দেশের গণ্ডি পেরিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সফলতা পাচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। অনেক শিক্ষার্থী আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাদেশের। নবম ইউনিভার্সিটি ফিজিকস কমপিটিশনে রৌপ্যপদক জিতেছে বাংলাদেশের দুটি দল। যার একটি হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি টিম ৪১৩)।

ব্যাপন সব সংখ্যা ৯৯৯!

বন্ধুত্বের ভালোবাসা, আন্তরিকতা আর ফিজিক্সের নানা কারিকুরি নিয়ে আগ্রহ আর শেখার উদ্দীপনায় একসাথে পথচলা। নানা খুনসুঁটির মাঝেও নিজেদের পড়াশোনা ঠিকই কিন্তু চালিয়ে নিচ্ছে, নানা প্রতিযোগিতায় জিতছে পদক। হ্যাঁ, বলছিলাম শাবিপ্রবি দলটির সদস্য, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, তিন বন্ধু মোহাম্মদ আবরার নাফি, নওশের জাহান ও ওলিউর রহমান সম্পর্কে।

ক্যাম্পাসে ঘুরতে গিয়ে টিম ৪১৩ এর অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ আবরার নাফির সাথে দেখা হয়ে যায় ব্যাপন প্রতিনিধি ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (ইইই) কায়সারের সাথে। পাঠক বন্ধুদের অনুপ্রাণিত করতে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ এবারের সংখ্যায় তুলে ধরা হলো-

ব্যাপন: কেমন আছো নাফি? 

নাফি: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ব্যাপনে সাক্ষাৎকার দিচ্ছি- অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছে নিজের মাঝে।

ব্যাপন: তোমাকেও আমাদের মাঝে পেয়ে ভালো লাগছে। যাহোক, তোমার পড়াশুনা কেমন চলছে? তোমার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউণ্ড নিয়ে আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলো।

নাফি: আলহামদুলিল্লাহ, পড়াশুনা মোটামুটি ভালো হচ্ছে। আমি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এইসএসসি সম্পন্ন করেছি। বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।

ব্যাপন: ইউনিভার্সিটি ফিজিক্স কম্পিটিশন প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪২৫ টি টিমকে পেছনে ফেলে রৌপ্যপদক জয় করেছো। তোমাদের কৃতিত্বে বাংলাদেশের নামটি আরেকবার বিশ্ব দরবারে উচ্চারিত হয়েছে। এজন্য তোমাদের অভিনন্দন। ব্যাপন বন্ধুদের জন্য আন্তর্জাতিক এ নামকরা প্রতিযোগিতার ব্যাপারে কিছু বিষয় শেয়ার করো।

নাফি: এটা মূলত আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্রতিযোগিতা। ফিজিক্স নিয়ে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারোল কলেজের প্রফেসর কেলি এস ক্লিনের পরিচালনা এবং ইউনিভার্সিটি অব উইনিপেগের অধ্যাপকসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিকভাবে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য প্রতিযোগিতার চেয়ে এটা কিছুটা ভিন্ন। এখানে অনলাইনে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান চেয়ে। প্রতিযোগিতায় দুটি সমস্যা দেওয়া হয়েছিল। প্রবলেম ‘এ’ ও প্রবলেম ‘বি’। এই দুইটা সমস্যার সমাধান করে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে একটা অফিসিয়াল ফরমাল পেপারে জমা দিতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে জমা হওয়া সর্বমোট পেপারে যতগুলো সঠিক সমাধান পাওয়া যায়, সবচেয়ে ভালো বিবেচনায় তার ২% স্বর্ণপদক দেওয়া হয়, আর ১৫-২০% হচ্ছে রৌপ্যপদক এবং ২৫-৩০% হচ্ছে ব্রোঞ্জপদক।

ব্যাপন: বাংলাদেশ থেকে কয়টি দল এবার এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে?

নাফি: সংখ্যাটা সঠিকভাবে বলতে পারবো না। হতে পারে ২০ টার মতো টিম অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের ভার্সিটি থেকে ৯টা টিম প্রতিযোগিতায় ছিলো।  

ব্যাপন: এটা কি বিভিন্ন রাউন্ডে হয়, নাকি একবারেই হয়?

নাফি: না, এটা একবারেই হয়। পুরো বছরে ৪৮ ঘন্টা সময় থাকে এবং এই প্রতিযোগিতায় সমস্যাগুলোর সমাধানে যে কোনো বই, রিসার্চ পেপার, ইন্টারনেটের সহায়তা নেওয়া যায়। বলা চলে, অনেকটা ওপেন বুক এক্সাম। তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে কোন শিক্ষক বা অন্য কোন টিমের সহায়তা নেওয়া যাবে না। এটা নিশ্চিত করবেন নির্দিষ্ট ঐ টিমের স্পন্সর বা গাইড, যিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক হিসেবে আছেন।

ব্যাপন: তাহলে এটা তো অসাধারণ একটি প্রতিযোগিতা। তোমাদের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার পিছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিলো?

নাফি: বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অনেকটা বাধ্য হয়ে হয়ত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। কিন্তু তার কিছু সময় পর থেকেই এ বিষয়ে আগ্রহটা তৈরি হয়। শিক্ষকদের আন্তরিকতায় ভালোলাগা বাড়তে থাকে দিনকে দিন। এদিকে আমরা লক্ষ্য করছিলাম যে, আমাদের সিনিয়র ভাইয়েরা অনেকেই বিভিন্ন সময়ে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে।

এর মধ্যে সিনিয়রদের একটা গ্রুপ আবার রৌপ্য পদকও জয় করেছিলো। যা দেখে আমাদের মাঝেও প্রবল আগ্রহ-উদ্দীপনা কাজ করছিলো। তারপরও আমরা ভয়ে ছিলাম, এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিব কিনা। সিনিয়র ভাইদের দেখাদেখি আমরা প্রথম অংশগ্রহণ করি ৩য় বর্ষে থাকাকালীন। প্রথমবার অংশগ্রহণ করে আমরা ব্রোঞ্জপদক অর্জন করি, যা আমাদের উৎসাহ ও আত্নবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়।

আলহামদুলিল্লাহ, এবার তো রৌপ্যপদক জয় করলাম।

ব্যাপন: আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এমন একটি প্রতিযোগিতায় অনেককে পেছনে ফেলে তোমাদের এ অর্জন। তোমাদের এ অর্জনের পথে সহায়ক হিসেবে কি ছিলো? আর সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে তোমাদের অনুভূতি কেমন?  

নাফি: সাফল্যের জন্য ভালো লাগছে অবশ্যই। পরিবারের সদস্যরাও মহাখুশি। শিক্ষকদের কাছ থেকেও বাহবা পাচ্ছি।

আমাদের শিক্ষকরা অনেক বেশি সহযোগী ছিলেন। যেহেতু এই প্রতিযোগিতা ৪৮ ঘন্টাব্যাপী হয়ে থাকে, সেহেতু আবাসিক হল অথবা মেসে থেকে অংশগ্রহণ করা কঠিন হয়ে যায়। যেমন- ৪৮ ঘন্টা থাকা, খাওয়া আরও অন্যান্য কাজ।

তাই শিক্ষকরা এটার ম্যানেজমেন্ট না করলে কোনভাবেই সম্ভব হতো না। বিশেষ করে ইয়াসমিন হক ম্যাডামের অবদান অনেক বেশি। আর আমাদের থাকা-খাওয়া-আবাসনের সকল ব্যবস্থা ভার্সিটি থেকেই করা হয়।

ব্যাপন: প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে কি কোনো প্রতিবন্ধকতা কিংবা সমস্যা মনে হয়েছিল?

