির রিন নদী থেকে ছুটে আসা অবারিত জলের ধারা। জার্মানির রাজধানী বার্লিন হতে ১০০ মাইল পশ্চিমে, ম্যাগডেবার্গ শহরে অবস্থিত সেতুটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল বার্লিনকে রাইন নদীর সাথে সংযুক্ত করে একটি নদীপথ তৈরি করা।

অসাধারন স্থাপত্যকলার পাশাপাশি এই সেতুটির রয়েছে প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন ইতিহাস। বার্লিনের কাছে ম্যাগডেবার্গে তৈরি করা এ অসাধারণ নালা, কিংবা বলা চলে পানির বিশাল সেতুটি আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যার এক অনন্য নিদর্শন। জার্মানির পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যে মালামাল পরিবহনের সুবিধার জন্যই এটি বানানো হয়। এলবে নদীর ওপর বসানো এ সেতু এলবে হ্যাভেল খালের সঙ্গে মিটেলল্যান্ড খালকে যোগ করেছে। আগে এ দুটি খালের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ভারী মালবোঝাই কার্গো জাহাজগুলোকে ভীষণ বেগ পোহাতে হতো। কারণটা ছিল, এলবে নদীর কিছু কিছু জায়গায় পানির নিচু স্তর,যার দরুন জাহাজগুলোকে ১২ কিলোমিটারের মতো পথ ঘুরে পার হতে হতো। এতে সময় নষ্ট হওয়ার সঙ্গে ঝক্কিও ছিল অনেক। এ ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে এলবে নদীর ওপর ম্যাগডেবার্গ ওয়াটার ব্রিজ বানানোর পরিকল্পনা করা হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় ১৮৭০ সালে, যখন পৃথিবী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে খুব বেশি অগ্রসর হয়ে উঠেনি। কিন্তু জার্মান বিজ্ঞানীরা ছিলেন অনেক সাহসী এবং বিচক্ষণ। আর সেই কারণেই তারা এ ধরনের একটি সেতু নির্মাণের আধুনিক চিন্তার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। তবে পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত অর্থ ও যন্ত্রপাতির অভাবে সেসময় সেতুর কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে জার্মানি কখনো এই ব্রিজের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসেনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই এই সেতু নিয়ে অনেক ধরনের জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় স্থান নির্বাচন থেকে শুরু করে পানি প্রবাহের পরিমাপ, সবকিছুর একটি বিস্তারিত খসড়া তৈরী অবস্থাতেই ছিল জার্মান সরকারের কাছে। অবশেষে ১৯৩০ সালের দিকে পুনরায় এই সেতুর পরিকল্পনা করা হয় এবং এর নির্মাণ কাজে হাত দেওয়া হয়।

 

                                                                  ওয়াটার ব্রিজের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা জাহাজ

 

ক্যানেল ক্রসিং এর একটা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খাল থেকেই এই ওয়াটার ব্রিজ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। আর এই প্রকল্পের কাজ ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় অর্ধেক সময়জুড়েই অব্যাহত ছিল, অর্থাৎ ঠিক ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণেই হঠাৎ করে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। এই সময়টাতে জার্মানির চলমান সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে বার্লিন প্রাচীরের মাধ্যমে জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়াতে সেতুটির কাজ একেবারেই বন্ধ থাকে। তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ১৯৯০ সালের দিকে বার্লিন প্রাচীর ভাঙার মাধ্যমে দুই দেশ এক হয়ে যায়। এরপর জার্মানি তাদের ফেলে রাখা উন্নয়নমূলক কাজগুলো পুনরায় একে একে শুরু করতে থাকে। কাজগুলোর মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিল জার্মানির পানিব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন। আর সেই পথ ধরেই ম্যাগডেবার্গ ব্রিজের পরিকল্পনা আবার নতুন করে হালে পানি পায়। ১৯৯৭ সালে আবার নতুন করে জলের সেতুটির কাজ শুরু হয়। ছয় বছর ধরে চলে বিশাল এ সেতু তৈরির কাজ, ২০০৩ সালে সবার জন্য উন্মুক্ত করার পর এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় যান চলাচলকারী সেতুর খেতাব পায়। এখন ম্যাগডেবার্গ ওয়াটার ব্রিজটি বার্লিনের অভ্যন্তরীণ পোর্টের সঙ্গে রাইন নদীর পাশে থাকা বন্দরগুলোর যোগসূত্র স্থাপন করেছে।

নদী থেকে পানি বয়ে এনে শহরে সরবরাহের জন্য নালার প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকে। তবে যান চলাচলের জন্য এ ধরনের জলের সেতুর ব্যবহার শুরু হয় সপ্তদশ শতকে। ১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের লয়ের নদীর ওপর তৈরি করা ৬৬২ মিটার লম্বা জলের সেতুটি ছিল যান চলাচলকারী সবচেয়ে লম্বা নালা। তবে ম্যাগডেবার্গ ওয়াটার ব্রিজটি তৈরি হওয়ার পর সেটির কপালেই জোটে নৌযান চলাচল করা জলবহনকারী সবচেয়ে লম্বা সেতুর তকমা। প্রায় ৭৫ মিনিটের মতো মোশ্যান পিকচার “হ্যানা”তে এই ব্রিজটি ফিচার করা হয়েছিল। চলচ্চিত্র “ভাইট্যাও দ্যা কং”-এ ও ফিচারড হয়েছিল এই ম্যাগডেবার্গ ওয়াটার ব্রিজ।

