।মোঃ মোখলেছুর রহমান।

পর্ব ৩

শুরু করার আগে গত সংখ্যার কিছু ঘটনা একটু মনে করে দেখো। ঝিঝি পোঁকার আত্মহত্যা, পিপীলিকার অপমৃত্যু, সামুদ্রিক মাছের জিহ্বা হারিয়ে যাওয়া, মাশরুমের বংশবৃদ্ধি, ইঁদুর বিড়ালের বন্ধুত্ব, ব্যাঙের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সব কিছুই কেমন মনে হয়েছে তাই না!

আপনার প্রিয় ব্যাপন ম্যাগাজিন কিনতে এখানে ক্লিক করুন

কিন্তু যারা মস্তিষ্ক দখল করছে তাদের কথা চিন্তা করলে কি মনে হয়? তাদের তো বংশবৃদ্ধি করতে হয়। এসব পরজীবী প্রকৃতির অংশ, তাই না? তবে তাদের কার্যক্ষমতা আমাদেরকে তাক লাগিয়ে দেয়।

একজন অন্ধ মানুষের কথা চিন্তা করো, তার শ্রবণ-শক্তি কত প্রখর? তার চলাফেরা দেখে বুঝা যায়। চোখ বন্ধ করো তো। কেমন এই অনুভুতি? কেমন মনে হয়? যাইহোক, এই মহাবিশ্ব এমন একজন আছেন যিনি এসব কিছু ভারসাম্যপূর্ণ করে তৈরি করেছেন। ছোটবেলায় নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘কাজের লোক’ কবিতায় পড়েছি-

মৌমাছি মৌমাছি

কোথা যাও নাচি নাচি,

দাঁড়াও না একবার ভাই…।

চিত্র-১ঃ ফুল সংগ্রহে তৎপর মৌমাছি

আজ এই মৌমাছির গল্প বলি। ছোটবেলা থেকে আমার মৌমাছি নিয়ে কিছু ভয় কাজ করতো। ভয়ের যথার্থ কারণ ছিল। আমি ছোটবেলায় ৭-১০ বার মৌমাছির কামড় খেয়েছিলাম। যদিও এর জন্য আমি নিজেই দায়ী ছিলাম। যাইহোক, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ঢাকায় আসি। আমাদের বাসার পাশে একটি বড় আমগাছ ছিলো। আম গাছের মধ্যে মৌমাছির মৌচাক।

প্রথমে আমি ভয় পেয়েছিলাম। আবার কি তাহলে মৌমাছির কামড়? কিন্তু না। দেখলাম ঢাকা শহরের মৌমাছিগুলো অনেক ভদ্র। তারা কামড় দেয় না। কিছুদিন পর স্বাভাবিক লাগতো। দেখতাম আমাদের রুমে মৌমাছি আসতো কিন্তু কাউকে কামড়ে দিতো না। একটা বিষয়ে আমার কষ্ট লাগতো। প্রায় প্রতিদিন সকাল বেলা কিছু মরা মৌমাছি রুমে পড়ে থাকতো।

প্রথম দিকে কিছুটা ভাল লাগছিলো। কারণ আমি মৌমাছি ভয় পেতাম। কিন্তু নিয়মিত দেখলে কার মন ভাল থাকে বলো! ঐ সময় আমি খোঁজ করে দেখি রুমের বাল্বের নিচে বেশির ভাগ মরে পরে থাকতো। তখন মনে করতাম বৈদ্যুতিক বাল্বই মূল সমস্যা। যদিও পরে এগুলি নিয়ে আর ভাবতাম না। তবে আজ তোমাদের এর মূল কারণগুলো বলার চেষ্টা করবো।

মাছি সহ কিছু কিছু কীট তাদের ডিম ফুলের মধ্যে রেখে দেয়। কিছু মাছি মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যেও ডিম ছড়িয়ে রাখতে পটু। মৌমাছি মধু সংগ্রহের সময় এই ডিম খেয়ে ফেলে। ডিম মৌমাছির পেটে থেকে যায়। ডিম থেকে রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। মৌমাছির একটি নির্দিষ্ট অংশে আটকিয়ে থাকে।

সেখানে একটি বিষফোঁড়া তৈরি হয়। ডিম মৌমাছি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করতে থাকে। ডিম লার্ভাতে পরিণত হয়। লার্ভা আরো বেশি রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে। ফলে মৌমাছি তাদের কলোনি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। লার্ভা আস্তে আস্তে মৌমাছির মস্তিষ্ক দখল করে নেয়।

লার্ভা মৌমাছির শরীর থেকে পূর্ণ মাত্রায় পুষ্টি গ্রহণ করে। লার্ভার সুবিধা অনুযায়ী মৌমাছি চলাচল করে। মৌমাছিকে মধু সংগ্রহ থেকে বিরত রাখে। লার্ভার পরিপূর্ণতা লাভ করে। মৌমাছির শরীর থেকে বের হওয়ার জন্য অধিক আলোর প্রয়োজন হয়। এজন্য মৌমাছিকে অধিক আলোতে নিয়ে আসে। এবং মৌমাছিকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়।

 চিত্র-২ঃ মৌমাছির শরীরে বিষফোঁড়া থেকে লার্ভার জন্মগ্রহণ

পরিশেষে মৌমাছির শরীর থেকে লার্ভা বের হয়। কি রকম লোমহর্ষক ঘটনা! তাই না? এখন তাহলে মৌমাছি  বৈদ্যুতিক বাল্বের দিকে ঝুঁকে কেন? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল নিশ্চয়ই।  

অলস ঘাসফড়িং আর কর্মী পিঁপড়ার গল্প সকলের জানা আছে। মাঝে মাঝে এই অলস ঘাসফড়িং নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনে। করডাইসেপ্স জেনাস (Cordyceps Genus) গ্রুপের মাশরুমগুলো কিছু মৃত্যু ফাঁদ তৈরী করে। এই ফাঁদের বলি হয় কিছু কীটপতঙ্গ। তার মধ্যে ঘাসফড়িং অন্যতম।

এ জাতীয় মাশরুম প্রায় ১ কোটি বছর পূর্ব থেকে একজাতীয় ব্যক্টেরিয়ার সাথে কলোনি করে বেঁচে আছে। এজন্য এদের প্রোটিন প্রয়োজন হয়। তাই এরা বংশক্রম ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রাণীকে বেছে নেয়। স্পোরের সাথে ব্যক্টেরিয়ার জিনের অনুলিপি যুক্ত থাকে। বাতাসের মাধ্যমে আশেপাশের যথাপোযুক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের বাকল, কাণ্ডে বা পাতায় ছড়িয়ে রাখে।

চিত্র-৩ঃ ঘাসফড়িং এর পেট থেকে অঙ্কুরিত ব্যাঙের ছাতা

এই স্পোরগুলো কিছু ব্যক্টেরিয়ার সাহায্যে আস্তে আস্তে উদ্ভিদের বাকল, কান্ডে বা পাতায় বলের মত তৈরি করে। তা সুগন্ধযুক্ত করে তোলে। আশেপাশের কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করে। ঘাসফড়িংয়ের খাবারে পরিণত হয়। ঘাসফড়িং এসব বল খেলেই স্পোরগুলো সক্রিয় হয়ে যায়।

এই স্পোরগুলোর ব্যক্টেরিয়া একধরণের তীব্র প্রোটিন নিঃসৃত করে। ঘাসফড়িং মাতাল হয়। নিঃসৃত প্রোটিন ঘাসফড়িং এর মস্তিষ্ককে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ঘাসফড়িংয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় যেতে বাধ্য করে। ঘাসফড়িংয়ের খাদ্য গ্রহণসহ সব কিছুই স্পোরের ইচ্ছা অনুযায়ী হয়।

ফলে ঘাসফড়িংয়ের অকাল মৃত্যু হয়। পরে ঘাসফড়িংয়ের পেটে স্পোরের অঙ্কুরোদগম হয়। এগুলোকে দেখতে ব্যাঙের ছাতার মতো মনে হয়। কত আশ্চর্যে ঘেরা এই পৃথিবী, তাই না?

