|সোহান বিন আব্দুল্লাহ।

“ইলিশ মাছ জীবন রহস্য উদ্‌ঘাটন করলেন বাংলাদেশের দু দল গবেষক ।“

জাতীয় দৈনিকগুলিতে এমন শিরোনামের খবরই ছাপা হয়েছে কিছুদিন আগে । কিন্তু প্রশ্ন হল জীবের জীবনরহস্য আসলে কীভাবে উদ্‌ঘাটন করা হয় ? আর ইলিশ মাছের জীবনরহস্য ঘেটেই বা কি হবে? মাথায় ঘুরতে থাকা এই কৌতূহল থেকেই লিখতে বসলাম । এসো প্রথমেই জেনে নিই “ জীবন রহস্য “ উদ্‌ঘাটনে সুনির্দিষ্ট কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করা হয়।

জীবনরহস্য কীভাবে নির্ণয় করা হয় ??

জীবনরহস্য  উদ্‌ঘাটনে জীবের Genome sequencing জানার চেষ্টা করা হয় । জিনোম হচ্ছে কোন জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। অর্থাৎ, এর জীবনচক্রের প্রতিটি ধাপে যত  কার্যক্রম রয়েছে সেগুলি পরিচালনার জন্যে যে নির্দেশনা প্রয়োজন তার  সংরক্ষণস্থল । উদাহরণস্বরূপ, জীবের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জিনোমের মাধ্যমে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, জিনোম DNA ( Deoxyribonucleic Acid ) বা RNA ( Ribonucleic Acid ) দিয়ে গঠিত। ইলিশের জিনোমে ৭৬ কোটি ৮০ লাখ Nucleotide রয়েছে যা মানুষের জিনোমের প্রায় এক চতুর্থাংশ।

ইলিশ এর জীবনরহস্য জেনে কী হবে?

প্রথমেই বলে রাখি, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এককভাবে সর্বাধিক অবদান রাখছে জাতীয় মাছ ইলিশ । একক প্রজাতি হিসাবে বাংলাদেশে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ, মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২% (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক ) । যেখানে বাংলাদেশের মোট প্রায় ৭৩৫ প্রজাতির ( ২৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ আর ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ )-সূত্রঃউইকিপিডিয়া । মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে।তাহলে বুঝতেই পারছো, আমাদের দেশের মাছের চাহিদা মেটাতে ইলিশ মাছ যেন one man army  এর ভূমিকা পালন করছে । অন্যদিকে, পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ৬০% উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। অর্থাৎ,ইলিশকে বিশ্ববাজারে “বাংলাদেশের মাছ” বলে পরিচয় দিলে ভুল হবে না !

 

name of scientists

 

আবার, এদেশের প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষভাবে ইলিশ আহরণের সাথে জড়িত।কাজেই এই জাতীয় সম্পদের যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা যায় তবে আমাদের দেশের ইলিশ নির্ভর অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করা যাবে

গবেষকদের মতে, ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স জানার মাধ্যমে অসংখ্য অজানা প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে খুব সহজেই………

  • “ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকে। শুধুমাত্র ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। আর এই পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যাবে এরা কখন, কোথায় ডিম দেবে?” অর্থাৎ , জীবন রহস্য উন্মোচনের দ্বারা এখন ইলিশের মৌসুমে ডিম সংগ্রহের সম্ভাবনা তৈরী হল ।
  • আমরা ইলিশের আচরণগত বৈশিষ্ট্য শুধু জানি। ইলিশ সমুদ্রে থেকে নদীতে আসে, আবার নদী থেকে সমুদ্রে ফিরে যায়, কেন ইলিশের এই আসা-যাওয়া, প্রকৃতি নাকি জিন নিয়ন্ত্রণ করে ইলিশের এই আচরণ, তা আমরা জানি না। এই আবিষ্কার, এসব রহস্য জানার দ্বার খুলে দিয়েছে ।
  • বছরে দুইবার ইলিশ প্রজনন করে থাকে। জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে এই দুই সময়ের ইলিশ জিনগতভাবে পৃথক কিনা তা জানা যাবে।
  • বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে ইলিশের স্টকের সংখ্যা (একটি এলাকায় মাছের বিস্তৃতির পরিসীমা) কতটি এবং দেশের পদ্মা, মেঘনা নদীর মোহনায় প্রজননকারী ইলিশগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্টক কিনা তা জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সর মাধ্যমে।
  • “ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স জানার মাধ্যমে ইলিশের টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা যাবে।“ অর্থাৎ, এর ফলে মাছ সংগ্রহের ক্ষেত্রে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা সম্ভব হবে। যেমন,  ডিম যুক্ত মাছ সংগ্রহের ফলে মাছের সর্বোচ্চ সংখ্যক   আহরণ  ব্যাহত  হয় ; এই গবেষণার ফলে এই সমস্যা আরও দক্ষতার সাথে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে ।
  • দেশীয় ইলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের (ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য) ইলিশ থেকে জীনতাত্ত্বিকভাবে স্বতন্ত্র কিনা তাও নিশ্চত হওয়া যাবে।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংবেদনশীল ও খাপ খাওয়ার জন্য নিয়ামক জিন আবিস্কারের মাধ্যমে ইলিশের বায়োলজির উপর বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপন করাও সহজ হবে।
  • এছাড়া ইলিশের জন্য দেশের কোথায় কোথায় ও কতটি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা বা তুলে নেয়া প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা যাবে।
  • সেইসঙ্গে অন্য দেশের ইলিশ থেকে আমাদের ইলিশ বৈশিষ্ট্যগতভাবে স্বতন্ত্র কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে।

আশা করি ইলিশের এই গবেষণার গুরুত্ব কতখানি তা এতক্ষণে তোমরা বুঝতে পেরেছ । এবার দেখে নেয়া যাক গুরুত্বপূর্ণ এই গবেষণার পেছনের গল্প।

 

কাদের গবেষণার ফল এই  জীবনরহস্য?

আলোচনার শুরুতেই বলেছি বাংলাদেশের দু’দল গবেষক এর স্বতন্ত্র গবেষণার ফলাফল ইলিশের এই জীবনরহস্য উন্মোচন । যাদের রাতজাগা নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের ফলাফল এই গবেষণা এবার চলো তাদের নাম পরিচয় জেনে নিই।

গবেষণা দল ১ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দলের সদস্যরা:

  • বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মং সানু মারমা

 (যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টন শহরে নতুন প্রজন্মের ডিএনএ বিন্যাস প্রযুক্তির একটি প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও নিউক্লিওটাইড রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত , অনার্স-মাস্টার্স করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ (Department of Chemistry)  থেকে )।

  • বাংলাদেশি বিজ্ঞানী এ কে এম আবদুল বাতেন।
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের (Department of Bio-chemistry and Microbiology) অধ্যাপক হাসিনা খান-এর নেতৃত্বে দেশের কয়েকজন গবেষক।
  • প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞানবিভাগের (Department of Bio-chemistry and Microbiology)  অধ্যাপক মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম,
  • একই বিভাগের প্রভাষক ফারহানা তাসনিম চৌধুরী,
  • একই বিভাগের তরুণ গবেষক (১) অলি আহমেদ, (২) অভিজিৎ দাস, (৩) তাসনিম এহসান, (৪)জুলিয়া নাসরিন ও (৫) রিফাত নেহলিন।

যেভাবে কাজ করলেন

গত বছর  ১০ সেপ্টেম্বর কাজটি শুরু হয়। নমুনা সংগ্রহ করা হয় ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। গভীর সমুদ্র, মেঘনা নদীর মোহনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীর সংগমস্থল, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মার উপরিভাগ ও হাকালুকি হাওর—এই সাতটি এলাকা থেকে ইলিশের ডিএনএ, আরএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণায় ইলিশের বংশানুগতি সম্পর্কিত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে, ইলিশের পুরো ডিএনএ (জিনোম) এর ক্ষেত্রে প্রায় ১০০ কোটি বেসপেয়ার (কেমিকেল ইউনিট) রয়েছে এবং জিন রয়েছে ৩১ হাজার ২৯৫টি। মানবদেহে পুরো ডিএনএ রয়েছে ৩২০ কোটি বেসপেয়ার।

