সাক্ষাৎকার

বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য বন্ধু রোবট বানিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় পদক জয় অরণ্য ও আহনাফের!

আবু নাঈম

১ এপ্রিল ২০২৩
Time Icon  

 ৩ মিনিট

গত ১৭ থেকে ১৯ নভেম্বর ২০২২ এ জার্মানির ডর্টমুন্ট শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ২৪তম ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াড (WRO) এ বাংলাদেশের দুটি দল অংশগ্রহণ করে। 'ফিউচার ইঞ্জিনিয়ার্স' ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়ে 'টিম লেজি-গো' তৃতীয় স্থান ও ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে এবং 'ফিউচার ইনোভেটরস' ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়ে 'টিম রোবোনিয়াম বাংলাদেশ' অষ্টম ও সিলভার পদক অর্জন করে। টিম রোবোনিয়াম বাংলাদেশ এর অন্যতম সদস্য রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ইসরাফিল শাহীন অরণ্য'র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ব্যাপন প্রতিনিধি আবু নাঈম। পাঠক বন্ধুদের অনুপ্রাণিত করতে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলোঃ

ছবিঃ জার্মানির ডর্টমুন্ট শহরে অরণ্য ও আহনাফ


ব্যাপনঃ কেমন আছো অরণ্য?

অরণ্যঃ আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া বেশ ভালোই আছি। রোবটিক্স এবং পড়াশোনা নিয়ে বেশ ভালোই দিনকাল যাচ্ছে এবং নতুন বছরে নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করা শুরু করেছি এবং ভবিষ্যতে রোবট বানানোর দিকে আরো বেশি মনযোগ দিতে চাই।

ব্যাপনঃ World Robot Olympiad এর জাতীয় পর্যায়ে প্রথম হয়ে ওয়ার্ল্ড ফাইনালে ৮ম হয়েছো অর্থাৎ সেরা দশে স্থান করে নিয়েছো। কেমন লাগছে?

অরণ্যঃ অবশ্যই বেশ ভালো লাগছে। কারণ বিষয়টি অনেক আনন্দের ব্যাপার। আসলে আমার জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে যাওয়ার এ জার্নিটা সহজ ছিলো না। বেশ চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। কারণ, যেসময় ন্যাশনাল রাউন্ডটি অনুষ্ঠিত হয় সে সময় আমার এসএসসি পরীক্ষা চলছিল। সেজন্য আমাকে এসএসসি পরীক্ষার মাঝখানে (যেহেতু আমি রংপুর থাকি) রংপুর থেকে ঢাকায় এসে মাত্র ২ দিনের প্রিপারেশন এ ন্যাশনাল রাউন্ডে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। এবং সেই থেকে কিভাবে আমি প্রথম হয়েছি এটা আসলেই অনেক আনপ্রেডিক্টেবল ছিলো। এবং দিন শেষে আমি অশেষ ধন্যবাদ জানাতে চাই সৃষ্টিকর্তাকে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা রিপ্রেজেন্ট করতে পেরেছি, এটা বেশ আনন্দদায়ক। আসলে দেশকে রিপ্রেজেন্ট করার সুযোগ তো সবাই পায় না, আমি সে সুযোগটা পেয়েছিলাম এবং আল্লাহর রহমতে এটাকে কাজে লাগাতে পেরেছি এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

ব্যাপনঃ রোবটিক্সে তোমার যাত্রা শুরু হলো কিভাবে?

অরণ্যঃ আমি প্রায় ৬ বছর ধরে রোবটিক্স করছি, আমার রোবটিক্সের যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালে। সে সময়ে আমি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল, রংপুরে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি এবং সে সময় আমি কেবল ইউটিউব গুগল এই টুল গুলোকে ব্যবহার করা শিখি। অর্থাৎ আমাদের সামনে জ্ঞানের একটা বিশাল জগতের যে একটা জানালা রয়েছে এবং জানালার মাধ্যমে বাইরের জগৎটাকে দেখার যেই বিষয়টি সেটা আমি তখন বুঝতে শিখি। সে সময় আমি ইউটিউবে, গুগলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম এবং হঠাৎই একদিন আমার মাথায় আসে যে রোবট জিনিসটা আসলে কি? রোবট কিভাবে কাজ করে? রোবট নিয়ে পৃথিবীর মানুষ কি করছে না করছে, এটা নিয়ে জানার একটা আগ্রহ জাগে এবং সেখান থেকেই অনলাইনে আমি রোবোটিকস নিয়ে জানতে শুরু করি এবং ঠিক এই সময়টাতে আমাদের স্কুলে রোবোটিকস নিয়ে ১দিনব্যাপী একটা ওয়ার্কশপ হয় এবং সেখানে আমি অংশগ্রহণ করি। প্রথম সেখানে একটা টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে হাতে কলমে একটা একচুয়াল রোবট তৈরী করি। যদিও রোবটটি অত ভালোভাবে কাজ করে নি। কারণ, আমরা সবাই তখন শিখছিলাম কিভাবে একটি রোবট বানাতে হয়। ওই ওয়ার্কশপটাতেই প্রথম আমার রোবোটিক্সের হাতে খড়ি হয়েছিলো এবং তখন থেকেই আসলে বলা যায় যে, এই রোবটিক্স এর জগতে আমার অনুপ্রবেশ। তখন থেকেই রোবোটিক্স নিয়ে কাজ করছি এবং রোবোটিক্স নিয়ে ভালো কিছু করার চেষ্টায় আছি।

ব্যাপনঃ তোমাদের রোবনিয়াম টিম কিভাবে গঠন করলে ও আহনাফের সাথে তোমার পরিচয়?

অরণ্যঃ ২০২১ সালের করোনাকালীন সময়ে, তখন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় আমরা যারা রোবোটিকস নিয়ে কাজ করতাম অনলাইনে বিভিন্ন কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করতাম। তখন রোবটিক্স নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতাম। তো ভলান্টিয়ারিং করতে গিয়ে অনলাইনেই আহনাফের সাথে আমার পরিচয়। এবং সেখান থেকেই সে বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে World Robot Olympiad এর ন্যশনাল রাউন্ডে আমি, আহনাফ এবং আমাদের আরেকজন টিম মেট আতিকুর রহমান ভাইয়া একসাথে আমরা দলগঠন করি, এবং সে অলিম্পিয়াডে আমরা অংশগ্রহণ করি। এবং তখন আমি বুঝতে পারি যে, আহনাফের সাথে আমার বন্ডিংটা বেশ ভালো। কারণ তার দক্ষতা এবং আমার দক্ষতা মিলে যায়। এবং আমাদের চিন্তা ভাবনায় বেশ মিল ছিলো। সেক্ষেত্রে আমরা যদি একসাথে কিছু করি, এখান থেকে একটা ভালো আউটকাম আসবে। সে কারণেই আমাদের মধ্যে ঐ চিন্তাটা চলে আসে যে ভবিষ্যতে যদি কিছু করতে হয় আমাদের এখন থেকেই একসাথে কাজ করতে হবে। যদিও দূর্ভাগ্যবশত আমরা সে বছর ইন্টারন্যাশনাল রাউন্ডে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। তবে তারপর থেকেই ২০২২ সালে আমরা দুজন মিলে দল গঠন করি "রোবোনিয়াম বাংলাদেশ"। এবং এ টিমটা খুবই তাড়াহুড়ার মধ্যে আমরা তৈরি করেছিলাম। কারণ, সে সময় আমার এসএসসি পরীক্ষা চলছিলো। তার মধ্যেও আমাদের কাজ করতে হয়েছিল। সেই থেকেই আমরা "রোবোনিয়াম বাংলাদেশ" রোবোটিকস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

ব্যাপনঃ বন্ধু রোবট 'ডিফড্রয়েড' তৈরীর অনুপ্রেরণা বা আইডিয়া কিভাবে পেলে?

অরণ্যঃ আমাদের WRO তে প্রতিবছর একটা থিম দেওয়া থাকে। গতবছর অর্থাৎ ২০২২ সালে আমাদের থিম ছিলো "My robot my friend" অর্থাৎ "আমার রোবট আমার বন্ধু"।

তো আমাদের এমন একটা রোবট বানাতে হতো যেটা কিনা আমাদের একজন বন্ধু হিসেবে কোনো একজন মানুষকে সাহায্য করে, কিংবা সাহচর্য দেয়। আমাদের আধুনিক বিশ্বে আমাদের বিনোদনের জন্য অনেক ধরণের বন্ধু রোবট অহরহ দেখি যেগুলো হয়তোবা বাচ্চাদের সাথে খেলতে পারে অথবা কথা বলতে পারে। এই থিমটা নিয়ে অর্থাৎ "My robot my friend" নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। ২০২২ সালে আমি যেহেতু এসএসসি পরিক্ষার্থী, তো আমাদের সিলেবাসে বাংলা প্রথম পত্র বইয়ে আমাদের একটা গল্প ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিখা "সুভা" গল্প। এ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী মেয়ের জীবনের গল্প তুলে ধরেন, তাদরে জীবনের স্ট্রাগলগুলোকে তিনি গল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তো আমার স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার হলে আমার মাথায় হঠাৎ করে একটা আইডিয়া আসে আচ্ছা বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য কিছু করা যায় কিনা। তাদের এই যে কমিনিউকেশন গ্যাপ, আমাদের সাধারণ মানুষের সাথে যে তারা কথা বলতে পারে না, এটাকে কি কোনোভাবে সমাধান করা যায় কিনা। তারপর আমি এ আইডিয়াটা নিয়ে আমার টিম মেট আহনাফের সাথে আলোচনা করি এবং শেষ পর্যন্ত আমরা এমন একটা বন্ধুর কথা ভাবি যে বন্ধুটি কিনা একজন বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সাংকেতিক ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজ গুলোকে ট্রান্সলেট করে সাধারণ মানুষের সাথে তার কমিউনিকেশন গ্যাপটাকে দূর করে দিবে। এটা আমরা চিন্তা করি এবং এ আইডিয়াটা নিয়ে আমরা কাজ করা শুরু করে দেই।

ব্যাপনঃ শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরী তোমাদের বন্ধু রোবট 'ডিফড্রয়েড' কিভাবে কাজ করে?

