I সাবরিনা সুমাইয়া I 

সমুদ্রের অথৈ নীল জলরাশির তীরে সাদা বালিয়াড়ীতে পড়ে থাকা ঝিনুক সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে।  কিংবা কোনো চপল বালিকার গলায় মালা হয়ে শোভা পায় ঝিনুকগুচ্ছ, তার কণ্ঠের শোভাবর্ধন করে। তবে ঝিনুকের মূল আবেদন এর বুকে লুকিয়ে থাকা মুক্তা। মু্ক্তার উজ্জ্বলতা এবং চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য্য প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের নজর কেড়েছে। ধাতুর মতো চাকচিক্য আর বাহারী রঙের কারণে মুক্তা মানবসমাজে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।

নিজ গুণের বদৌলতে মুক্তা হয়ে উঠেছে অপার সৌন্দর্য্য আর দুর্লভ ও মূল্যবান সম্পদের উপমা। হয়ে উঠেছে সমাজের আভিজাত্য ও প্রাচূর্য্যের প্রতীক। মানবসভ্যতায় মুক্তার এতই গুরুত্ব, এতই মাহাত্ম্য। মুক্তা নিয়ে তোমরাও নিশ্চয়ই নানা কথা শুনেছো। কেউ কেউ চোখেও দেখেছে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছো মুক্তা আসলে কী? এটি কী দিয়ে তৈরি? কীভাবে তৈরি হয় এই আজব বস্তুটি?

প্রাথমিকভাবে বলতে গেলে, মুক্তা এক ধরনের উজ্জ্বল কঠিন পদার্থ। এটি মলাস্কা পর্বের কোনো প্রাণীর নরম কোষকলার (ম্যান্টল) অভ্যন্তরে তৈরি হয়। মুক্তা মূলত ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সূক্ষ্ম স্ফটিক। ক্যালসিয়াম কার্বনেটের আকরিক অ্যারগোনাইট আর ক্যালসাইটের সাথে বিশেষ ধরনের প্রোটিন কঙ্কয়লিনের সংমিশ্রণে মুক্তা তৈরি হয়। একটি আদর্শ মুক্তা নিখুঁত গোলাকৃতির এবং মসৃণ হয়ে থাকে। তবে মুক্তা অনিয়মিত আকৃতিরও হয় যাকে বলা হয় বারক মুক্তা।

চিত্রঃ অ্যারগোনাইট

উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন প্রাকৃতিক মুক্তাকে মূল্যবান রত্ন জ্ঞান করা হয়। এরকম কোনো মুক্তা কোনো বহুমূল্য পাথর বা ধাতুর মতোই দামী। মুক্তা তিন ধরনের হয়। প্রাকৃতিক,  কৃত্রিম বা চাষকৃত এবং নকল মুক্তা। এদের মধ্যে প্রাকৃতিক মুক্তার কদর সবচেয়ে বেশী। মুক্তা বিচিত্র রঙ ও বর্ণের হয়। লাল, নীল,সবুজ, হলুদ, সোনালী, গোলাপি, বাদামী, কালো প্রভৃতি বৈচিত্র্যময় রঙের এসব মুক্তার প্রত্যেকটিই দেখতে সুন্দর হয়।

চিত্রঃ ক্যালসাইট 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মুক্তা তৈরি হয় কীভাবে?

আগেই বলেছি, মুক্তা তৈরি হয় মলাস্কা পর্বের কোনো প্রাণীর শরীরে। ঝিনুক, শামুক প্রভৃতি প্রাণী সবচেয়ে পরিচিত মলাস্ক। এ জাতীয় প্রাণীদের শরীরের দুইটি অংশ থাকে। বাইরের শক্ত খোলস ও ভেতরের নরম মাংস। খোলসের ফাঁক দিয়ে ভেতরের নরম মাংসে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ যেমন- বালিকণা, সাগরে ভাসমান কোনো খাবারের টুকরো প্রভৃতি প্রবেশ করলে পদার্থটি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মলাস্ক এক ধরনের পদার্থ নিঃসরণ করতে শুরু করে যাকে বলে নেকার। নেকারের প্রলেপ বছরের পর বছর ধরে পড়তে পড়তে একসময় একটি নিয়মিত বা অনিয়মিত আকৃতি ধারণ করে যাকে আমরা মুক্তা বলি।

নেকার হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বনেট আর কঙ্ককয়লিনের মিশ্রণ। সত্যিকার অর্থে,  বাইরের কোনো পদার্থের প্রতি সাড়া দিয়ে নেকার নিঃসরণের ঘটনা খুব কমই ঘটে। সাধারণত মলাস্কের শরীরের অভ্যন্তরে কোনো পরজীবীর আক্রমণ বা ম্যান্টলের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণেই বেশি নেকার ক্ষরণের ঘটনা ঘটে।

চিত্রঃ মুক্তার গঠন 

মুক্তার গঠন প্রক্রিয়া

প্রাকৃতিক মুক্তা এভাবে তৈরি হয়। পরিণত মুক্তার রূপে গুণে আকর্ষণীয় হয়। কোনো ঝিনুকের পেটে মুক্তা পরিপক্ক হলে তা কোনো সৌভাগ্যবান মুক্তাশিকারীর হাতে পড়ে আর তার কপাল খুলে যায়।  কৃত্রিম মুক্তা তৈরি হয় কোনো মুক্তাখামারে। এখানে ঝিনুকের নরম মাংস কেটে কোনো উত্তেজক পদার্থ বসিয়ে দেয়া হয়। ফলে ঝিনুকটি নেকার ক্ষরণ শুরু করে ও একসময় মুক্তায় পরিণত হয়। উত্তেজক পদার্থটি হয় সাধারণত এক টুকরো মুক্তাচূর্ণ যাকে Mother of pearls বলা হয়।

সব ধরনের মলাস্ক কম বেশি মুক্তাজাতীয় কোনো পদার্থ তৈরি করে । তবে বাণিজ্যিকভাবে যেসব মুক্তার গুরুত্ব আছে তা তৈরি করে শুধু দুই ধরনের মলাস্ক- বাইভালভ ও ক্ল্যাম্প। স্বাদুপানির ও লোনাপানির মলাস্ক মুক্তা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, লোনাপানির মুক্তা অপেক্ষাকৃত বেশি উন্নত হয়। তবে আজকের বাজারে যেসব কৃত্রিম মুক্তা বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই স্বাদুপানির মুক্তা।

আর নকল মুক্তা তৈরি হয় কাঁচ থেকে। প্রাকৃতিক মুক্তা থেকে কৃত্রিম মুক্তার পার্থক্য নির্ণয় করা হয় এক্স-রের সাহায্যে এদের আণবিক গঠন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মাধ্যমে।

নকল মুক্তা আর আসল মুক্তা খুব সহজেই চেনা যায়। আসল মুক্তার তুলনায় নকল মুক্তার উজ্জ্বলতা অনেক কম থাকে। মুক্তার মান নির্ভর করে করে এর উজ্জ্বলতা, আকার-আকৃতি, রঙ প্রভৃতির উপর। মুক্তার বাইরের পৃষ্ঠের আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ ও বিচ্ছুরণের ক্ষমতা থেকে মুক্তার উজ্জ্বলতা বোঝা যায়।

আগে প্রাকৃতিক মুক্তা পৃথিবীর নানা প্রান্তে পাওয়া যেত। এখন শুধু বাহরাইনের উপকূলে পাওয়া যায়।

কৃত্রিম মুক্তার বেশিরভাগ আসে চীন থেকে। তবে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ তাহিতি, ফিজি ও কুক আইল্যান্ডেও প্রচুর মুক্তার চাষ হয়। একসময় মানুষ কৃত্রিম মুক্তাকে বাঁকা চোখে দেখলেও এখন কৃত্রিম মুক্তার কদর বেড়েছে। উন্নত দেশের ধনাঢ্য মহিলারাও আজকাল কৃত্রিম মুক্তার হার স্বাচ্ছন্দে পরে থাকেন।

মুক্তা কঠিন হলেও এটি অ্যাসিটিক অ্যাসিডের দ্রবণে দ্রবণীয়। এমনকি অনেক দুর্বল অ্যাসিডের দ্রবণেও মুক্তা দ্রবীভূত হয়।