|মাবরুর আহমাদ নাকীব|

 

আলোক পিদিম বন্ধুরা, তোমরা বোধহয় জানো- বিশ্বজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পানি। কিন্তু উৎসাহী মন যদি প্রশ্ন করে, তারপর? উত্তরটা বোধহয় হবে; আলো। আলোর কারণেই আমরা অনুধাবন করতে পারি আমাদের চরাচর এবং টিকে থাকার গতিপ্রকৃতি। আর আলোর পরিপূরক কোন কিছুই হতে পারে না। 

 

আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো, আমরা আমাদের চোখ দিয়ে যতখানি না আলোকে সনাক্ত করতে পারি— আলোর কার্যক্রম এবং কার্যকারিতা তার চেয়েও বহুগুণ বিস্তৃত৷ আলোর ৯০ শতাংশই আমাদের দৃষ্টিগোচর না হলেও- সেই আলোর উপর নির্ভর করে আমাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। প্রকৃতি রক্ষা পাচ্ছে ভারসাম্যহীন হওয়া থেকে। এবার একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে মনোযোগ প্রয়োগ করো কিন্তু। অদৃশ্য আলো ইনফ্রারেডের সাথে পরিচয় পর্ব সারতে হবে যে।

 

কোন আলো দৃষ্টিগোচর হওয়ার যোগ্যতা নির্ভর করে তার কম্পাঙ্কের উপর। আর দৃশ্যমান আলোর কম্পাঙ্ক হলো ১০১৪ hz. বর্ণালিতে বেগুনী আলোর কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশি। সে মাত্রা নামতে নামতে লাল আলোতে এসে ঠেকে। অর্থাৎ লালের কম্পাঙ্ক দৃশ্যমান আলোদের মধ্যে সবচেয়ে কম। সে মোতাবেক, যে আলোর কম্পাঙ্ক লালের চেয়েও কম— তাই অবলোহিত আলো হিসেবে পরিচিত। ইংরেজিতে যা Infra ও Red নামে দুটি ভিন্ন শব্দের মিশ্রণে infrared হয়েছে।

 

ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ইনফ্রারেড রশ্মির ব্যবহার একটি সাধারণ এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রিমোট ডিভাইস, এক্সরে মেশিন, নাইটভিশন ক্যামেরার মতো অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রে ইনফ্রারেড রশ্মিকে প্রাণ বলা চলে। যার গুণাবলীর উপর নির্ভর করে যন্ত্রগুলো নির্দিষ্ট কাজ সমাধা করতে পারে। 

 

বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্শেল ১৮০০ সালের দিকে- নিউটনের দেখানো পদ্ধতি প্রিজমের মাধ্যমে সূর্যরশ্মিকে রঙের সাপেক্ষে আলাদা আলাদা করতে সক্ষম হন। এবং থার্মোমিটার দিয়ে তাদের তাপমাত্রা বৃদ্ধির আনুপাতিক হারকে বিশ্লেষণ করে খেয়াল করেন— লাল আলোর পরে অন্ধকার স্থানেও থার্মোমিটারের পারদ উর্ব্ধমুখী আচরণ করছে। আর তা অনুধাবন করে হার্শেল ধারণা দেন— সেখানে হয়তো এমন কোন আলো আছে, যা দৃষ্টিগোচর হয় না!

সে হতে এই রশ্মি নানান পর্যায় অতিক্রান্ত করে— আজকে ইনফ্রারেড রশ্মি হিসেবে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক অস্ত্র নির্মাণ যার অন্যতম ক্ষেত্র।

 

ইনফ্রারেড রশ্মি তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ৩ GHz থেকে ৪০০ THz অব্ধি হয়। আর ১ গিগাহার্জ (GHz) হলো— প্রতি সেকেন্ডে কোনকিছুর ১ কোটিবার কম্পন এবং টেরাহার্জ (THz) হলো— একশো কোটিবার ইলেক্টোম্যাগনেটিক কম্পন। যা ইনফ্রারেড, দৃশ্যমান, এবং অতিবেগুনী রশ্মি কম্পাঙ্কের সূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

ইনফ্রারেডের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিস্তৃত হয়— ৩০ সেন্টিমিটার (১ সেন্টিমিটার= ১ মিটারের একশো ভাগের একভাগ) থেকে ৭৪০ ন্যানোমিটার ( ১ ন্যানোমিটার= ১ মিটারের একশো কোটি ভাগের একভাগ)। 

 

                                                                 বিভিন্ন রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিস্তৃতি

 

স্বাভাবিকভাবেই কোন তরঙ্গের ক্ষেত্রে কম্পাঙ্ক কমার অর্থ দাঁড়ায়- তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে। যার ফলে তুলনামূলক দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ইনফ্রারেড আলো- খুব বেশি শক্তি সঞ্চিত রাখতে পারে না। তাই আমাদের চোখের রেটিনা তা ধরতে সক্ষম হয় না।

 

জেনে রাখা ভালো, সকল উত্তপ্ত বস্তুই আলো বিকিরণের উৎস। তা কোন তারকাই হোক কিবা ৯৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বহনকারী মানবদেহ। কিন্তু সে আলোর কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলোর সীমার বাহিরে হলে— তা অদেখাই থেকে যায়। 

 

