।মোঃ শফিকুল ইসলাম।

তোমাদেরকে আগে আকাশে বসবাসের কথা বলেছি। এমন কিছু স্থাপনার কথা বলেছি যেগুলো ভূমি এমনকি মেঘ থেকেও অনেক উপরে অবস্থিত। আজকে আর একটু এগিয়ে পৃথিবীর সীমানার বাইরে মহাশুন্যে বসবাসের কথা বলবো। তোমরা হয়তো অবাক হয়ে ভাবছো, পৃথিবীর বাইরেও কি বসবাস করা সম্ভব? হুম, সম্ভব। আর সেটা আজকে নয় বরং আরো পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই সম্ভব। এবং কিছু মানুষ আমাদের সবার অগোচরে মহাশূন্যে বসবাস করছে।

আকাশে মানুষ নির্মিত সব থেকে বড় স্থাপনা হল- ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (ISS), যা পৃথিবীর নিকট দূরত্বে থেকে ক্রমাগত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে যাচ্ছে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে প্রতিদিন ষোল বার করে আমাদের মাথা থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার উপর দিয়ে প্রদক্ষিণ করছে।

পৃথিবীর বাইরে এবং মহাশুন্যে এটাকেই এ পর্যন্ত মানুষের দ্বিতীয় আবাসস্থল বলা যায় যেখানে দশজন ক্রু সবসময় অবস্থান করে যাচ্ছে। তারা নিয়মিত গবেষণা করে যাচ্ছে কিভাবে মানুষ পৃথিবীর বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। তাদের এই গবেষণা হয়তো মানুষকে চাঁদে এমনকি মঙ্গলেও টিকে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে।

মহাশূন্যে মানুষের যাত্রা আমাদের জন্মেরও অনেক বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে। মজার ব্যাপার হল মহাশূন্যে প্রথম যে বস্তুটি পাঠানো হয়েছিল সেটা নিছক গবেষণা বা পরীক্ষার জন্য করা হয়নি। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি সম্মিলিত মিত্রপক্ষের বিপক্ষে একটি ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করে যা পৃথিবীর সীমানা পার করতে সক্ষম হয়।

অর্থাৎ মহাশূন্যে মনুষ্য নির্মিত প্রথম বস্তুটি মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়নি বরং ধ্বংস করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এই ঘটনাটি অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই মানুষের জন্য মহাশূন্যের দুয়ার খুলে দেয়।

চিত্র-১ঃ জার্মান ভি-২ ব্যালিস্টিক মিসাইলের রেপ্লিকা (কপি)

১৯৪৪ সালের ২০শে জুন জার্মান ভি-২ (German: Vergeltungswaffe 2, বা বাংলায় প্রতিশোধমূলক অস্ত্র-২) ব্যালিস্টিক (মানে হল যার নির্দিষ্ট টার্গেট রয়েছে) মিসাইল প্রথম বারের মত পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে ভূমি থেকে ১৮৯ কিলোমিটার উপরে উঠতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের সর্বনিম্ন দূরত্ব হল ১০০ কিলোমিটার। খুব কম, তাইনা? ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব থেকেও কম।

তাহলে এই কাজটা এত কঠিন কেন? তোমরা অনেকেই মুক্তি বেগের কথা জানো, কোন বস্তুকে সর্বনিম্ন যে বেগে নিক্ষেপ করলে তা পৃথিবীর অভিকর্ষ বল অতিক্রম করতে পারবে তাই হল- মুক্তি বেগ। মুক্তি বেগের মান কত জানো? মাত্র ১১.২ কি.মি. /সে. বা ঘন্টায় ৪০,২৭০ কিলোমিটার। যদিও মহাশূন্যে যাওয়ার জন্য এই বেগ দরকার হয়না বরং পৃথিবীর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে আবর্তন করতে এই বেগের প্রয়োজন।

একটি রকেটকে সর্বনিম্ন ৭.৯ কি.মি. /সে. বেগে নিক্ষেপ করা হলে সে মহাশূন্যে যেতে সক্ষম হবে। এই বেগকে অরবিটাল বেগ বা প্রথম কসমিক বেগ বলে যা শব্দের বেগের প্রায় বিশগুণ। রকেট এই বেগে গেলে পৃথিবীর অরবিটে (নিচের চিত্রে C) পৌঁছাতে পারবে। এরপর আরো বেগ বৃদ্ধি পেলে তা আউটার অরবিটে (চিত্রে D) চলে যাবে আর পরিশেষে মুক্তিবেগ বা দ্বিতীয় কসমিক বেগে পৌঁছালে তা মহাশূন্যে (চিত্রে E) চলে যাবে।