 

ম্যাগডেবার্গ ব্রিজ লম্বায় ৯১৮ মিটার, ৩৪ মিটার প্রস্থ এবং উচ্চতায় ৬৯০ মিটার। এই সেতুর মধ্যে যে কৃত্রিম খাল রয়েছে তা ৩৪ মিটার লম্বা এবং ৪.২৫ মিটার গভীর, অর্থাৎ ১৩.৯ ফুট গভীর পানি থাকে যার দরুন বড় বড় জাহাজগুলো সহজেই চলাচল করতে পারে। মোট ৯১৮ মিটার এই জল সেতুর ৬৯০ মিটারই ভূমি তথা মাটির উপরে আর বাকি ২২৮ মিটার পানির উপর। এই সেতুর সব থেকে দীর্ঘ স্প্যানটি হচ্ছে ১০৬ মিটার তথা ঠিক ৩৪৮ ফুটের। যার ক্লিয়ারেন্স ৯০* ৬.২৫ মিটার। মোট ছয় বছর এবং আর্থিক হিসাবে পুরো ৫০ কোটি ইউরো বা ৫০১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে এই ম্যাগডেবার্গ জলসেতু নির্মাণে। এই সেতুটি তৈরি করতে প্রয়োজন হয়েছিলো ২৪ হাজার মেট্রিক টন স্টীল ও ৬৮ হাজার ঘনমিটার কংক্রিট। সেতু ছাড়াও একটি ডাবল লক নির্মাণ করা হয়েছিল যাতে, সেতু এবং মিটেলল্যান্ড খালের স্তর থেকে এলবে হ্যাভেল খালের তলদেশে জাহাজগুলো অবতরণ করতে পারে। এটি মূলত গার্ডার ব্রীজ টাইপ। মূল সেতুটি ৩ টি স্প্যানের ষ্টীলবিম ও ২ টি বহির্গত স্টীল গার্ডারের সমন্বয়ে গড়া।

 

                                                     ওয়াটার ব্রিজের পাশের ফুটপাথ

জাহাজ কিংবা বারজ (নদী কিংবা পোতাশ্রয়ে জাহাজে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা) এর ট্রাফিক এড়ানোর জন্যই কি এই ব্রিজের ডিজাইন তৈরী হয়েছিল? আবার জাহাজের অতিরিক্ত ওজন সহ্য করতে গেলে এই জলসেতুর পরিণামও বা কি হবে? নাকি শুধুই পানির ওজন সহ্য করছে এই জলসেতুটি?

জলসেতুটি কি পরিমাণ চাপ অনুভব করবে সেটা সম্পূর্ণই নির্ভর করবে পানির গভীরতার উপর। পানির চাপ (সেতু দ্বারা অনুভূত পানির চাপ), পানির ঘনত্ব, মাধ্যাকর্ষণের গতিবেগ, জল গভীরতা ইত্যাদি নানান রকমের বিষয়ও ব্রিজের সত্যিকার সক্ষমতা কতটুকু তা বোঝাতে সহায়তা করে। প্রকৃতপক্ষে, জলসেতুটি কি পরিমাণ চাপ অনুভব করে তা এই বিষয়গুলোর সমন্বিত প্রভাবের সমানুপাতিক। নিচের দিকে কি পরিমাণ বল প্রায়োগিকভাবে কাজ করছে তা তলদেশের পুরো ভূমিক্ষেত্রের নিম্নদেশে অনুভূত চাপের সমান (কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠতা জড়িত নয়, এটি ধরে নিয়ে যে সেতুর নিচ থেকে একটি মহাকর্ষের বল দিক পরিবর্তন করে সমতল পৃষ্ঠে আনুভূমিকভাবে কাজ করে)।

 