পিকিউলার ব্যাপার হলো— যখন কোন বস্তু হতে বিচ্ছুরিত আলো (হোক ইনফ্রারেড কিবা সাধারণ) আমাদের দৃষ্টির সাথে মিশে যায়— তখনই ওই বস্তুটা আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয় এবং তা ঠিক ওরকমভাবে, যেমনি থাকা অবস্থায় বস্তু হতে আলো বিক্ষিপ্ত হয়েছিল। যেমন, পৃথিবীতে সূর্যের আলো এসে পৌঁছাতে সময় লাগে ৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ড। অর্থাৎ ৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ড আগে সূর্য হতে নিক্ষিপ্ত পুরনো আলো আমাদের পৃথিবীকে স্পর্শ করে। এরই মধ্যে একই মুহূর্তে সূর্যের অভ্যন্তরে আলোর কোন পরিবর্তন ঘটলে, আমরা তা ৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ড পর টের পাবো। 

 

আরেকটু খোলাসাভাবে বলতে গেলে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ভূখণ্ড থেকে যে আলোর বিকিরণ হয়েছে— সৌরজগতের যদি এমন কোন অন্য গ্রহ থেকে থাকে, যেখানে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে এবং সেখানে পৃথিবী থেকে আলো পৌঁছাতে ৪৭ বছর লাগে— তাহলে তারা আমাদের দেশের দিকে এমূহুর্তে তাকালে, সরাসরি সেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হতে দেখবে!

 

কি মাথা গুলাচ্ছে? বিশ্বাস হতে চাইছে না? ভাবছো এটা কিভাবে সম্ভব? বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটেভিটির বিশ্লেষণ জানলে ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে। বুঝতে পারবে বিজ্ঞান কতটা মজার অথচ ভয়ংকর জটিল সমীকরণে ভরপুর। আর সব জটিলতার জিঞ্জির কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কই ভেঙেছে! 

 

আচ্ছা, বিজ্ঞানীরা তো শুধুমাত্র আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা ব্যাপারগুলো আবিষ্কার করছেন মাত্র। তাদের কৃতিত্ব কেবল মহাবিশ্বের কাণ্ডকারখানা দেখে দেখে তথ্য সংগ্রহ করা পর্যন্ত। কিন্তু যিনি এই পুরো বিশ্বজগত সৃষ্টি করছেন এবং তার প্রতিপালক— তিনি কতটা মহাপরাক্রমশালী এবং মহাজ্ঞানী ভাবতে পারো? এজন্য তিনি মহাগ্রন্থে বারবার বলেছেন, “আর এতে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন”।

 

এই দেখো দেখি! কোথা থেকে কই চলে এলাম। আসলে বিজ্ঞানের ব্যাপারগুলো একে অপরের সাথে অদ্ভুতভাবে সংযুক্ত হওয়াতে, উদাহরণ হিসেবে অনেক কথা টেনে আনতে হয়। সে যাকগে, আমরা বলছিলাম কম্পন ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচারে ইনফ্রারেড রশ্মির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে। আসলে, তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রসারণ কিবা সঙ্কোচন বস্তুর তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। আবার বস্তু হতে বিচ্ছুরিত আলোর ধরণ কিরূপ হবে, তাও নির্ধারণ করে দেয় তাপমাত্রা। প্রচণ্ড উত্তপ্ত সূর্যের তাপমাত্রা ৯৯,৪০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য 0.৪-0.৭ মাইক্রন (১ মাইক্রন= ১ মিটারের দশ লক্ষ ভাগের একভাগ)। আর আমাদের শরীর নিঃসৃত করে ১০ মাইক্রনের ইনফ্রারেড রশ্মি! 

 

তাপ সঞ্চালনের তিন পদ্ধতি— পরিবহন, পরিচলন এবং বিকিরণের মধ্যে, বিকিরণের মাধ্যম হিসেবে ইনফ্রারেড রশ্মি কাজ করে থাকে। আর তাপ ইনফ্রারেড আকারে নির্গত হওয়ার শর্ত হলো, কোনকিছুর তাপমাত্রা কমপক্ষে -২৭৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে হবে। 

 

সূর্যরশ্মির অধিকাংশ শক্তিই ইনফ্রারেড আলো এবং দৃশ্যমান আলোর একটি পেল্লায় অংশ সূর্যের বুকে ইনফ্রারেড হিসেবে প্রক্রিয়াজাত হয়। তেমনি, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত ইলেকট্রিক বাল্বের ৯০ শতাংশ আলোই ইনফ্রারেড এবং অদৃশ্য। যা তাপ হিসেবে বাল্ব হতে বিক্ষিপ্ত হয়। তাছাড়া, বিভিন্ন আলোর উৎস থেকে দৃশ্যমান আলো নির্গত হলেও, সিংহভাগ আলোই থেকে যায় ইনফ্রারেড আকারে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইনফ্রারেড আলোটুকুই নির্গত হয়। সরাসরি আলোকছটা নিক্ষিপ্ত হয় না। রিমোট কন্ট্রোলিং সিস্টেম ও এলইডি (Light Emitted Diode) ব্যবহৃত যন্ত্র তারমধ্যে অন্যতম। সে সূত্র ধরে বলা যায়, তাপ আলোর একটি অংশ বা আলো তাপ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সাথে সম্পর্কযুক্ত।

 

সাধারণ ধারণা হিসেবে কথাগুলো মাথার ভিতর চালাচালি করতে থাকো। দেখবে অনেকগুলো নতুন চিন্তা, নতুন প্রশ্ন গজিয়ে উঠছে ধীরেধীরে। আর প্রশ্নের উদ্ভব হয়, উত্তর সৃষ্টির জন্য কিবা উত্তর বিশ্লেষণের জন্য। সুচিন্তা মানুষের মস্তিষ্ককে জ্ঞানের খোরাক জোগায়। নূতন নূতন চিন্তা সংগ্রহের জন্য কিন্তু খুব পড়াশোনা করতে হবে। মনে রাখবে- Read, Read and Read

 

নভেম্বর-ডিসেম্বর।বর্ষ ৪।সংখ্যা ৪