।নাসিফ ইসহাক।

ফুটবল দেখতে কেমন জানো? তার আগে বলে নেয়া প্রয়োজন ফুটবল বলতে বিশ্বের একটা বড় অংশ রাগবি ফুটবলকে বুঝে। কিন্তু আমরা সেই ফুটবলের কথা বলছি যাকে বেশির ভাগ মানুষ সকার নামে চেনে। হ্যাঁ, সকার বল দেখতে কেমন? ছোট বড় সকলেরই উত্তর হবে গোলাকৃতির সাদা-কালো রং মিশানো একটি বল। কিন্তু আরেকটু বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।

ফুটবল আসলে পুরোপুরি গোলাকৃতির নয়, ষড়ভুজাকৃতি ও পঞ্চভুজাকৃতির অনেকগুলো তল একত্রে মিশে এর আকৃতি তৈরি হয়। তোমরা অনেকেই রসায়নে ফুলারিনের কথা জানো, ফুলারিন ৬০ টি কার্বন পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত কার্বনের একটি রূপভেদ (C60) যার আকৃতি দেখতে ফুটবলের মতো।

চিত্র ১: ফুটবলের আকৃতি

যারা ঠিকমত খেয়াল করোনি তারা আজকেই খেয়াল করে দেখবে ফুটবলের সবগুলো তল ষড়ভুজ না। আবার সবগুলো তল পঞ্চভুজও নয়। দুটির সমন্বয়েই তৈরি হয়েছে ফুটবল। তোমরা যারা সাদা-কালো রঙের ফুটবলের সাথে পরিচিত তাদের জন্য এটা বুঝাটা আরো সহজ হবে। এই সাদা-কালো রঙ মিশানো ফুটবলের সাথে পরিচিত তারা কি জানো এটা হচ্ছে ১৯৭০ সালের মেক্সিকো ফুটবল বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ফুটবলের গড়ন।

বিশ্ববিখ্যাত অ্যাডিডাস  ব্র্যান্ড ১৯৭০ সালের ফিফা বিশ্বকাপ থেকে বিশ্বকাপের অফিসিয়াল বল সাপ্লাইয়ার এবং তারাই প্রথমবারের মতো ফুটবলের এই সাদা-কালো রঙের গড়ন ব্যবহার করে। সাদা রঙের তলগুলো ষড়ভুজাকৃতির এবং কালো রঙের তলগুলো পঞ্চভুজাকৃতির। ভালো করে খেয়াল করে দেখবে, ষড়ভুজতল মোট ২০ টি এবং পঞ্চভুজতল মোট ১২ টি। উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপেও সেই একই টেলস্টার ফুটবলই ব্যবহার করা হয়েছিল।

চিত্র-২: ১৯৭০ সালের মেক্সিকো ফিফা বিশ্বকাপের ব্যবহৃত ফুটবল টেলস্টার

এবার আসা যাক স্যাটেলাইটের কথায়। আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর পূর্বে ১৯৬২ সালে নাসা “টেলস্টার” স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে যা সর্বপ্রথম মহাকাশের মাধ্যমে টেলিভিশন ও টেলিফোনের সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম হয়। টেলিভিশন আর স্টার এর মিলিত নামই হচ্ছে “টেলস্টার”। এই নামের সাথে মিল রেখেই অ্যাডিডাস  কোম্পানি ফুটবলের নাম দেয় “টেলস্টার”।

উল্লেখ্য, টেলস্টারের অবয়বও অনেকটা সাদা-কালো রঙের মিশ্রণ, যার সাথে মিল রেখেই ফুটবলের রঙ সাদা-কালো করা হয় বলে ধারণা করা হয়। আবার আরেকটা মত রয়েছে; সেই সময় প্রায় সব টেলিভিশনই সাদা-কালো থাকায় ফুটবল খেলা দেখার সময় ফুটবল কোথায় আছে বুঝার জন্য সাদা-কালো রঙ ব্যবহার করা হয়েছিল। তা না হয়ে শুধুমাত্র একটি রঙিন ফুটবল হলে খেলা দেখাকালীন সময়ে সাদা-কালো টিভির দর্শকদের ফুটবল কোন মুহূর্তে কোথায় আছে তা বুঝতে সমস্যা হতে পারতো।

চিত্র-৩: নাসার উৎক্ষেপিত টেলস্টার-১ স্যাটেলাইট

অ্যাডিডাস কোম্পানি ২০১৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপের ফুটবলের নাম দিয়েছে “টেলস্টার ১৮”, অর্থাৎ প্রায় ৪৪ বছর পরে আবারো টেলস্টার থিম ফিরিয়ে এনেছে অ্যাডিডাস। এজন্যেই এতসব আলোচনা, টেলস্টার পৃথিবীর প্রথম টিভি সম্প্রচারকারী স্যাটেলাইট হলেও বর্তমানে এর কোন ব্যবহার আর নেই। এজন্যেই টেলস্টার ১৮ এর গড়নে কালো রঙটিকে পিক্সলেটেড করে দেয়া হয়েছে।

ডিজাইন অ্যাডিডাস কোম্পানির হলেও টেলস্টার ১৮ ফুটবল তৈরির কাজটি নিয়েছে পাকিস্তানের “ফরওয়ার্ড স্পোর্টস” নামে খেলার সামগ্রী প্রস্তুতকারক খ্যাত কোম্পানি। টেলস্টার ১৮ তে দেয়া হয়েছে এনএফসি (Near Field Technology) যার মাধ্যমে দূর থেকেও ফুটবলের অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যবে।

 

চিত্র-৪: ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপে ব্যবহৃত ফুটবল টেলস্টার ১৮

এছাড়াও এবারের বিশ্বকাপে থাকছে গোল লাইন টেকনোলোজি যার মাধ্যমে ফুটবল গোল লাইন অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকলেই গোল বলে গণ্য করা হবে। সর্বপ্রথম এটার সুবিধা নেন ফ্রান্সের কারিম বেঞ্জেমা, তিনি হন্ডুরাসের বিপক্ষে ম্যাচে একটি শট নেন যেটা গোল লাইন ক্রসে করে ভিতরে ঢুকে যায় ক্ষুদ্র মিলিসেকেন্ডের জন্য, সাথে সাথেই গোলকিপার বলটিকে ফিরিয়ে আনেন যেহেতু বলটি শূন্যে ছিল। পরবর্তীতে রেফারি গোল লাইন টেকনোলোজির সহায়তায় সেটিকে গোল হিসেবে ঘোষণা করেন।

এছাড়াও এবারের বিশ্বকাপে থাকছে ভিডিও এসিস্ট্যান্ট রেফারি। গোল লাইন টেকনোলোজির মাধ্যমে যেমন খুব সূক্ষ্মভাবে গোল হয়েছে কিনা তা জানা যাবে, সাথে সাথে খুব সূক্ষ্ম ও ম্যাচের নীতিনির্ধারক কিছু সিদ্ধান্ত যাতে ভুল না হয় তার জন্য ভিডিও এসিস্ট্যান্ট রেফারির টেকনিক এবার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্যবহার হতে যাচ্ছে। বিগত সকল বিশ্বকাপেই ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল দিতে হয়েছে অনেক দলকেই। এবার সেগুলো কাটিয়ে উঠতেই এবারের এই প্রযুক্তি।

চিত্র-৫: ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা ভিডিও এসিস্ট্যান্ট রেফারি টেকনোলোজি

তাছাড়াও এবারের ফিফা বিশ্বকাপে রয়েছে ইলেক্ট্রনিক পারফর্মেন্স এবং ট্র্যাকিং সিস্টেম যার মাধ্যমে প্রত্যেক খেলোয়াড় এবং বলের তাৎক্ষণিক অবস্থান জানতে সহায়তা করবে। প্রত্যেক দলের টেকনিক্যাল ও মেডিক্যাল টিমের সাথেই ডেডিকেটেড ওয়ার্কস্টেশন এবং যোগাযোগ মাধ্যম থাকবে যার সাহায্যে তারা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের আপডেট দিতে পারবে এবং ক্যামেরার মাধ্যমে তা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।

সব মিলিয়ে যেটা বুঝা যায়, সকল বিতর্কের অবসান করতে সকল প্রস্তুতিই সম্পন্ন করেছে ফিফা। কিন্তু বিতর্ক কি আর এতো সহজে শেষ হয়? বাস্তবে কি হবে সেটা আসলে মাঠে ফুটবল গড়ানোর পরেই বুঝা সম্ভব হবে!

তথ্যসূত্র:

  1. https://www.aljazeera.com/news/2018/02/russia-pakistan-footballs-2018-world-cup-180203113114891.html
  2. https://www.mlssoccer.com/post/2017/11/09/adidas-releases-official-ball-2018-fifa-world-cup
  3. https://en.wikipedia.org/wiki/Adidas_Telstar_18
  4. https://en.wikipedia.org/wiki/Adidas_Telstar
  5. https://football-technology.fifa.com/en/blog/hidden-technologies-at-the-2018-fwc/
জুলাই-আগস্ট।বর্ষ ৪।সংখ্যা ২