ইলিশের দেহে কতগুলো জিন আছে জানা গেছে, এখন জিনগুলো কীভাবে কাজ করবে, তা বের করা হবে। মং সানু এ বছরের ১ মার্চ ডিএনএ বিন্যাসের কাজ শেষ করেন। এরপরের কাজটি ডিএনএ অ্যাসেম্বলি বা বিন্যাস করা, ডিএনএ আবার মালার মতো করে সাজানোর কাজটি করেন আরেক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী এ কে এম আবদুল বাতেন।

 

 

গবেষণা দল ২ : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , ময়মনসিংহ

দলের সদস্যরা :

  1. ফিশারিজ , বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ. সামছুল আলম ( গবেষণা দলের সমন্বয়ক )
  2. ফিশারিজ , বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ গোলাম কাদের খান
  3. পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ. বজলুর রহমান মোল্লা
  4. বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম

গবেষণার গল্প

গবেষকরা জানান, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি-নোভো জিনোম অ্যাসেম্ব্লি প্রস্তুত করেন। ওই বছরের ২৫ আগষ্ট ইলিশের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স আন্তর্জাতিক জিনোম ডেটাবেজ ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনে’ (এনসিবিআই) জমা দেন। এছাড়াও ইলিশের জিনোম বিষয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল দু’টি আর্ন্তজাতিক কনফারেন্সেও উপস্থাপন করেছেন।

 

ইলিশ কি তবে চাষ হবে ?

ইলিশের জীবনরহস্য উদ্‌ঘাটনের পর সবচেয়ে কৌতূহলী জিজ্ঞাসা মনে হয় এটাই যে , “এখন থেকে কী ইলিশ মাছ রুই-কাতলা মাছের মত পুকুর কিংবা বিলে চাষ করা সম্ভব হবে ?”

এ প্রশ্নের উত্তরে গবেষণা দল ১-এর প্রথম সদস্য বিজ্ঞানী ড. মং সানু মারমা এ ব্যাপারে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন; তবে এখনই সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেছেন । এমন প্রযুক্তি আছে যে ইলিশের জিনকে প্রয়োজনে পরিবর্তন করে চাষের উপযোগী করা যেতে পারে। স্যামন মাছের জিনোম বিন্যাসের পর যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলো তাতে দেখা গেছে, সমুদ্রের স্যামন থেকে তা দ্রুত বড় হয়। ইলিশের ক্ষেত্রেও এ রকম করা যায় কি না, তা নিয়ে আরেকটু গবেষণা প্রয়োজন গবেষকদের ।

 

ইলিশ পুকুরে চাষ করলে কী এর স্বাদ অক্ষুণ্ণ থাকবে ?

“আগে ইলিশ মাছ খেয়ে যে স্বাদ আর তৃপ্তি পেতাম এখন কেন যেন আর সেই স্বাদ পাই না“। বাবা-মা কিংবা গুরুজনদের মুখে এমন আক্ষেপ আমরা প্রায় সবাই শুনে থাকি । তাহলে নদীর ইলিশ কে পুকুরে নিয়ে আসলে আদৌ কি তা ইলিশ থাকবে ? সাধারণ মানুষের এমন প্রশ্নের জবাবে গবেষকদের মন্তব্য শোনা যাক।

“ইলিশের খাদ্য বা প্ল্যাংটনের ওপর এর স্বাদ নির্ভর করে। তাই দেহে থাকা যে চর্বির কারণে একেক জায়গার ইলিশের স্বাদ একেক রকম হয়, সেটা জিনোমে লেখা থাকলে সেই তথ্য ব্যবহার করে ইলিশের স্বাদও একই রকম রাখা সম্ভব। সেই জিন শনাক্ত করা গেলে একই স্বাদের ইলিশ চাষ করা সম্ভব। এমনকি ইলিশের এই স্বাদ অন্য মাছের মধ্যেও স্থানান্তর করা সম্ভব।“  

 

লিখতে লিখতে প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম । ইলিশের জীবন রহস্য উন্মচোনের মাধ্যমে  আর যাই হোক ইলিশের স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে এর উৎপাদন যেন বৃদ্ধি পায় এটাই এদেশের ইলিশপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা ।নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র পরিবারের পিতাও বাজারের সেরা ইলিশ মাছটি সুলভ মূল্যে ক্রয় করে তার সন্তানের মুখে তুলে দিতে পারবেন এ চিত্র যেন সচরাচর হয়ে উঠে এ দেশে ।

 

-নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ৪