                                                          নিচ থেকে ব্রিজের গঠন

এই ধরুন, আপনার কাছে এক কাপ পানি আছে। আর আপনি ঐ পানির মধ্যে একটা ছোট ভারি পিংপং বল ছেড়ে দেন। এতে এই পিংপং বলটি যে ভলিউম অর্জন করবে, তা আসলে ঐ পানির গভীরতার সাথে মিলিয়ে যায়, হয়তো অসামঞ্জস্যপূর্ন অতিরিক্ত কিছু হয়ে যোগ হয়ে যায়। আর সে অনুযায়ীই গ্লাসের নিম্নভাগে চাপের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান থাকে। অনুরূপভাবে, একটি নৌকা ভূপৃষ্ঠের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসমান থাকে, তখন তা সেতুতে জলের স্তরের যোগফলের গভীরতাতে মিলিয়ে যায় এবং সেতুতে চাপ (আর্কফোর্স) বৃদ্ধি করে। আর এই বর্ধিত চাপই সেতু অনুভব করে। কিন্তু এখন যেহেতু আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ম্যাগডেবার্গ জলসেতু, সেদিকেই ফিরে যাওয়া যাক। আমাদের কাপ অথবা গ্লাস যার ভেতরে আমরা পিংপং বল ডুবিয়েছিলাম, অনেক বিশাল জলরাশিতে নৌকাও ঠিক ওই বলের মতো, এর মানে দাঁড়ালো এই যে, এই নৌকা অথবা জাহাজের প্রভাব ওই জলের গভীরতার তুলনায় অতীব নগন্য। তাত্ত্বিকভাবে এভাবেই বেশির ভাগ ইন্জিনিয়াররা এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন। কোনো জাহাজ তার সমপরিমান ভরের পানিকে সরিয়ে জায়গা দখল করেই তো ভাসবে। আর এ কারণে বড় বড় জাহাজ ভাসছে, কিন্তু জলসেতুর কোন ক্ষতিই হচ্ছে না। যৌক্তিকতা বিচারে এই সেতুতে জলের পরিমাণ রাখা হয়েছে অনেকটাই ধ্রুব। যে কারণে অপ্রাকৃতিক গতিশীলতার জন্য জলযান ডুবেও যায় না।

 

                                                                                  ব্রিজের কাঠামোর গঠন

মোটরগাড়ি, ট্রেন কিংবা অন্যান্য স্থলযানের জন্য নয়; মুলত লঞ্চ, স্টিমার, বানিজ্যিক জাহাজসহ অন্যান্য জলযান চলাচলের জন্য এই সেতুটি তৈরি করা হয়। এলবে নদীর উপর স্প্যান বসানো এই ম্যাগডেবার্গ ব্রিজটি নদীসহ বেশ কয়েকটি খাল, বিশেষ করে ইউরোপের বৃহৎ খালগুলোকেও যুক্ত করেছে। পশ্চিমে মিটেলল্যান্ড খাল আর পূর্বদিকে হ্যাভেল খালকে যুক্ত করেছে এই ব্রিজ। আর এজন্যই বড় বড় বাণিজ্যিক জাহাজগুলো রাইনল্যান্ড ও জার্মানির মাঝামাঝি কোনো জায়গায় না থামিয়েই চলাচল করতে পারে আর এলবেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। শুধু খাল দুটোই নয়। এর দ্বারা যুক্ত হয়েছে পুর্ব ও পশ্চিম জার্মানীও।

ম্যগডেবার্গের এই জলসেতুর জন্য প্রত্যেকটা স্টেশনের গড় হিসেবে যাত্রীদের কমপক্ষে ১২ কিলোমিটারের যাত্রা কষ্ট কমে যায়। পৃথিবীতে বলা চলে মাটির উপরে জাহাজে চড়ে সবচেয়ে দীর্ঘ নৌযাত্রা উপভোগ করা যাবে শুধুমাত্র এই ম্যাগডেবার্গ জলসেতুতেই। বানিজ্যিক জাহাজগুলো এখন খুব সহজেই ১২ কিলোমিটার পথ কম অতিক্রম করেই রাইন নদীতে ও বার্লিন বন্দরে পৌছুতে পারে।

তবে বর্তমানে সেতুটি বাণিজ্যিক গুরুত্বের পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেও অবদান রাখছে। এই সেতুতে স্থলযান চলাচলের জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও রয়েছে প্রশস্ত ফুটপাথ। ব্যাতিক্রমধর্মী সেতু হওয়ার কারণে নজর কেড়েছে পর্যটকদেরও। প্রতিদিন শত শত পর্যটক ভীড় জমায় এই জলসেতুটি দেখার জন্য। আপনিও চাইলে সময় সুযোগ করে দেখে আসতে পারেন অসাধারণ এই স্থাপত্যকলা।

ঠিক যেমন বলা। হয়তো- এমন স্বপ্ন আমাদের আর দেখতে হবেনা, নিকট ভবিষ্যতে হয়তো বাংলাদেশেই এরকম ওয়াটার ব্রিজের দেখা মিলবে। সেইদিন হয়তো আর খুব দূরে নয়, যেদিন মগবাজার ফ্লাইওভারকে কল্পনার ওয়াটার ব্রিজ হিসেবে মনোরাজ্যে আঁকতে হবে না। সেদিন আসলেই খুব কাছে হয়তো, যেদিন আর মিরপুর রোডে কাজীপাড়া টু শেওড়াপাড়া জলাবদ্ধতায় জনদূর্ভোগে নৌকা পারাপার করতে হবে না। হয়তো, খুব শিগগিরই নদীমাতৃক বাংলাদেশ নদী ছাড়াও ওয়াটার ব্রিজ ব্যবহার করবে নৌকা আর ছোটখাটো জাহাজ পারাপারে। যা বাংলাদেশের বাণিজ্যে অবদান রেখে এই দেশকে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে নিয়ে যাবে।