চিত্র-২: মহাকাশযানের গতিপথ

তোমরা হয়তো ভাবছো রকেট সোজা উপরে না উঠে বৃত্তাকার ঘুরা পথে যায় কেন? এর উত্তরে বলবো- তোমরা যদি একটি মোটামুটি ওজনের ঢিল নিয়ে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে একবার খাড়া উপরের দিকে আরেকবার আনুভূমিক বা ভূমির সমান্তরালে নিক্ষেপ করো তাহলে কি পর্যবেক্ষণ করবে? খাড়া উপরের দিকে নিক্ষেপ করলে গতিবেগ অর্জন করা অনেক কঠিন। এবার তাহলে তোমার ঢিলের জায়গায় কয়েক টন ওজনের রকেট আর মহাকাশযান কল্পনা করো, এদের খাড়া উল্লম্বদিকে মুক্তিবেগ অর্জন কতটা কঠিন এবার বুঝতে পেরেছো?

যাইহোক, প্রথম মহাকাশ ভ্রমণ মিসাইল দ্বারা হলেও এর মাত্র তেরো বছরের মাথায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) ইতিহাসে প্রথম মনুষ্য নির্মিত যান মহাকাশে প্রেরণ করে ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। তোমরা কি জানো সেই যানের নাম কি? তোমরা সবাই জানো, সেটা হলো স্পুটনিক-১। স্পুটনিককে প্রকৃত অর্থে মহাকশযান বলা যাবেনা, এটি হল মূলত একটি কৃত্রিম স্যাটেলাইট যা দিয়ে যোগাযোগ, পর্যবেক্ষণ বা গবেষণাকাজ ইত্যাদি পরিচালনা করা যায়।

স্যাটেলাইটে সাধারণত কোন মানুষ থাকেনা। আর মহাশূন্য বা মহাকাশ আবিষ্কারেও এটা তেমন কোন ভুমিকা রাখে না। বাংলাদেশও এরকম একটি স্যাটেলাইটের মালিক যা কিছুদিন আগে মহাশূন্যে প্রেরণ করা হয়েছে। স্যাটেলাইট নিয়ে না হয় আরেকদিন কথা বলা যাবে, এবার মূল বিষয়ে আসি।

চিত্র-৩: স্পুটনিক-১

মহাশূন্যে মানুষের খরা নিবারণ করতে তৎকালীন মহাকাশ গবেষণায় একচেটিয়া দাপটধারী সোভিয়েতের খুব বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ব্যাপারটা আরো ত্বরান্বিত হয়েছিল সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যে চলা স্নায়ুযুদ্ধের কারণে। বিশেষত, সোভিয়েতের স্পুটনিক প্রেরণের কারনে যুক্তরাষ্ট্র খুব চাচ্ছিলো পরের ধাপে এগিয়ে থাকতে। এবং এজন্য তারা ‘প্রজেক্ট মার্কারি’ নামে তাদের নিজস্ব প্রোগ্রাম চালু করেছিল। যাইহোক এই যুদ্ধেও বলতে গেলে হেসে খেলেই জিতে যায় সোভিয়েত।

স্পুটনিকের মাত্র চার বছর পরেই ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল সোভিয়েত পৃথিবীর সীমানার বাইরে মানুষ প্রেরণ করে অনবদ্য ইতিহাস তৈরি করে। মজার ব্যাপার হলো, এই মহাকাশযান আর মহাকাশচারী উভয়ের নামই তোমরা জানো। আসলে এদের নাম না জানলে তো মহাকাশবিদ্যা সম্বন্ধেই অন্ধকারে থাকতে হবে।

হুম, আমি ভোস্টক-১ আর ইউরি গ্যাগারিনের কথাই বলছি। গ্যাগারিন ভোস্টকের ককপিটে করে মহাশূন্য থেকে পৃথিবী পূর্ণ প্রদক্ষিণ করে সফলভাবে আবার পৃথিবীর বুকে ফিরে আসে। আর সেই সাথে রচনা করে মহাশূন্যে মানুষের বসবাসের শুভ সূচনা আর অপার সম্ভাবনা। যদিও এই যাত্রায় মোট সময় লেগেছিল দুই ঘন্টারও কম কিন্তু তা পথ তৈরি করে দিয়ে গেছে এক অনন্তকালের যাত্রার।

চিত্র-৪: ভোস্টক-১

আজকে মহাকাশে বসবাসের ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা বললাম। আগামি পর্বে ভোস্টক থেকে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের যাত্রার কাহিনী আর মহাকাশে জীবন যাত্রার প্রণালী নিয়ে আরো কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। আর তোমরা চিন্তা করতে থাকো- কোনটা বেশি কঠিন? মহাশূন্যে মানুষ পাঠানো নাকি ওখানে বসবাস।

জুলাই-আগস্ট ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ২