।মোকারম হোসেন।

এই যে গত দশ এপ্রিলের (২০১৯) কথা। ঢুঁ মারলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম ফেইসবুকে। চমকে উঠলাম ব্ল্যাক হোলের ছবি দেখে। মনে মনে আনন্দ অনুভব করলাম। অদৃশ্য বস্তুটির পর্দা উন্মোচিত হলো তাহলে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম স্থির দৃষ্টিতে। আর বুঝতে পারলাম আইস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের মহত্ত্ব।

ব্যাপন সব সংখ্যা ৯৯৯!

ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না সেই মানুষটিকে। যিনি গাণিতিক জটিল তাত্ত্বিক সমীকরণ কষে বলে দিয়েছেন ব্ল্যাক হোলের অজানা তথ্যসমূহ। ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্ত, আলোক রিং সবই চোখে পড়ল। যাহোক, আজকে জানবো ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবির রহস্য। তার আগে জেনে নেই ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে।

ব্ল্যাক হোল স্থান-কালের এক রহস্যময় অঞ্চল। এখানে মহাকর্ষ এত শক্তিশালী যে কিছু এখান থেকে বাইরের মহাবিশ্বে আসতে পারে না। এমনকি আলোও না। পৃথিবীতে উপরের দিকে কিছু ছুঁড়ে দিলে একটু পর নীচে নেমে আসে। কিন্তু ব্ল্যাক হোলে সে সুযোগ নেই। বলতে পারো, তবুও তো পৃথিবী থেকে আমরা বের হতে পারি।

রকেট আমাদেরকে নিয়ে যায় দূর দূরান্তে। হ্যাঁ, একদম ঠিক। এজন্য রকেটকে অর্জন করতে হয় মুক্তিবেগ। যা পৃথিবীর জন্যে সেকেন্ডে প্রায় ৭ মাইল। কমপক্ষে এই বেগে নিক্ষেপ করলেই কেবল রকেট পৃথিবী ছেড়ে দূর আকাশের দিকে যেতে পারে। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষ খুব বেশি। মুক্তিবেগ তাই আলোর বেগকেও হার মানায়।

চিত্র-১ : রকেট ছুঁড়তে মুক্তিবেগ বা তার বেশি বেগ লাগবে। ব্ল্যাক হোলের মুক্তিবেগ আলোর চেয়ে বেশি।

কোনো বস্তু থেকে আলো বের হলে তবেই কেবল সেটিকে আমরা দেখতে পারি। আর আলোও বের হতে পারে না বলেই ব্ল্যাক হোলের নাম ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বব। নামের প্রথম অংশটি সার্থক। কিন্তু দ্বিতীয় অংশের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। ব্ল্যাক হোল আসলে কোনো গর্ত নয়। মহাকর্ষের প্রচণ্ড চাপে গুটিয়ে বিন্দুতে পরিণত এক ছোট্ট জিনিস।

তবে ঘটনা দিগন্ত ছড়িয়ে থাকে অনেক দূর পর্যন্ত। ঘটনা দিগন্তই হলো ব্ল্যাক হোলের ক্ষমতার শেষ প্রান্ত। এর ভেতরে একবার চলে গেলে আর বের হওয়া যাবে না। এর ভেতরের কোনো দৃশ্য দেখা যাবে না। এর বাইরে থাকলে অবশ্য নভোচারীর যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

আচ্ছা, ব্ল্যাক হোল তো দেখাই যায় না। তাহলে কালো ব্ল্যাক হোলের ছবি উঠলো কীভাবে? এটাই আমরা এবার জানবো। ব্ল্যাক হোলের এই ছবিটি আসলে কোনো ফটোগ্রাফ বা স্থির চিত্র নয় বরং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কতিপয় শক্তিশালী টেলিস্কোপের সম্মিলিত ডাটার সমন্বয়ে তৈরি একটি চিত্র। যা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে অনেক বৈজ্ঞানিক কৌশল ও মডেল।

আর এসবের পিছনে প্রধান নিয়ামক ছিলো টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণকৃত ডাটা। এই কারণে তৈরিকৃত ছবিটি কোনো সিমুলেশন নয়। আমরা ইতোপূর্বে ব্ল্যাক হোলের যে ছবি দেখে এসেছি সেগুলো বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও গাণিতিক মডেলের কম্পিউটার সিমুলেশন মাত্র।   

