স্বাস্থ্য
সাব্বির আহমেদ
১৪ মে ২০১৮৪ মিনিট
বন্ধুরা কেমন আছো তোমরা? দেখতে দেখতে আবারো মহান রমাদান মাস চলে এলো আমাদের সামনে। তোমরা তো জানই এই মাসে কুরআন নাজিল হয়েছিল। তাই এই মাসকে আল্লাহ তা’য়ালা মুসলিমদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর সন্তোষ অর্জন। রোজার ধর্মীয় দিক ছাড়াও রয়েছে শারীরিক বেশ কিছু উপকারিতা। আত্মিক ও দৈহিক উপকারিতার জন্য মাঝে মধ্যে রোজা রাখার চেষ্টা করা সবারই উচিত। আজ আমরা জানবো রোজার কয়েকটি শারীরিক উপকারিতা।
সারা বিশ্বে স্থূলতা একটি বড় সমস্যা। একসময় যখন বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা ছিলো না, তখন আমাদের ফলন ভালো হতো না। উন্নত জাতেরও অভাব ছিল। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে এই বিষয়গুলো অনেকটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। ফলে বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ অনেক বেশি হলেও খাদ্যের অভাব নেই। তাই ১০০ বছর আগের সমস্যা 'খাদ্যের অভাব ও পুষ্টিহীনতা' এখন নাই। নতুন সমস্যা যেটা সৃষ্টি হয়েছে সেটা হলো স্থূলতা। সব বয়সের মানুষ এখন স্থূলতায় আক্রান্ত। এরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা। সব কাজ এখন আমরা ঘরে বসেই করতে পারি।
আমরা এখন সোফায় বসে সেলফোনে ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসি। মাঠে খেলতে পছন্দ করিনা। এজন্য শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর অন্যতম নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো রোজা রাখা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা উপোষ করলে অনেক বেশি ক্যালরি ক্ষয় হয়। এনার্জির জন্য শরীর ফ্যাট সেলগুলোকে ভেঙ্গে দেয়। নিয়মিত ডায়েটিং করার চেয়ে ক্যালরি ক্ষয়ের জন্য মাঝে মধ্যে রোজা রাখা অনেক বেশি কার্যকরি।
আমরা তো সারাদিনই খাই। আর আমাদের খাবার তালিকায় সবচেয়ে বেশি থাকে জাঙ্ক ফুড। এর কারণে আমাদের হজমে প্রায়ই সমস্যা হয়। রোজায় আমাদের পাকস্থলি বিশ্রাম পায়। ফলে হজম ক্ষমতা বাড়ে। এর ফলে শরীরে মেটাবলিজমের হার বৃদ্ধি পায়। কারোর হজম ক্ষমতা দুর্বল হলে মেটাবলিজমের হারও কমবে। ফলে শরীরে ক্যালরি ক্ষয় কম হবে। রোজা হজম ক্ষমতাকে নিয়মিত করতে সাহায্য করে।
তোমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকে আছে যারা খেতে চায় না। যাই খেতে দেয়া হয় তাতেই তারা বিরক্ত হয়। এটা এক ধরনের রোগ। রোগের নাম ক্ষুদামন্দা। রোজা রাখলে ক্ষুধার অনুভূতি শক্তি বাড়ে। এর ফলে শরীরে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় হরমোন সঠিকভাবে ক্ষরণ হয়। এক মাস রোজা রাখলে এই ক্ষুধামন্দার সমস্যা দূর হয়ে যাবে। এছাড়াও মাঝে মধ্যে রোজা রাখলে এই রোগ আর থাকবে না।
রোজার ফলে মস্তিষ্কের ক্রিয়া আরও উন্নত হয়। রোজার সময় নিউরোট্রফিক নামে বিশেষ প্রোটিন অধিক উৎপন্ন হয়। এই প্রোটিন মস্তিষ্ককে আরো সজাগ করে তোলে এবং অক্সিডেশনজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
রোজায় শরীর থেকে বেশি মাত্রায় টক্সিন বেরিয়ে যায়। ফলে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যাল কম উৎপন্ন হয়। ফ্রি র্যাডিক্যাল কমে যাওয়ায় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এমনকি শরীরে ক্যান্সার বাসা বাঁধার আশঙ্কাও কমে। রোজা রাখলে শরীরের ক্ষতিকারক ট্রাইগ্লিসারাইড এবং খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে আসে। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়। রোজা রাখলে স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণের পরিমাণ কমে এবং মেটাবলিক রেট হ্রাস পায়। ফলে রোজা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে এবং হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। রোজার কারণে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে। এটা ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বুড়ো হতে কে চায় বলো? সবাই চায় তরুণ হয়ে থাকতে। নিয়মিত ডায়েটিং করলে একজন মানুষের দেহে যে প্রভাবগুলো পড়ে, মাঝে মধ্যে রোজা রাখলেও সেই একই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রোজা রাখার ফলে দেহে এমন কিছু প্রোটিন উৎসারিত হয় যেটা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে অক্সিডেশনজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং স্নায়ুকোষের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। ফলে বয়সজনিত রোগ যেমন, অ্যালঝেইমার, হান্টিংটন বা পার্কিনসন্সের ঝুঁকি অনেকখানি কমে যায়। কয়েক ঘণ্টা পরপর নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ রক্তে শর্করার মান সবসময় উঁচু রাখে। শক্তি উৎপাদনের জন্য এই শর্করাকে বিপাক হতে হয়। এই বিপাকের একটি উপজাত হলো জারণ।
এই জারণের ফলে দেহে সৃষ্টি হয় অস্থিতিশীল অক্সিজেন অণু, যার সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পরিণতি হলো বুড়িয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করা। কিন্তু রোজা এই প্রক্রিয়াকেই পাল্টে দেয়। একটা বড় সময় অনাহারের ফলে দেহে যে সাময়িক শক্তি সংকট হয় তা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে প্রোটিন উৎপাদনে উৎসাহ দেয়, এমনকি নতুন ব্রেন সেলও জন্মায়।
ডায়াবেটিস তো এখন বাংলাদেশে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে। রোজা রাখলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া মানে দেহকোষগুলোতে ইনসুলিনের স্থিতিশীল সরবরাহ। এই তৃপ্ত এবং অলস কোষগুলো তখন হয়ে যায় ইনসুলিন-রেজিস্ট্যান্ট। আর ডায়াবেটিসের লক্ষণ এটাই। কিন্তু মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিলে এ কোষগুলো আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং বিপাক করতে পারে দক্ষভাবে। এতে ইনসুলিনের সরবরাহ বাড়ে। কোষগুলো আরো অধিক হারে গ্লুকোজ গ্রহণ করতে পারে। ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চরক্তচাপ এবং হার্ট-অ্যাটাকের আশংকাও কমে।
মানুষের শরীরে সাধারণত ২ ধরনের কোলেস্টরেল লক্ষ্য করা যায় একটা হলো HDL। এটা উপকারি কোলেস্টেরল। আরেকটা হলো LDL এবং এটা অপকারি। এই LDL কোলেস্টরেল যদি বেড়ে যায় তাহলে, আমরা রক্তে কোলেস্টরেল বেড়ে যাওয়া বলি। আর এটি বেড়ে যাওয়ার পিছনে প্রধান কারণই হলো খাদ্যদ্রব্য! এই যেমন- কোল্ড ড্রিংক, ডিমের কুসুম, মাখন, পনির, ফাস্ট ফুড, মাংস ইত্যাদি। এছাড়াও পর্যাপ্ত না ঘুমানো কিংবা শারীরিক পরিশ্রম না করলেও বেড়ে যেতে পারে। রোজা রাখলে অনেক সময় ধরে যখন খাবার খাওয়া হয় না তখন শরীরের ক্ষতিকারক ট্রাইগ্লিসারাইড এবং খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে আসে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের কয়েকজন কার্ডিওলজিস্ট একদল স্বেচ্ছাসেবীর ওপর একটি গবেষণা চালান। ৩০ দিন রোজা রাখার পর দেখা গেল দেহের ওজন বা সুস্থতাবোধের ওপর কোনো প্রভাব না পড়লেও তাদের রক্তের লিপিড প্রোফাইলের ওপর চমৎকার প্রভাব পড়েছে। অর্থাৎ তাদের রক্তে এলডিএল বা ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমেছে।
রোজায় শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বেশি পরিমাণে বেরিয়ে যাওয়ায় ত্বক পরিষ্কার হয়। লিভার, কিডনির কাজ আরো ভালোভাবে ফাংশনাল হওয়ায় ত্বকে দাগ, ব্রণ নির্মূল হয়। ত্বকে অতিরিক্ত তৈলের প্রভাব কমে।
মে-জুন ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ১