।মাবরুর আহমাদ নাকীব।

খুদে বিজ্ঞানপ্রিয় বন্ধুরা, তোমাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়- আলোর শক্তি কতটুকু? তোমরা হয়তো হুট করে জবাব দিবে, দৃষ্টি ঝাপসা করে চোখের সামনে সাদাকালো রেখার নৃত্য ফুটিয়ে তোলা পর্যন্ত। কেউবা মাথা চুলকিয়ে বলবে এক্স-রেতে হাড়ের ছবি তোলা পর্যন্ত।

কিন্তু আমি যদি বলি, আলো দিয়ে অতিশয় শক্ত স্টিল, এমনকি মাথার চুলকেও অনায়াসে কেটে ফেলা বা ছিদ্র করে ফেলা যাবে ইচ্ছেমতো- তবে কি তোমাদের চোখ চড়কগাছ হয়ে যাবে?

হ্যাঁ! সে কথাই বলছি। বলছি বিস্ময়কর শক্তিসমৃদ্ধ এক আলোক রশ্মির কথা। তা কিন্তু যেই সেই আলো নয়- একেবারে লেজার রশ্মি। পারমাণবিক শক্তির সঞ্চালন সমৃদ্ধ এই আলোর ক্ষমতা রীতিমতো পিলে চমকানোর মতো।

তোমরা হয়তো সায়েন্স ফিকশনে আলোর রিং ছুঁড়ে মারার মাধ্যমে শত্রুদেরকে আক্রমণ করতে দেখেছো। যার ফলে দানবাকৃতির গাড়ি, এমনকি প্লেনও ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। কাহিনী কাল্পনিক হলেও, সেই কাল্পনিক জগতের অস্ত্র কিন্তু লেজার রশ্মির প্রয়োগে প্রস্তুত করা সম্ভব। সুপার পাওয়ার দেশগুলো তা করেছেও।

তোমরা কি এমন অস্ত্র নিজ হাতে ছুঁয়ে দেখতে চাও? তবে আগে পড়ালেখার মধ্য দিয়ে মেধা আর বুদ্ধি প্রয়োগ করতে শিখো। মনে রেখো মেধা শক্তির তুলনায় লেজার রশ্মি কোন শক্তিই নয়! কারণ বর্তমানে মানুষ মেধা প্রয়োগ করে এমন সব প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি করেছে যে, মাত্র কয়েক দশক আগের পৃথিবীও তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি! এমনকি লেজার রশ্মিও।

তোমাদেরও ভবিষ্যতে এমন কিছু আবিষ্কার করতে হবে, যা এখনও আমাদের কল্পনাতে অনুপস্থিত। ঠিক ডোরেমনের গ্যাজেটের মতো। কি, পারবে তো আগামীর কিংবদন্তিরা? ইনশাআল্লাহ। যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে-  হবে হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।

এই দেখো তো কথায় কথায় কোথায় চলে গেলাম! আমার তো তোমাদেরকে লেজার রশ্মির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার কথা! চলো, তবে আর দেরি কেন? ভাবনার দক্ষিণের জানালাটা খুলে দাও। তীক্ষ্ণ মনোনিবেশে জানতে হবে যে। জানো তো আল্লাহ আমাদের প্রশ্ন করেছেন- “যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান?” নিশ্চয় নয়। আর আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রশ্ন করেন বিবেকবুদ্ধি খাটিয়ে বোধের দুয়ার খুলে দেবার জন্য।

১৯৫৮ সালে চার্লস টাউনেস এবং আর্থার স্যাকহাওলো নামের দুই মার্কিন বিজ্ঞান লেজার রশ্মি সম্পর্কে ধারণা দেন। তবে এর আগেই ১৯১৭ সালে আইনস্টাইন লেজার ও প্রায় একই রকম আরেকটি ধারণা মেজারের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।  আর ১৯৬০ সালে বিজ্ঞানী থিওডোর হ্যারল্ড মাইম্যান প্রথম অপারেশন লেজার তৈরি করেন। লেজার প্রযুক্তির উৎপাদন ও তত্ত্বাবধায়ন কার্যত অনেক ব্যায়বহুল।

চিত্র-১: চার্লস টাউনেস (বামে) ও থিওডোর হ্যারল্ড (ডানে)

ইংরেজি আদ্যক্ষর  LASER- এর পূর্ণরূপ হলো, Light Amplification Stimulated Emission Radiation । অর্থাৎ, উত্তেজিত বিকিরণের সাহায্যে আলোক বিবর্ধন কিবা বিকিরণ (রেডিয়েশন)- এর মাধ্যমে আলোকণাকে দীর্ঘ করে তোলা। বলে রাখা ভালো, কোন পদার্থের পরমাণু সংখ্যা ৮২ এর অধিক হলে তাতে রেডিয়েশন উৎপন্ন হয়।

সোডিয়াম লাইটের মতোই লেজারে আলোর বিকিরণ ঘটে। তবে সাধারণ আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সাথে তার হেরফের আছে। সাধারণ আলোতে বিভিন্ন রঙের আলোর উপস্থিতি দেখা যায়। যদিও সবগুলোর মিশ্রণে আমরা শুধু সাদা আলোটুকুই দেখতে পাই। কিন্তু লেজার হতে নির্গত আলোর রঙ মাত্র একটিই হয়।

কোন যৌগের মিশ্রণ তাতে থাকে না। এবং তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হয় মাত্র কয়েক মাইক্রন! (১ মাইক্রন হলো ১ মিটারের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ চওড়া)। লেজার রশ্মি অত্যন্ত ঘন এবং সঙ্ঘবদ্ধভাবে একমুখী বলে বহুদূর পথ অতিক্রম করতে পারে।  যার ফলে লেজারে প্রচণ্ড তাপশক্তির সঞ্চালন ঘটানো যায়। যা সূর্যের তাপমাত্রার চেয়েও অধিক হতে পারে! ফলে তা ব্যবহার করে মানুষের একটি চুল এমনকি তালাও ছিদ্র করা সম্ভব!

