।জেবিন মাহমুদ।
আমরা এমন এক মহাবিশ্বে বাস করি যার বিশালতা কল্পনা করাই দুঃসাধ্য। প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছরের বুড়ো এ মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র, নীহারিকা আরও কত মহাজাগতিক বস্তুই না রয়েছে এ বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডে। আমরা যে গ্যালাক্সিতে বাস করি এর নাম মিল্কিওয়ে। শুধু আমাদের গ্যালাক্সিতেই প্রায় ১০০-৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে, যদিও বিশালতার দিক থেকে এটা অতি সাধারণ গ্যালাক্সি।
ব্যাপন সব সংখ্যা ৯৯৯!
এমন বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের ভিড়ে আমরা যে নক্ষত্রের চারপাশে অবিরাম প্রদক্ষিণ করছি এটি আমাদের চিরচেনা সূর্য (Sun)। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত আমাদের সৌরজগত। কিন্তু অকল্পনীয় বড় এ মহাবিশ্বে আমরা কি শুধুই একা?
বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের অন্য কোনো প্রান্তে কি গড়ে উঠেনি নতুন কোনো সভ্যতা? মানব সভ্যতা বিকাশেরও বহু আগে হয়তো কোনো এক আধাঁর রাতে গুহাবাসী কৌতুহলী মানুষ মাথা তুলে তাকিয়ে ছিলো অনন্ত মহাশূন্যের দিকে। আকাশের ঐ মিটিমিটি তারাদের দেখে তাদের রহস্য উদ্ধার করতে চেয়েছিলো। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আধুনিক মানুষ নানান রহস্য উদঘাটনে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের তৈরি মহাকাশযান ছুটে চলেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। বিখ্যাত ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন,
“আমরা এক পাগল করা মহাবিশ্ব পেয়েছি। আমরা চারদিকে যা দেখছি তার অর্থোদ্ধার করতে চাই এবং জানতে চাই এই মহাকাশের প্রকৃতি ঠিক কি? এখানে আমাদের স্থান কোথায় এবং এই মহাবিশ্ব আর এই আমরা কোথা থেকে এলাম? এই মহাকাশ আমরা ঠিক যেভাবে দেখছি সেটাই বা কেনো?”
চিত্র-১ : পার্কার সোলার প্রোব
মানুষের মহাকাশ অভিযানের ইতিহাস খুব দীর্ঘ না হলেও মানুষের অগ্রগতি অতটা কম নয়। এখন থেকে ৫০ বছর আগে মানুষ প্রথম বারের মত চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলো। এবার সূর্যকে ছুঁতে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে নাসার মহাকাশযান। এবারের সংখ্যায় আমরা দুঃসাহসিক এই অভিযান নিয়েই জানবো।
আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মহাকাশ যান ‘পার্কার সোলার প্রোব’ গতবছর ১২ই আগস্ট, ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ‘Cape Canaveral Air Station’ থেকে ‘ডেলটা ফোর হেভি রকেট’-এর কাঁধে চেপে সৌরজগতের কেন্দ্র সূর্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে। মহাকাযানটির নকশা ও নির্মাণ কাজ করে John Hopkins University Applied Physics Laboratory ।
মহাকাশযানটি পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে করতে যাত্রা শুরুর প্রায় ৪৫ দিন পর পৌঁছে যায় শুক্রগ্রহে (Venus)। উৎক্ষেপণের ১৬১ দিন পর এটি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু সূর্যের মুলুকে পৌঁছাতে আরও অনেক অনেক দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যেতে হবে এবং সোলার প্রোবটি সূর্যকে ঘিরে একে একে মোট ২৪ বার প্রদক্ষিণ করবে।
সূর্যের রাজ্যে পা রাখতে এটির প্রায় ২ থেকে ৪ বছর সময় লেগে যাবে। অর্থাৎ ২০২০ সালের অগাস্টের মাঝামাঝি ‘পার্কার সোলার প্রোব’ সূর্যের পাড়ায় ঢুকে পড়বে আর এরও ২ বছর পরে ২০২২ সলে পৌঁছে যাবে সূর্যের একবারে বাইরের স্তর বা ‘করোনায়’। সূর্য গ্রহণের সময় যে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটার অংশটি দেখা যায় এটিই সূর্যের ‘করোনা’।
‘পার্কার সোলার প্রোব’ মহাকাশযানটির নামকরণ করা হয় বিশিষ্ট সৌরপদার্থ বিজ্ঞানী ইউজিন নিউম্যান পার্কারের নামানুসারে। পার্কারই প্রথম কোনও বিজ্ঞানী, জীবিত থাকা অবস্থায় যাঁর নামানুসারে নাসা কোনও মহাকাশযান এর নামকরণ করেছে। এর পূর্বে বিভিন্ন দেশের প্রায় অর্ধশত মহাকাশযান সূর্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেও, ‘পার্কার সোলার প্রোব’-ই প্রথম যেটা খুব কাছে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে।
আচ্ছা অনেকে ভাবতে পারো যে একবার সূর্যকে ছোঁয়ার কথা বলেছি আর এখন বলছি সবচেয়ে কাছে থেকে প্রদক্ষিণ করবে! আসলে ‘পার্কার সোলার প্রোব’ সূর্যের কতটা কাছে পৌঁছাবে আর কেনই বা এই অভিযানকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে?
চিত্র-২ : বিজ্ঞানী ইউজিন পার্কার
‘পার্কার সোলার প্রোব’ পৃথিবীকে বিভিন্ন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে ২০২৫ সালে গিয়ে এটি সূর্যের সবচেয়ে কাছে পৌঁছাবে। তখন সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে তার দূরত্ব হবে মাত্র ৩৮ লক্ষ ৩০ হাজার মাইল বা প্রায় ৬০ লক্ষ কিলোমিটার। আমি জানি এটা দেখার পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে যে এটা আর কি এমন নিকট দূরত্ব যেটা নিয়ে এত আলোচনা!
John Hopkins University-এর সৌরপদার্থ বিজ্ঞানী ড. নিকোলা ফক্স বলেছেন, “আমি বুঝতে পারছি ৬০ লক্ষ কিলোমিটার দূরত্বকে কখনোই নিকট দূরত্ব বলে মনে হবে না, কিন্তু যদি ধরে নেয়া হয় ভূ-পৃষ্ঠ হতে সূর্যের দূরত্ব ১ মিটার, তাহলে ‘প্রোব’ সূর্য থেকে মাত্র ৪ সেমি দূরে থাকবে।” এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো সোলার প্রোবটি ঠিক কতটা কাছে পৌঁছাবে।
‘পার্কার সোলার প্রোব’-টি যে শুধু পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙে সূর্যের সবচেয়ে কাছে পৌঁছাবে তাই নয় এটি গতির দিক থেকেও পূর্বের সকল মহাকাশযানকে ছাড়িয়ে এক নজিরবিহীন গতিতে ছুটে চলবে। মহাকাশযানটি প্রতি সেকেণ্ডে সর্বোচ্চ ১২০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করবে, যেটা পূর্বের সবচেয়ে গতিশীল মহাকাশযান ‘জুনো’র থেকে প্রায় ৩.৩ গুণ বেশি।
ড. নিকোলা ফক্স বলেছেন, “এত দ্রুতগতির কোনো কিছু আগে তৈরি হয়নি। সূর্যের চারদিকে এটি প্রতি ঘণ্টায় ৬৯০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে ঘুরবে। অর্থাৎ এই গতিতে নিউইয়র্ক থেকে টোকিও যেতে লাগবে এক মিনিটেরও কম সময়।” মহাকাশযান নিয়ে অনেক আলোচনা হলো, কিন্তু এই অভিযানের লক্ষ্য কি সেটাইতো এখনো স্পষ্ট নয়, তাই না?
এককথায় যদি বলি তাহলে প্রায় ছয় দশকের পুরনো রহস্যজট খুলতে যাচ্ছে এই অভিযান। যে রহস্যের সমাধান খুঁজতে মহাকাশযানকে যেতে হবে সূর্যের ‘করোনায়’ কিন্তু করোনায় অত্যাধিক তাপমাত্রার ফলে এতদিন সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাপীয় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অভূতপূর্ব সাফল্যের ফলে এখন সেটাও সম্ভব হয়েছে।
তাপগতিবিদ্যা অনুসারে কোনো তাপীয় বস্তুর কাছাকাছি গেলে তাপমাত্রা বাড়বে এবং দূরে গেলে তাপমাত্রা কমবে। কিন্তু সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে সূর্যের একবারে বাইরের স্তর বা করোনার তাপমাত্রা বহুগুণ বেশি যেটা বহুকাল থেকে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছে।
সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যেখানে মাত্র ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস সেখানে করোনার তাপমাত্রা গড়ে ১০ লক্ষ বা তার কিছু বেশি ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদিও করোনার তাপমাত্রা সব জায়গায় সমান নয়। কিন্তু কেনো এমন হয়? সৌরপদার্থ বিজ্ঞানী নিকোলা ফক্স নাসার এক প্রেস ব্রিফিং এ বলেন, “Untill you go there and touch the sun, you can’t answer these questions.”