নাফি: প্রতিবন্ধকতা না। তবে বিষয়টা এমন হচ্ছে যে, আমরা যখন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি, আমাদের তো সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রথমে ফিজিক্স নিয়ে পড়ার সময় যদি একটু ভয় থাকে, যেমন আমরা ক্লাসিকেল প্রবলেমগুলো সলভ করতে পারবো কিনা? যে ভয় নিয়ে অনেকে অংশগ্রহণ করতে চায় না।

তবে একবার অংশগ্রহণ করে ফেললে অভিজ্ঞতা হয়ে যায় আর কি! আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের হায়ার ম্যাথম্যাটিক্স আর প্রোগ্রামিং এ খুব বেশি এক্সপার্ট না হওয়ার কারণে ঐসব ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে যায়। অথচ আমাদের উচিৎ ছিল, হায়ার ম্যাথম্যাটিক্স আর প্রোগ্রামিং এ আরেকটু ভাল প্র্যাক্টিস থাকা।

ব্যাপন: এ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তোমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তোমরা কি এই প্রতিযোগিতায় আরও অংশগ্রহণ করতে চাও?

নাফি: যেহেতু এটা আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলের প্রতিযোগিতা, তাই আমরা আর এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারছি না। আমাদের অনার্স প্রায় শেষ, আর মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি। কিন্তু আরো বিভিন্ন লেভেলের প্রতিযোগিতা আছে ফিজিক্সের। খুব বেশি না হলেও অল্প প্রতিযোগিতা আছে। সেগুলোতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা আছে।

ব্যাপন: বিজ্ঞান নিয়ে তোমার মূল আগ্রহের জায়গা কি? অথবা এ নিয়ে ভবিষ্যতে কি করতে চাও?

নাফি: এখন ফিজিক্স নিয়ে আমার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। ফিজিক্সের কোন একটি ফিল্ডে উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণা করার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে।

ব্যাপন: বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী কিংবা নতুন যে সকল শিক্ষার্থী আছে, তাদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে তুমি কী পরামর্শ দিবে?

নাফি: পরামর্শ একটাই- সকল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হবে। আমাদের মূল সমস্যা, আমরা অংশগ্রহণ করি না। মনে ভয় কাজ করে, আগে ধারণা করে বসে থাকি যে- কিছুই পারবো না কিংবা প্রবলেম হিসেবে আরও কঠিন কিছু হবে। আমরাও প্রথমদিকে এই ভয়ের জন্যই অংশগ্রহণ করিনি। পরে দেখা যায় যে, অনেক সময় নিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করা যায়, মানে নতুন নতুন অনেক কিছু শেখা যায়। আর, হ্যাঁ, সমস্যার সমাধানও হয়ে যায়।

ব্যাপন: বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যয়নরত বিজ্ঞানপ্রেমী শিক্ষার্থীদের জন্য তোমাদের পরামর্শ কী? ফিজিক্স শেখা ও ভালোলাগার ক্ষেত্রে আলাদাভাবে তোমাদের কোন দিক-নির্দেশনা আছে কিনা?

নাফি: জানা আর শেখার আগ্রহ থেকে বিজ্ঞানপ্রেমী হয়। তাই বিজ্ঞান নিয়ে নিয়মিত জানতে হবে, পড়তে হবে। অযথা বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে হবে। আর ফিজিক্স শিখতে হলে আগ থেকে ভাল গণিত জানতে হবে। তাহলে আমরা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়েছিলাম, সে সমস্যাগুলো তাদের পক্ষে কাটানো সম্ভব। আরেকটা পরামর্শ হচ্ছে, লেগে থাকা ও ধৈর্য ধরা। যেকোন কাজে নিয়মিত থাকলে সাফল্য আসবেই ইনশাল্লাহ। আর শিক্ষকরা সহায়ক হলে, পথচলা অনেক সহজ হয়ে যায়।

ব্যাপন: দ্বিমাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী ব্যাপন নিয়মিত পড়ো কি? ব্যাপন নিয়ে কিছু বলো।

নাফি: জি, চেষ্টা করি নিয়মিত পড়তে। এককথায়- অসাধারণ। বিজ্ঞান সম্পর্কিত এমন একটি আকর্ষণীয় পত্রিকা দরকার ছিলো।    

ব্যাপন: তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। আগামীতে আরও সাক্ষাৎকার নিতে আন্তর্জাতিক কোন প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতবে- এ প্রত্যাশা আর শুভকামনা তোমাদের জন্য।

নাফি: দোয়া করবেন আমাদের জন্য। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সাথে ব্যাপন পরিবারের সকলকে।    

মার্চ-এপ্রিল ২০১৯। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৬