অরণ্যঃ আমাদের রোবটটির নাম ছিলো ডিফড্রয়েড। সে ছিলো একজন বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের বন্ধু। তো আমাদের রোবটটির কাজ হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষেরা যে সাংকেতিক ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজ এর মাধ্যমে কথা বলে থাকে, আমাদের রোবট বন্ধু, সে সাংকেতিক ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজটিকে একটি বিশেষ মেশিন লার্নিং এলগরিদম এর মাধ্যমে ডিটেক্ট করতে পারে এবং এ সাংকেতিক ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজটাকে সে আমাদের সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় রুপান্তর করে আমাদেরকে বলতে পারে। আবার রোবটটি এর উল্টোটাও করতে পারে। অর্থাৎ, আমরা যদি একজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে কথা বলি, তখন আমাদের রোবট 'ডিফড্রয়েড' সে কথাগুলোদেক সাংকেতিক ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজ এ রুপান্তর করে একটি স্ক্রিনের মাধ্যমে সাইনগুলোকে দেখাতে পারে। অর্থাৎ আমাদের একজন বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ সেও কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের কথা গুলো বুঝতে পারবে। এর মধ্যমে আমাদের 'ডিফড্রয়েড' রোবটটি বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ এবং আমাদের মধ্যকার যে যোগাযোগের বাধা ছিল, এটাকে সে সম্পূর্ণভাবে দূর করে দিতে পারে। এটাই ছিলো আমাদের রোবটের কার্যক্রম।

ব্যাপনঃ জাতীয় পর্যায়ে কম্পিটিশনের সময় তোমার এসএসসি পরিক্ষা চলছিলো। কিভাবে সবকিছু ম্যানেজ করেছো?

অরণ্যঃ আমাদের জার্নিটা আসলে বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিলো। ২০২১ সালে WRO তে অংশগ্রহণ করার পর আমাদের ইচ্ছা ছিলো পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে আরো ভালো কিছু করার। এই চ্যালেঞ্জটা নিয়ে আমরা আবার ঝাঁপিয়ে পড়ি রোবট বানাতে। এবং ঠিক দেড় বছরের প্রস্তুতি, রোবট নিয়ে ঘাটাঘাটির পরে যখন ন্যাশনাল রাউন্ডের সময় চলে আসলো, ঠিক সে সময় আমাদের এসএসসি পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেলো। মূলত করোনার কারণে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। আমার মনের মধ্যে তখন একটা ভয় ছিলো যে কোনভাবে এসএসসি পরীক্ষা ও ন্যাশনাল রাউন্ড একই সাথে অনুষ্ঠিত হয় কিনা। আমার ভয়কে সত্যি করে সত্যি সত্যিই এসএসসির ফিজিক্স পরীক্ষা ও ন্যাশনাল রাউন্ড একই দিনে পড়ে গেলো। এতে আমি খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম এবং সবকিছু বাদ দিয়ে পরীক্ষার জন্য মনোনিবেশ করলাম। হঠাৎ করে কোন একটা কারণে দিনাজপুর বোর্ডের পরীক্ষা পিছিয়ে যায় এবং আমরা একটা সুযোগ পেয়ে যাই ন্যাশনাল রাউন্ডে অংশগ্রহণ করার। আমি তখন আসতে চাচ্ছিলাম না পরীক্ষা খারাপ হতে পারে এ ভয়ে। কিন্তু আম্মু তখন আমায় জোর করলেন যেন আমি ন্যাশনাল রাউন্ডে অংশ নিই। তার কথা হচ্ছে তোমার স্বপ্ন যেটার জন্য তুমি দেড় বছর ধরে পরিশ্রম করেছ সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরীক্ষায়ও ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তিনি তখন আমায় ঢাকা পাঠিয়ে দেন। ঢাকা এসে মাত্র দুদিন দুরাত নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে আমরা আমাদের রোবটটি সম্পন্ন করি এবং পরেরদিন ন্যাশনাল রাউন্ডে অংশগ্রহণ করি। আমাদের ধারণা ছিল না যে আমরা কোয়ালিফাই করব। কিন্তু দিনশেষে আমরা একটি গোল্ড মেডেল অর্জন করি। আর এটা ছিল আমাদের পুরো জার্নির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।

২ বছর

শেয়ার করুন

কপি

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করতে লগইন করুন

লগইন রেজিষ্টার