শুধু কি ঘাসফড়িং! মাকড়সা, বড় মাছি, প্রজাপতি, ফড়িং, ঝিঝিপোকাও এই পরজীবীর হাত থেকে রক্ষা পায় না। তোমাদের বোলতার কথা মনে আছে তো? মনে না থাকলে প্রথম পর্বটায় চোখ বুলাতে পারো। সে রাজকীয় অদ্ভুত পতঙ্গটিও এর (Cordyceps Genus) হাত থেকে রক্ষা পায়না। আশা করি নিচের চিত্রটি দেখলে বুঝতে সহজ হবে।

চিত্র-৪ঃ Cordyceps Genus এর আক্রান্ত বোলতার করুন অবস্থা

এসব কীটপতঙ্গ থকে বেরিয়ে সমুদ্রর তলদেশের খবর জানা যাক। কি বলো তোমরা? পৃথিবীর একমাত্র জীবন্ত ফসিল কী জানো? না জানলেও সমস্যা নাই। আমি বলে দিচ্ছি। তা হলো রাজ-কাঁকড়া।  এই রাজ-কাঁকড়া এখন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এর কারণ বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন।

তবে সাম্প্রতিক কিছু তথ্য উঠে এসেছে। তা হলো নিজেদের বংশবৃদ্ধি ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। এর জন্য Sacculina carcini  নামক পরজীবীকে দায়ী করা হয়েছে।

চিত্র-৫ঃ Sacculina carcini পরজীবী

এই পরজীবীগুলো বিভিন্ন শৈবালের সাথে বেঁচে থাকে। পরজীবীগুলো তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য রাজ-কাঁকড়াকে বেছে নেয়। এসব পরজীবী তাদের স্পোরগুলো শৈবালের ফলের মধ্যে রেখে দেয়। শৈবালের ফলগুলো রাজ-কাঁকড়া খেলেই তাদের শরীরে প্রবেশ করে। স্পোরগুলো থেকে এক ধরনের প্রোটিন নিঃসৃত হয়। যা রাজ-কাঁকড়ার মস্তিষ্ককে দখলে করে নেয়।

চিত্র-৬ঃ পরজীবীর আক্রান্ত রাজকাঁকড়া

এটি রাজ-কাঁকড়াকে বেশি বেশি পুং ও স্ত্রীদের কাছাকাছি হতে সাহায্য করে এবং বেশি বেশি ডিম দিতে সহায়তা করে। স্পোরগুলো ডিমের সাথে বাইরে চলে আসে। আস্তে আস্তে লার্ভায় পরিণত হয়। ডিমের নিষেককে ব্যর্থ করে দেয়। ফলে অনেক ডিম নষ্ট হয়।

এটি প্রত্যক্ষভাবে রাজ-কাঁকড়াকে মেরে ফেলে না। কিন্তু পরোক্ষভাবে রাজ-কাঁকড়ার বংশবৃদ্ধিকে থামিয়ে দিচ্ছে। রাজ-কাঁকড়ার জন্য কি অশনি সংকেত, তাই না?

একবার চিন্তা করতো? কি রহস্যময় সতেজ এ পৃথিবী। তবে সৃষ্টিকর্তা তার বিশালতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে যাচ্ছেন। ভাব একবার! যারা চিন্তাশীল তাদের অবশ্যই এগুলো থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। আজ নাহয় এখানেই শেষ করলাম। অন্য কোনোদিন আরো ভয়ংকর সব ঘটনা নিয়ে উপস্থিত হব। আশা করি তোমাদের জানার আগ্রহ অক্ষুন্ন থাকবে।

আরও পড়ুনঃ

ন্যানো প্রযুক্তির ঘরে

সেমিকন্ডাক্টরের গল্প শোনো 

ফ্লাইং সসার ও অদ্ভুত কিছু ঘটনা

সৌরজগতের জলাধার

শ্বাস-প্রশ্বাসের গল্প

জুলাই-আগস্ট ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ২