স্বাস্থ্য
রিফাত জাহান
১৫ নভেম্বর ২০১৮৫ মিনিট
অভাবনীয় উন্নয়ন আর আবিস্কারের এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একাল-সেকালের তুলনা রীতিমতো অবাক করে দেয়। ১০০ বছর আগেও চিকিৎসার পশ্চাৎপদতার দরুণ যে মৃত্যুহার চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যর্থতার স্মারক ছিল, সেই চিকিৎসা বিজ্ঞানই আজ প্রতিনিয়ত অসুস্থতা মুক্ত সুন্দর, সজীব জীবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
আজ আমরা বিগত সাত বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছু অভূতপূর্ব প্রাপ্তি সম্পর্কে জেনে নিবো।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানই বা পিছিয়ে থাকবে কেন! 3D printer, নব আবিষ্কৃত এমন এক প্রযুক্তি যা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নিয়ে যাবে বহুদূর। organ transplantation কিংবা traumatic injury’র ভয়াবহতা হ্রাস করা এবং amputated limb-এর পরিবর্তে নতুন কার্যকরি অঙ্গ সংস্থাপনের মত যুগান্তকারী কিছু প্রাপ্তি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায়।
Biodegradable plastic (যা যে কোন অঙ্গের আকৃতি নির্ধারণের সহায়ক) এর অভ্যন্তরে skin cell এবং cartilage cell এর সমন্বয়ে বিজ্ঞানীরা “বহিঃকর্ণ” তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। অঙ্গটি যখন মানবদেহে স্থাপন করা হয়, তখন কোষ থেকে উৎপন্ন প্রোটিনের প্রাকৃতিক গাঠনিক ম্যাট্রিক্স দ্বারা বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকটি প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। Implantation এর পর থেকেই অঙ্গগুলো কার্যকারিতা লাভ করে। বহিঃকর্ণ ছাড়াও blood vessel, skin, kidney তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, এবং ২০২০ সালের মধ্যে লিভারও তৈরি সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।
তবে implant করার পরে অঙ্গটি অক্সিজেন এবং নিউট্রিয়েন্ট এর অভাবে necrosis এর সম্মুখীন হতে পারে, যদি টিস্যুর পুরুত্ব ০.২ mm এর চেয়ে বেশি হয়। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে এ যেন “goose that really does lay golden egg.”
জিন থেরাপির মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার লিউকেমিয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার, মেডিকেল ডেভেলপমেন্টের ইতিহাসে অন্যতম অর্জন। এছাড়াও অন্যান্য ক্যান্সার (ব্রেস্ট ক্যান্সার) প্রতিরোধেও এটি ভূমিকা রাখবে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।
তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল, জিন থেরাপির আবিষ্কার ক্যান্সারের প্রথাগত চিকিৎসা, যেমন-রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি কিংবা সার্জারি এর বিদায় ঘণ্টা বাজাচ্ছে, যা একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর কষ্ট অনেকটাই লাঘব করবে। এছাড়াও ড্রাগের পরিবর্তে defected DNA এর অভ্যন্তরে gene insertion এর মাধ্যমে বংশগত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার যেন এক অন্য আলোয় মেডিকেল সাইন্সকে আলোকিত করছে। আর বয়স বেড়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা তুমিও একটু স্বস্তির শ্বাস নাও, কেননা aging process-এর ট্রিটমেন্টেও জিন থেরাপির প্রয়োগ হচ্ছে।
দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা ব্যক্তিকে কৃত্রিম দৃষ্টিশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে অন্ধত্ব নিরসনে আশার আলো ছড়াচ্ছে "বায়োনিক আই"। চোখের মধ্যে সার্জিক্যালি বায়োনিক আই স্থাপনের মাধ্যমে অপটিক নার্ভের সাথে মাইক্রোইলেক্ট্রোড সংযুক্ত করা হয়, আর এটিই রেটিনায় সৃষ্ট ইলেক্ট্রিক ইমপালস ব্রেইনে প্রেরণের মাধ্যমে visual sensation সৃষ্টি করে। বায়োনিক আই natural sight এর পরিবর্তে প্রোজ্জ্বল কিছু বিন্দুর cluster তৈরি করে, এবং এই বিন্দু গুলোর প্রকৃতি interpret করার মাধ্যমে রোগীকে বিভিন্ন বস্তুর আকার-আকৃতি নির্ধারণের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যদিও বায়োনিক আই এর ডেভেলপমেন্ট এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে, তবুও গবেষকরা আশা করছেন, অদূর ভবিষ্যতেই তা আরো উন্নততর অবস্থায় পৌঁছুবে।
যেসব ব্যক্তির হার্ট ফেইলিওর এর আশংকা রয়েছে, তাদের জন্য পজিটিভ নিউজ রয়েছে। যেসব রোগী হার্টের মারাত্মক অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের যথাযথ মেডিকেল চেকআপে রেখেও এক বছরের বেশি বাঁচানো সম্ভব হয়ে উঠে না। তবে নতুন আবিষ্কৃত একটি ড্রাগ এই অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। Serelaxin (সিনথেটিক রিলাক্সিন হরমোন) এর ব্যবহার রোগীর survival rate প্রায় ৩৭%-এ উন্নীত করেছে। এটি রক্তনালী গুলোকে উন্মুক্ত করে দেয় এবং circulatory system এর ওপর anti-inflammatory প্রভাবও রয়েছে।
হেপাটাইটিস-সি পুরো বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রাণঘাতী রোগ, এ রোগে প্রতিবছর প্রায় ১২,০০০ ব্যক্তি মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়। আক্রাক্ত ব্যক্তিদের ৩০% সুস্থ হলেও, দীর্ঘসময় অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ এর সংস্পর্শে থাকার জন্য অনেক সাইড ইফেক্ট তৈরি হয়। তবে নতুন আবিষ্কার, Sofosbuvir ড্রাগের ব্যবহার prolonged treatment period-কে হ্রাস করে ১২ সপ্তাহে নিয়ে এসেছে। ট্রিটমেন্টের সফলতা প্রায় ৯৫% যা অবশ্যই চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি।
"ক্লাস্টার হেডেক" অন্যতম ভয়ংকরতম মাথাব্যাথা যেটি কয়েক সপ্তাহব্যাপী কিংবা তারও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়। সাধারণত এটি মধ্যরাতে শুরু হয় এবং ব্রেইনের হাফ সাইড এবং same sided চোখে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ে। গবেষকগণ একটি ডিভাইস উদ্ভাবন করেছেন যা upper jaw এর পেছনে implant করা হয়, যা ইলেক্ট্রিকাল পালস ব্রেইনে প্রেরণের মাধ্যমে ব্যাথা হ্রাস করতে সক্ষম। এই ডিভাইসটি আবার রিমোট কন্ট্রোলের অধীন।
Cataract, অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ. সার্জারির মাধ্যমেই এর ট্রিটমেন্ট করা হয়ে থাকে যা খুবই বেদনাদায়ক। সার্জিকাল প্রক্রিয়ায় ছানিযুক্ত লেন্স, কৃত্রিম লেন্স দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে বিজ্ঞানীরা নন-সার্জিকাল ট্রিটমেন্ট প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন। নতুন প্রক্রিয়াজাত আই ড্রপটি (containing compound solution) ছানি দ্রবীভূত করে যা পেইনফুল সার্জারি থেকে মুক্তি দিয়েছে।
আমাদের পরিপাকতন্ত্রে রয়েছে residual bacterial flora, বিজ্ঞানীরা গাট ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন, এবং এই গবেষণায় বেরিয়ে আসছে চমকপ্রদ সব তথ্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গাট ব্যাকটেরিয়া আমাদের মস্তিস্কের কার্যাবলি এবং চিন্তাধারাকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম। এছাড়া গাট ব্যাক্টেরিয়ার সাথে স্থুলতার (obesity) কোন সংযোগ আছে বলেও বিজ্ঞানীরা গবেষণা তথ্যে উল্লেখ করেছেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র বুঝতে শুরু করেছেন, ব্যাকটেরিয়ার ফ্লোরা কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব রাখে। অদূর ভবিষ্যতে গবেষণালব্ধ জ্ঞান কাজ লাগিয়ে ulcerative colitis, crohn's disease, common allergy এবং ক্যান্সারের চিকিৎসাও সম্ভব হতে পারে- বিজ্ঞানীরা এমন আশাই করছেন।
পুরো বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ epilepsy রোগে আক্রান্ত, বাংলায় বলি মৃগীরোগ। আকস্মিক ভাবেই ইপিলেপ্টিক রোগীর ব্রেইনে অনিয়ন্ত্রিত electric disturbance এর জন্য খিঁচুনি হয়, এবং কিছু সময়ের জন্য রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। নতুন আবিস্কার নিউরোপেস, যা ইপিলেপ্টিক রোগীর সামাজিক জীবন অনেকটুকু সহজ করে দিতে সক্ষম। ব্রেইনে ইমপ্ল্যান্টেড সেন্সর ইলেক্ট্রিকাল সিগনাল তৈরি করে যা epileptic attack (seizure) কে প্রতিরোধ করবে।
T-cell রিপ্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে লিউকেমিয়ার experimental treatment-এ অভূতপূর্ব ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ার রোগীর ওপর গবেষণায় প্রায় ৯৪% রোগীর লক্ষণগুলোর elimination সম্ভব হয়েছে এবং প্রায় ৫০% রোগী পুরোপুরি সুস্থতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ক্যান্সারাক্রান্ত ব্যক্তির ইমিউন সেল (T-lymphocyte) সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট ক্যান্সারকে টার্গেট করা হয়। এরপর receptor molecule দ্বারা সংগ্রহকৃত কোষকে রিপ্রোগামিং করে পুনরায় রোগীর শরীরে স্থাপন করা হয়। ইমিউনথেরাপির মাধ্যমে লিউকেমিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য কান্সারের চিকিৎসাও হয়ত সম্ভবপর হয়ে উঠবে আর কয়েক বছরের মধ্যেই।
আর্টিফিসিয়াল হার্ট, কানের পেসমেকার কিংবা আর্টিফিশিয়াল অগ্ন্যাশয়- খুব সম্ভবত আমরা মানবদেহের সমস্ত কিছুই মনুষ্যনির্মিত অর্গান দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হবে। এবং এর সাথে রক্তও! তবে ব্লাড একই সাথে অনেকগুলো কাজ করলেও আর্টিফিশিয়াল ব্লাড এমন ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে তা শুধু অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহন করতে পারে।
চিত্র-৭: সিনথেটিক ব্লাড
সিনথেটিক ব্লাড এর মাধ্যমে রক্তজনিত বিভিন্ন রোগের যেমন সিকল সেল অ্যানিমিয়ার ট্রিটমেন্ট যেন সম্ভব হয়, এই শর্টটার্ম গোল নির্ধারণ করেই বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম রক্ত তৈরির দিকে নজর দিয়েছেন।
নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৪