ভূবিজ্ঞান
৬ মিনিট
ভেতরের তারুণ্যকে ধরে রাখার বাসনা কার না হয়? কবি চায় বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের ভিতরেও মেঘলুপ্ত সূর্যের ন্যায় প্রদীপ্ত যৌবন। আর আমাদের ধরিত্রী যেন ঠিক এ উপমারই এক মূর্ত প্রতিরুপ। কেননা বাস্তবিকই পৃথিবীর কেন্দ্রের বয়স কিন্তু তার পৃষ্ঠের সাথে সমান তালে বেড়ে চলেনি। বরং হিসাব-নিকাশ শেষে পৃথিবীর কেন্দ্রের বয়স বের হচ্ছে এর পৃষ্ঠের তুলনায় ঠিক ২.৫ বছর কম।
এখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন চলে আসবে- ভূপৃষ্ঠ আবার ভূকেন্দ্র থেকে বয়সে বড় হয় কীভাবে? বরং কেন্দ্রের বয়সই বেশি হওয়া উচিত। আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমদের যথারীতি দ্বারস্থ হতে হবে বর্তমান সময়ের অন্যতম সফল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ‘আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব’-এর কাছে।
আলবার্ট আইনস্টাইন আমদের যে আপেক্ষিকতার নীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এসে এর প্রয়োগক্ষেত্র পূর্ববর্তী সকল ধারণার চেয়েও আরো অনেক বেশি বিস্তৃত। আমরা যেমনটা জানি, গ্রহ, নক্ষত্র বা ব্ল্যাকহোলের ন্যায় বৃহৎ ভরযুক্ত বস্তুর কাছাকাছি এসে আলোর গতি মন্থর হয়ে যায়। আবার এই প্রভাব আমদের চারপাশের নগণ্য অভিকর্ষীয় ক্ষেত্রযুক্ত সাধারণ বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা যায়। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বানুযায়ী বস্তু যত বৃহৎ ভর বিশিষ্ট হবে, তা স্থানকালের জালককে তত বেশি বক্রতা তৈরি করবে। মূলত স্থানকালের এ বক্রতাই মহাকর্ষীয় বল হিসাবে অভিভূত হয়।
চিত্র-১ : স্থানকাল জালকের ওপর ভরের প্রভাব (উৎস : space.com)
কোনো বস্তুর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র যথেষ্ট শক্তিশালী হলে তা সেই বস্তুর পরিপার্শ্বস্থ সময়কেও বস্তুর দিকে বাঁকিয়ে দেয়। ফলে সেই বস্তুকে ঘিরে সময় তখন দ্রুত অতিবাহিত হয়। এই প্রভাব খুব সহজেই প্রত্যক্ষ করতে পারি ভূস্থির উপগ্রহগুলোর ক্ষেত্রে।
আমাদের সকল নেভিগেশন এবং জিপিএস ব্যবস্থা এই কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর ওপর নির্ভরশীল। আর এরকম একটি জিপিএস স্যাটেলাইটের ভেতরে যে আণবিক শক্তিচালিত সূক্ষ্মমানের ঘড়িগুলো থাকে সেগুলো প্রতিদিন পৃথিবীর ঘড়ি হতে ৩৮ মিলি-সেকেণ্ড এগিয়ে যায়। স্যাটেলাইটের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি কম্পিউটার প্রতিদিন সেটিকে পৃথিবীর ঘড়ির সাথে মিলিয়ে ঠিক করে নেয়। তা না হলে মাত্র একদিনের ব্যবধানে কোনো লোকেশনের সত্যিকারের অবস্থানের সাথে জিপিএস থেকে প্রাপ্ত অবস্থানের পার্থক্য হতো দশ কিলোমিটার!
এবার নজর দেয়া যাক পৃথিবীর দিকে। আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্র যে বিশাল ভর ধারণ করে, তা কিন্তু ভূপৃষ্ঠের ওপর যথেষ্ট শক্তিশালী মহাকর্ষীয় প্রভাব তৈরি করে। যা আমাদের কাছে অভিকর্ষ বল হিসাবে পরিচিত। আর এ অভিকর্ষীয় বলের প্রভাবেই সময় ভূকেন্দ্রের তুলনায় ভূপৃষ্ঠে দ্রুত অতবাহিত হয়। এই ধারণাটি সর্বপ্রথম বিজ্ঞানীমহলে তুলে ধরেন তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, স্থানকালিক বক্রতা তত্ত্বানুযায়ী পৃথিবীর কেন্দ্র ও ভূত্বকের মধ্যে কমপক্ষে এক বা দুইদিনের সময় পার্থক্য থাকা উচিত।
চিত্র-২ : রিচার্ড ফাইনম্যান
ফাইনম্যানের রিসার্চ পেপারগুলো এবার বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলল। ভূকেন্দ্র আর ভূপৃষ্ঠের মধ্যে সময়ের পার্থক্য রয়েছে এটাতো স্পষ্ট হলো, এবার পার্থক্যটা ঠিক কতো সেটিও বের করে ফেলা প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজন বোধহয় সবচেয়ে বেশি অনুভব করলেন পদার্থবিদ উলরিক ইঙ্গার্সলেভ উগারহোজ (Ulrik Uggerhøj)। ডেনমার্কের প্রখ্যাত আরহাস ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক তার তত্ত্বাবধানে একটি দল গঠন করে মনোনিবেশ করলেন ভূকেন্দ্র ও ভূপৃষ্ঠের মহাকর্ষীয় বিভব বা Gravitational potential-এর জটিল সব হিসাব নিকাশ মেলাবার কাজে ।