জীববিজ্ঞান

মস্তিষ্ক দখল(পর্ব-৫)

মোঃ মোখলেছুর রহমান

১৮ অক্টোবর ২০১৮
Time Icon  

 ৬ মিনিট

পঞ্চম পর্বে এসে ভাবছিলাম একটু বিশ্রাম নিবো। কিন্তু না তা আর হলো কই। নাছোড়বান্দা সহকারি সম্পাদক সাহেবের কথায় উদ্‌বুদ্ধ হয়ে লিখতে বসে গেলাম। তোমরা পূর্বের একটি সংখ্যায় ইঁদুর-বিড়ালের মধ্যে বন্ধুত্ব নিয়ে পড়েছিলে। মনে না থাকলে একটু দেখে নিতে পারো। গতসংখ্যায় দেখেছি ফিতা কৃমি গরু ও শুকরের মাংসে পাওয়া যায়। গরুর তুলনায় শুকরের মাংসে বেশি পরিমাণে থাকে। এছাড়াও শুকরের মাংসে আরো অনেক পরিমাণে পরজীবী বাস করে। এসব পরজীবী প্রত্যেকেটিই মানুষের জন্য ভয়ানক সব রোগ বহন করে থাকে।


আমরা শুকর নিয়ে পরবর্তীতে পূর্ণ একসংখ্যা লিখবো। আজ বিড়াল ও কুকুর বা পশমাবৃত প্রাণি ও রঙিন গোবরে পোকা সম্পর্কে জানা যাক। বিড়ালকে আমরা বেশিরভাগ মানুষই পছন্দ করি। বিড়ালের মস্তিষ্ক নিয়ে লেখার সময় একটি নাম মনে পড়লো। তিনি একজন সাহাবী হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ)। যাকে বিড়ালের পিতা বলা হয়। বুঝতেই পারছো বিড়াল কতটা গুরত্বপূর্ণ। বিড়াল কিন্তু কুকুর থেকে অনেক পরিষ্কার। হ্যাঁ, বিড়াল প্রাকৃতিকভাবে পবিত্র। একটু পরে তা বুঝতে পারবো। আমরা প্রায়ই দেখি বিড়াল প্রাকৃতিক কাজ (প্রসাব বা পায়খানা) শেষ করে তা ঢেকে রাখে।

চিত্র-১: বিড়ালের বিষ্ঠা ঢাকার চিত্র


অনেকের মনে হবে বিড়াল অনেক সচেতন। আথবা পরিবেশের প্রতি যত্নশীল। কিছুটা! তবে সৃষ্টিকর্তার অন্যরকম সৃষ্টি বলা যেতে পারে। আর পৃথিবী অনেক বৈচিত্র্যময়। জীবজগতে টক্সপ্লাসমা গোন্ডি ও ডিপিলিডিয়াম ক্যানিয়ন (Toxoplasma gondii ও Dipylidium caninum) নামক পরজীবী আছে। এগুলো সাধারণত বিড়ালের বৃহদন্ত্রে বসবাস করে। এরা হচ্ছে টেপওয়ার্ম, হার্টওয়ার্ম ও লাংওয়ার্ম। এগুলোই বিড়ালকে এমন পরিবেশ বান্ধব বানিয়েছে।

প্রায় কয়েক হাজার বছর ধরে এরা বিড়ালের সাথে সহবস্থানে আছে। জীবনের বেশিরভাগ সময় এরা পেটের ভিতরে থাকে। কেমিক্যাল নিঃসৃত করে এরা বিড়ালের মস্তিষ্ককে দখল করে নেয়। এসব পরজীবী বংশবৃদ্ধি করার জন্য বিড়ালকে ব্যবহার করে। পূর্বে অনেক পর্বেই দেখেছি পরজীবীর ডিম বিড়ালের বিষ্ঠার সাথে বের হয়। কিন্তু গবেষণা করে দেখা গেছে সূর্যের আলো পেলে ডিম নিষিক্ত হতে পারে না। তাই তারা বিড়ালের মস্তিষ্ক দখল করে। এবং পরবর্তী জীবনচক্র পূর্ণ করতে বিড়ালকে মাটির নিচে বিষ্ঠা চাপা দিতে বাধ্য করে।

আপাতদৃষ্টিতে বিড়ালকে পরিবেশবান্ধব মনে হলেও মূল ঘটনা এটাই। এই পরজীবীগুলো বিড়ালজাতীয় প্রাণির মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়। অনেকে আবার মনে করেন বিড়ালজাতীয় প্রাণিদের ঘ্রাণশক্তি অনেক বেশি। তাই নিজেদের বিষ্ঠার দুর্গন্ধ থেকে বেঁচে থাকার জন্য তারা এমনটা করে থাকে। এতো শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তির জন্যও কিন্তু এই পরজীবী কিছুটা দায়ী। তবে দুটি মতামতের মধ্যে আমার কাছে প্রথমটি বেশি শক্তিশালী মনে হয়েছে।