চিত্র-৩ : সূর্যগ্রহণের সময় দেখা যায় সৌর করোনা বা সূর্যের মুকুট
এ ছাড়া সূর্য থেকে নিঃসরিত বাতাসে যখন করোনায় প্রবেশ করে, তখন তার গতিবেগ তীব্রভাবে বেড়ে যায়। এই গরম বাতাস তখন প্রতি সেকেণ্ডে ৫০০ কিলোমিটার বেগে সোলার সিস্টেমের ভিতর দিয়ে ধেয়ে আসে। কিভাবে সৌরকণাগুলোর মধ্যে তীব্র গতিবেগের সঞ্চার হয় এবং সূর্যের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এমন সব অজানা প্রশ্নের সমাধান খুঁজতেই ‘পার্কার সোলার প্রোব’ সূর্যপানে পাড়ি জমিয়েছে।
পৃথিবীর শক্তির প্রধান উৎস সূর্য। সূর্যালোকের শক্তিই প্রায় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিকুলকে বাঁচিয়ে রাখে। আবার সূর্যই আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে যেতে পারে। সৌরবায়ুর মধ্যে থাকা চৌম্বকক্ষেত্র ও শক্তিশালী চার্জিত কণাসমূহ সবসময়ই পৃথিবীকে প্রভাবিত করে এবং এগুলো পৃথিবীর চৌম্বক শক্তির ভারসাম্য বিঘ্নিত করে দিতে পারে।
সেক্ষেত্রে পৃথিবীর যাবতীয় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জিপিএস (Global Positioning System) নেটওয়ার্কে বড় ধরনের গোলযোগ হতে পারে। সূর্যের পৃষ্ঠে সৃষ্ট কোনও শক্তিশালী চৌম্বকীয় ঝড় (Magnetic Storm) যদি পৃথিবীর বুকে সরাসরি আছড়ে পড়ে তাহলে বিভিন্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইটগুলো কক্ষচ্যুত হতে পারে, এমনকি বৈদ্যুতিক গ্রিডও বিকল হয়ে যেতে পারে। আর এর ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে অন্তত ২ ট্রিলিয়ন ডলার! অর্থাৎ হারিকেন ক্যাটরিনায় (যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগ) ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি!
চিত্র-৪ : সৌরবায়ুর বিরুদ্ধে পৃথিবীর নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও এটি অন্যতম একটি উদ্বেগের কারণ
সূর্য একটি দৈত্যাকৃতির অগ্নিকুণ্ড। যেখানে ফিউশন বিক্রিয়ায় প্রতি সেকেণ্ডে ৬০০ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৪ মিলিয়ন টন পদার্থ শক্তিতে রুপান্তরিত হচ্ছে। এমন চরম বৈরী আবহাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কোনো মহাকাশযানের পক্ষে সূর্যের খুব কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
কিন্তু ‘পার্কার সোলার প্রোব’ সে সবের তোয়াক্কা না করে একদম সূর্যের ডেরায় ঢুকে পড়বে। কারণ সোলার প্রোবটির যন্ত্রপাতি থাকবে ৪.৫ ইঞ্চি কম্পোজিট কার্বনের আবরণ দিয়ে মোড়ানো। ফলে এটির ভিতরের তাপমাত্রা সবসময় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে এবং ভিতরের যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষা পাবে।
আচ্ছা ‘পার্কার সোলার প্রোব’ কি সৌরঝড়কে থামিয়ে দিতে পারবে? উত্তর হচ্ছে না। কিন্তু এই অভিযানের ফলে এখন অনেক নিখুঁতভাবে সৌরবায়ুর মধ্যে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি, ঘনত্ব ও শক্তিশালী কণাদের গতিবেগ মাপা সম্ভব হবে। এছাড়াও সৌরঝড় সম্বন্ধে সঠিক পূর্বাভাস জানা যাবে। এর ফলে পৃথিবীর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১
No Comment