 

বন্ধুরা, তোমাদের মাথা ঘুরে যায়নি তো? মনোযোগ দিয়ে পড়লে যাওয়ারই কথা। চিন্তা করতে পারো, ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা হলেই যেখানে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে মন চায়। সাধারণত, ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পানি বাষ্প হতে শুরু করে।

সেখানে লেজার রশ্মির এক্কেবারে ৫৭,০০০ ডিগ্রিতে চোখের পলকে ইস্পাত কেটে গলে যাওয়া তো সাধারণ ব্যাপারই হয়ে যায়, তাই না? তবে ইস্পাতের মতো কঠিন বস্তুকে কেটে ফেলছে আলোকরশ্মি – তা সত্যিই বিস্ময়কর।

এবার একটা কাজ করো, তোমার মাথা থেকে টুপ করে একটা চুল ছিঁড়ে নিয়ে ভাবতে থাকো এই চুলকেও কিন্তু লেজার রশ্মি দিয়ে ছিদ্র করা সম্ভব। কি, ভারী আশ্চর্য লাগছে না? দেখো, আবার ছোট ভাইবোনদের মাথা থেকে ছিঁড়তে যেয়ো না যেনো। ওরা ব্যথা পাবে।

আর কাউকে ব্যথা দেয়া আল্লাহ পছন্দ করেন না। আল্লাহ কোনভাবে হয়তো সেই ব্যথা তোমাকেই ফিরিয়ে দিবেন। তাই অন্তত নিজেকে বাঁচানোর জন্য হলেও কাউকে কখনো ব্যথা দিও না। ভুল করে দিয়ে ফেললে ক্ষমা চেয়ে নিও কিন্তু। তিনি ক্ষমা করে দিলে আল্লাহও ক্ষমা করে দিবেন। বুঝলে তো গোলাপ কলি বন্ধুরা?

এবার লেজার রশ্মি বিচ্ছুরণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলি। সলিড বডি লেজার এর মূলে রয়েছে একটি রুবি রড। যার চারপাশে একটি পেঁচালো পারদের বাতি আছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে এম্পলিফাই বা সম্প্রসারণ করা হয়। পারদের বাতি ক্ষুদ্র কয়েক ফ্ল্যাশের মাধ্যমে আলোর বিকিরণ ঘটায়। ফলে রুবির মধ্যকার পরমাণু উত্তেজিত হয়ে আলোর কণা বিক্ষিপ্ত করে।

রুবি রডের একপ্রান্ত সম্পূর্ণ এবং অপরপ্রান্ত আংশিকভাবে আলো প্রতিফলন করে। দু’প্রান্তের মধ্য দিয়ে আলো সঞ্চালিত হয়ে অন্য পরমাণুর মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। যার দরুণ রুবি রডের শক্তির মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে রডের আংশিক প্রতিফলন দিক হতে আলোকছটা বেরিয়ে আসে।

হাল আমলে লেজারের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে চলছে। লেজার অত্যন্ত নিপুণভাবে দূরত্ব নির্ণয়ের কাজে, শল্য ও চোখের গুরুতর সমস্যার চিকিৎসায়, কোন কিছু কাটা ও জোড়া লাগানোসহ বহুবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়। লেজারের ক্ষেত্র বর্তমানে বেশ সুবিশাল।

তাছাড়া, লেজার গান, লেজার কাটার, লেজার রাডার বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর যুদ্ধাস্ত্র। ১৯৬২ সালে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব বের করতেও লেজার রশ্মির সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। বিস্তারিত না হয় আরেকদিন বলবো, কেমন?

চিত্র-৩: চাঁদে নিক্ষিপ্ত লেজার রশ্মি

বন্ধুরা, এই হলো লেজার রশ্মি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা। আশা করি তোমরা পর্যায়ক্রমে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে আরো বিস্তৃত জ্ঞান অর্জন করবে এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রয়োগ করবে। কেউ বা তার আরো উন্নতি ঘটাবার চেষ্টা করবে। মনে রেখো, Practice makes a man perfect।

মে-জুন ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৩

মাইনাস ওয়ান বিড়ম্বনা!

ব্লাড গ্রুপিং বৃত্তান্ত

ব্ল্যাক বক্স কীভাবে কাজ করে?

সুপার হাইওয়ে

পিথাগোরাসের ত্রয়ী

রোজার উপকারিতা

মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ

উইন্ড টারবাইনের গল্প

মস্তিষ্ক দখল

জার্নি টু দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

জার্নি টু দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

বিপজ্জনক ভাইরাসেরা

 

ছোট ম্যাজেলানিক ক্লাউড

 

চিনে রাখি অসুখগুলি