রসায়ন
তাওহীদ জামান
১২ এপ্রিল ২০২৩১৩ মিনিট
তাপ, জ্বালানি ও অক্সিজেন-এই তিনটি বস্তু ছাড়া আগুন কখনও লাগবে না। কিন্তু মজার বিষয় হলো, জ্বলন্ত আগুনে এই তিনটি বস্তুর যে কোনো একটি বিচ্ছিন্ন করতে পারলে আগুন সাথে সাথে নিভে যাবে।
ছোট্ট একটা দেশ আমাদের। তাই বলে দেশ নিয়ে স্বপ্ন কিন্তু ছোট নয় আমাদের। কিন্তু কত শত সুন্দর স্বপ্ন হারিয়ে যায় আগুনে পুড়ে। ভবন তো পোড়ে না, পোড়ে যেন আমাদের এক একটি স্বপ্ন। এক একটি হৃদয়। তোমাদেরও জানা দরকার, কেন, কীভাবে লাগে আগুন। আর আগুন লেগে গেলেই বা কী করবে। দেশে গড়ে প্রায় আট হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণই গড়ে প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়াও ঝরে যায় অসংখ্য মূল্যবান জীবন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বছরজুড়ে যে অগ্নিকাণ্ড হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি ঘটে বছরের প্রথম চার মাসে অর্থাৎ শীত ও বসন্তকালে। ফায়ার সার্ভিসের হিসেব বলছে, ২০১৮ সালে সংঘটিত ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ৭ হাজার ৮২৫টি অগ্নিকাণ্ডই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। চুলার আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ৩ হাজার ৪৪৯টি, আর সিগারেটের আগুন থেকে ৩ হাজার ১০৮টি। দেশে গত ১০ বছরে ছোটবড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৫৯০ জন। এতে ৪ হাজার কোটি টাকার ওপর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে গত বছর। সর্বশেষ বনানীর এফ আর টাওয়ারে ২৩ জন এবং ঢাকার চকবাজারে ৬৭ জন নিহত হয়েছে।
অধিকাংশ শিল্প-কারখানা বা বড় বড় প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নিরাপত্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। একাডেমিক পড়াশোনায় এটা অনেক ক্ষেত্রে পড়ানো হয়, অনেক ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু প্রফেশনাল লাইফে এ সম্পর্কে জানা বেশ জরুরি। বিভিন্ন প্র্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝেই এর ওপর ট্রেনিং-এর আয়োজন করে থাকে।
তিনটি জিনিসের উপস্থিতি আগুন ধরায়। সেগুলো হলো−
ক) পর্যাপ্ত তাপ (Enough heat)
খ) জ্বালানি (Fuel) এবং
গ) অক্সিজেন (Oxygen)।
আর এই তিনটি প্যারামিটার একসঙ্গে একটি ত্রিভুজ তৈরি করে। একে ফায়ার ট্রায়াংগেল (Fire triangle) বলা হয়।
এই তিনটি বস্তুর কোনো একটি ছাড়া আগুন কখনো লাগবে না বা সৃষ্টি হবে না অথবা কেউই আগুন লাগাতে পারবে না। কেবল যখনই একসাথে তিনটি বস্তু সম্মিলিত হবে- কেবল তখনি আগুন উত্পন্ন হবে। মজার বিষয় হলো, জ্বলন্ত আগুনে এই তিনটি বস্তুর মধ্যে যে কোন একটি বিচ্ছিন্ন করতে পারলে আগুন সাথে সাথে নিভে যাবে।
বিভিন্ন জ্বালানির ওপর ভিত্তি করে আগুনের প্রকার :
ক) সাধারণ দাহ্য : এগুলো সাধারণত কাঠ, প্লাস্টিক, কাপড়, কাগজ জাতীয় পদার্থ থেকে উদ্ভূত আগুন। এদেরকে “A Class” ফায়ারও বলে।
খ) দাহ্য তরল : জ্বালানি তেল (পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন ইত্যাদি) সাধারণ দাহ্য দ্রাবক সমূহ। এদেরকে “B Class” ফায়ারও বলে।
গ) দাহ্য গ্যাস : মিথেন, প্রোপেন, হাইড্রোজেন, অ্যাসিটিলিন বা প্রাকৃতিক গ্যস। এদেরকে “C Class” ফায়ারও বলে।
ঘ) চার্জিত ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিট : যুক্তরাষ্ট্রে এগুলোকে “C Class” ক্যাটাগরিতে রাখা হয়।
ঙ) ধাতব দাহ্য : এদেরকে “D Class” ফায়ারও বলে।
চ) রান্নার তেল ও চর্বি : এদেরকে “F Class” ফায়ারও বলে
আগুন লাগলে করণীয় :
স্বয়ং ফায়ার শব্দটার মাঝেই খুব সুন্দর একটা নির্দেশিকা আছে : FIRE
F= Find
I= Inform
R= Restrict
E= Extinguish
আগুন ধরলে আগে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় আগুন লেগেছে, আগুনের উৎস কি? তারপর সবাইকে জানাতে হবে। তারপর একার পক্ষে সম্ভব হলে একাই অথবা দক্ষ জনবল সঙ্গে নিয়ে আগুনের উৎসটিকে আলাদা করে ফেলতে হবে। তবে অবশ্যই একা ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। অতঃপর আগুন নিভানোর কাজ শুরু করতে হবে।
ক) সাধারণত পানি, বালি দিয়ে A Class ফায়ার নিয়ন্ত্রণ করা বা নেভানো যায়।
খ) ‘ড্রাই পাউডার ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ দিয়ে A class, B Class এবং C Class আগুন নেভানো হয়। এজন্য একে ABC ড্রাই পাউডারও বলে।