বিড়াল নিয়ে জানলাম এবার কুকুর নিয়ে জানা যাক। অনেকে ভাবছো তাহলে কুকুর কেন এরকম করে না? করলে কত না ভালো হতো- তাই না? কুকুর কিন্তু বিড়ালের মত না। কুকুরও পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে কুকুর কেন বিড়ালের মত আচরণ করে না এটা সামনের কোন এক সংখ্যায় জানবো। এখন জানবো কুকুরের শরীরে কৃমির জীবনকাল। জেনে আশ্চর্য হবে নিশ্চয়ই। কুকুর, ভেড়া কিংবা পশমি প্রাণির শরীরে এক ধরনের মাছি (ইংরেজীতে flea বলে) বসবাস করে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম টুনগা পেনেট্রান্স (Tunga penetrans)। এই মাছিগুলি পোষকের বা প্রাণির রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে।

চিত্র-৪: টুনগা পেনেট্রান্স (Tunga penetrans) পরজীবী

এই পরজীবী আবার অন্য পরজীবী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই মাছিগুলোর কিন্তু মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরুপ। এগুলো কামড় দিলে সেন্স করার ক্ষমতা অনেক কমে যায়।  

চিত্র-৫: টুনগা পেনেট্রান্স মাছির কামড়ে ক্ষতিগ্রস্থ পায়ের চিত্র

কামড় দেয়ার সময় এরা তাদের ডিম ঢুকিয়ে দিতে পারে। একধরনের কৃমি আছে যারা কুকুর বা ভেড়ার ক্ষুদ্রান্ত্রে বসবাস করে।

চিত্র-৬: মানুষ বা প্রাণির শরীরে লার্ভার জন্ম

এদের পূর্ণজীবন সেখানেই শেষ হয়। এদের ডিম কুকুর বা ভেড়ার বিষ্ঠার সাথে বের হয়। এই কৃমি আবার ঐ বিশেষ ধরনের মাছির উপর নির্ভর করে থাকে। মাছির শরীরে দুইধরনের লার্ভা থাকে। একটি কৃমির অপরটি তাদের নিজেদের। এই মাছিগুলো কিছুটা মশার মত। তাদের পরবর্তী বংশবৃদ্ধির জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়। মাছিগুলো উপযুক্ত পরিবেশে তিন মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। প্রাপ্ত বয়স্ক একজন স্ত্রী মাছি প্রায় ৭,০০০ ডিম দিতে পারে।

চিত্র-৭: প্রাপ্ত বয়স্ক মাছি

প্রথম অবস্থায় মাছিগুলোর পেটে কৃমির লার্ভা থাকে। লার্ভাগুলো একধরনের কেমিক্যালের মাধ্যমে মাছিগুলোকে প্রাণির শরীরে বাসা বাধতে বাধ্য করে। ফলে প্রাণির শরীরে সহজেই কৃমির লার্ভা রক্তের সাথে মিশে হৃদযন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। গত সংখ্যায় দেখেছি, গরুর মাংসে কৃমির লার্ভার মত গোটা শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পরবর্তীতে ক্ষুদ্রান্ত্রে বাসা বাঁধে। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী মাছি তাদের লার্ভা রক্তের সাথে মিশে ডিম থেকে লার্ভায় পরিণত হয়। তা প্রাণির শরীরে প্রবেশ করায় সেখান দুই প্রক্রিয়ায় পরিণত মাছি পাওয়া যায়। এভাবে তারা জীবনচক্র শেষ করে।

বিড়াল ও কুকুরের রহস্য ভালো লেগেছে নিশ্চয়ই! এখন গোবরে পোকা সম্পর্কে কিছু জানবো। প্রথম সংখ্যায় বোলতার কথা স্মরণ করেছি। দেখেছি বোলতা তেলাপোকা, মাকড়শা ও অন্যান্য কিছু কীটের মস্তিষ্ক দখল করে নেয়। এই বোলতা কিন্তু গোবরে পোকাকেও ছাড় দেয় না। প্রথম সংখ্যা পড়লে বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে আশা করি। গোবরে পোকা দেখতে অনেক সুন্দর। কিন্তু বংশবৃদ্ধি করতে গিয়ে তার মৃত্যু ঘটে। এর জন্য দায়ী হলো বোলতা।

চিত্র-৯: রঙিন গোবরে পোকা

গোবরে পোকার পেটে বোলতার ডিম লার্ভায় পরিণত হয় এবং গোবরে পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে গোবরে পোকাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও লার্ভার জন্য বাসা বাধতে বাধ্য করে। একসময় লার্ভা গোবরে পোকার পেট ফেটে বের হয়। গোবরে পোকার পা গুলোকে আটকিয়ে রাখে। এতে গোবরে পোকার মৃত্যু হয় না।

চিত্র-১০: পক্ষাঘাতগ্রস্থ গোবরে পোকা

প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এই সময়ের মধ্যে লার্ভা গোবরে পোকা থেকে প্রোটিন গ্রহণ করে। লার্ভা থেকে বোলতার বাচ্চা বের হয়। গোবরে পোকাকে খেয়ে ফেলে।

দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে বোলতার পরিপূর্ণতা আসে। কি সাংঘাতিক! তাই না? প্রকৃতিকে সৃষ্টিকর্তা তার আপনগুণে রহস্যময় করে সাজিয়েছেন। যাতে জ্ঞানী-গুণি ব্যক্তিরা এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রকৃতি থেকে আমরাও শিক্ষা নিব ইনশাআল্লাহ। এর পরের সংখ্যায় নতুন কিছু নিয়ে হাজির হবো। আশা করি অপেক্ষায় থাকবে।


নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৪

৬ বছর

শেয়ার করুন

কপি

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করতে লগইন করুন

লগইন রেজিষ্টার