গ) ফোম জাতীয় ফায়ার এক্সটিংগুইশার A class এবং B Class এর আগুন নেভানো হয়।
ঘ) কার্বন ডাই-অক্সাইড ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে B Class এবং চার্জিত ইলেক্টিক্যাল সার্কিটের আগুন নেভানো হয়।
পানি ছিটিয়ে দাহ্যবস্তুর তাপমাত্রা কমিয়ে অগ্নি নির্বাপণ করা যায় অথবা কেমিক্যাল ব্যবহার করে আগুনের ওপর কৃত্রিম স্তর সৃষ্টি করে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা প্রদান করে অগ্নি নির্বাপণ করা যায় কিংবা দাহ্যবস্তুকে অপসারণ করে অগ্নি নির্বাপণ করা যায়। তবে আগুনের ধরনের ওপর নির্ভর করেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অগ্নি নির্বাপণের পদ্ধতিকে দু’টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়-
(১) পানি প্রয়োগ করে অগ্নি নির্বাপণ : পাত্র দিয়ে পানি বহন ও ছিটিয়ে অগ্নি নির্বাপণের সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নব ঘুরিয়ে আগুনের উৎপত্তিস্থলে প্রবলবেগে পানি স্প্রে করা হয়। যেমন- ফায়ার হাইড্রেন্ট বা স্প্রিংকলার সিস্টেম।
অগ্নি দুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’। এটি মূলত রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল− যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়। ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস− যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কোন জরুরি প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছে মতো যে কোন দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার হয়ে আসছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। এমনকি পাশের দেশ ভারতের কলকাতাকেও এর আওতায় আনা হয় সেই ইংরেজ আমলেই। যেখানে কলকাতাকে মাত্র একটি নদী আর ঢাকাকে বেষ্টন করে আছে চারটি নদী। কিন্তু অপরিকল্পিত এ ঢাকা নগরীতে আজও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। অথচ ফায়ার হাইড্রেন্ট মূলত স্থাপন করা হয়, ঘনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি এলাকায় ও যেসব রাস্তায় অগ্নিনির্বাপক গাড়ি সহজেই প্রবেশ করতে পারে না। নিমতলী এবং চকবাজারের ঘটনায় দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।
খুব সহজে বলতে গেলে ফায়ার হাইড্রেন্ট যুক্ত থাকে একটি বা একাধিক জলাধারের সঙ্গে। আর এর সঙ্গে থাকে অতি শক্তিশালী পাম্প। ব্যবহারের সময় এ পাম্প চালু হয়ে যায় এবং জোরে এর মুখ দিয়ে পানি নির্গত হতে থাকে। চালু হওয়া থেকে পানি বের হওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় লাগে। একটি ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে মিনিটে ১৫০০ থেকে ৫০০০ গ্যালন পানি বের হয়। সাধারণত, ফায়ার হাইড্রেন্টসমূহ শহরের রাস্তার প্রতিচ্ছেদের পাশে বসানো হয়। ফায়ার হাইড্রেন্টের জলাধারগুলো প্রাকৃতিক পানির উৎস যেমন : নদী, লেকের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং এগুলোর অবস্থান পানির উৎস থেকে নীচুতে থাকে− যাতে করে পানির সম-উচ্চশীলতার কারণে উৎস থেকে জলাধারে আপনা-আপনি পানি চলে যায়− যার কারণে ফায়ার হাইড্রেন্টের পানির সরবারহ যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণই থাকে। ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে হোসপাইপের সাহায্যে আগুনের উৎসের কাছে পানি নিয়ে যাওয়া যায়। অধিক নিরাপত্তার কারণে বহুতল ভবনের প্রতি ফ্লোরে সিঁড়ির পার্শ্বে বা নির্দিষ্ট স্থানে দেয়ালে হোস পাইপ সংযুক্ত ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা থাকতে হয়− যাতে প্রয়োজনে হোস পাইপ ভবনের যে কোনো প্রান্ত পর্যন্ত সহজে বহন করা যায়। এতে করে বড় ধরনের অগ্নি দুর্ঘটনায় হোস পাইপের নব ঘুরিয়ে প্রবল বেগে পানি স্প্রে করে অগ্নি নির্বাপণ করা সম্ভব হয়। এ দিকে ৪০০ ফিটের বেশি দূরত্বে ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে হোস পাইপে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ পাওয়া যায় না। ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার জনসংখ্যার একটি কমিউনিটির জন্য ২০০ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করলে প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ৫০০০ গ্যালন পানি প্রবাহ পাওয়া যাবে। যেখানে ৩০০ ফুট দূরত্বের ফায়ার হাইড্রেন্টের জন্য প্রতি মিনিটে ১০০০ গ্যালন পানি প্রবাহ পাওয়া সম্ভব।