এপ্রিল ২০১৭ থেকে বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপের একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি তোলার ব্যাপারে গবেষণা করে যাচ্ছিলেন। প্রথমে তারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে স্যাজাইটেরিয়াস এ* (Sagittarius A*) ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলার কাজটি শুরু করেন− যার ভর সূর্যের ভরের ৪.৩ মিলিয়ন গুণ, ব্যাসের ৩০ গুণ।

পৃথিবী থেকে দূরত্ব প্রায় ২৬,০০০ আলোক বর্ষ। আমাদের দৃশ্যপট থেকে অনেক দূর। আর এই ব্ল্যাক হোলের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পৃথিবী থেকে দেখা চাঁদে রাখা একটি কমলালেবুর ছবির মতো। ফলে বিজ্ঞানীরা স্যাজাইটেরিয়াস এ-এর তীক্ষ্ণ, স্পষ্ট কোনো ছবি তৈরিতে ব্যর্থ হন।

তাই তারা এমন একটি কাছাকাছি ব্ল্যাক হোল পর্যবেক্ষণের জন্য খুঁজতে থাকেন− যার ভর, ব্যাস ও বেতার তরঙ্গ বিকিরণ অনেক বেশি হবে। তারা পৃথিবী থেকে ৫৫ মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরে সূর্যের তুলনায় ৬.৫ বিলিয়ন গুণ ভারী এবং স্যাজাইটেরিয়াস এ থেকে ২,০০০ গুণ বড় এম-৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি ব্ল্যাক হোল পর্যবেক্ষণ করবেন বলে ঠিক করেন।

যদিও এটি স্যাজাইটেরিয়াস এ থেকে অনেক দূরে কিন্তু ভর ও ব্যাস অনেক বেশি। এপ্রিল ১-৫, ২০১৭ মাত্র পাঁচ দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সমন্বিত টেলিস্কোপ ব্যবস্থা একই সাথে রেডিও তরঙ্গ রেকর্ড করে। কিন্তু পৃথিবীর আহ্নিক গতি, বায়ুমন্ডলের মেঘ, মহাজাগতিক বিকিরণ, বিশাল দূরত্ব ও এম-৮৭ গ্যালাক্সির ধুলিমেঘের কারণে পর্যবেক্ষণকৃত ডাটায় ডাটাশুন্যতা (Data gap) তৈরি হয়।

চিত্র-২ : এম-৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চল

প্রায় দুই বছর এর ডাটার উপর গাণিতিক বিশ্লেষণ ও গবেষণা চালানো হয়। প্রচলিত গাণিতিক অ্যালগরিদম দিয়ে ডাটাশুন্যতা পূরণ করা হয়। কিন্তু প্রচলিত গাণিতিক অ্যালগরিদম পর্যাপ্ত ডাটাশুন্যতা পূরণ করতে পারেনি। তাই প্রজেক্ট যন্ত্রাংশের সাথে সংগতিপূর্ণ নতুন অ্যালগোরিদম মডেল উদ্ভাবন করে প্রচলিত অ্যালগরিদম ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটানো হয়।

ড. কেটি বুমেন একজন ২৯ বছর বয়সী এম.আই.টি স্নাতকধারী কম্পিউটার বিজ্ঞানী। যিনি নতুন অ্যালগরিদম তৈরি করে টেলিস্কোপের টেরাবাইট ডাটা প্রসেসিং করেন এবং ডাটাশুন্যতা দূর করেন। আর নিজেকে ইতিহাসের অংশ করে নেন খুব অল্প বয়সেই।

সব ডাটাশুন্যতা পূরণ করে ব্ল্যাক হোলের ইমেজ তৈরি করা হয়। অবশেষে গত ১০ এপ্রিল প্রকাশিত এম-৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি অতি ভারী ব্ল্যাক হোলের ছবি বিশ্ববাসীর সামনে আসে। এটা ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের বাস্তব প্রমাণ। এই ছবির কেন্দ্রে কালো অংশকে ঘিরে আছে একটি আলোর রিং।

এই আলোক রিং-এর একপাশ বেশ উজ্জ্বল। এই মেসিয়ার-৮৭ গ্যালাক্সি বা এম-৮৭ গ্যালাক্সিটি ভিরগো গ্যালাক্সি ক্লাস্টার নামক গ্যালাক্সিগুচ্ছে অবস্থিত। এর ঘটনা দিগন্তের ব্যাস সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বের ১২০ গুণ যা প্লুটোর কক্ষপথকেও ছাড়িয়ে যাবে।

অবশেষে আমাদের দৃষ্টিগোচরে আসা অসম্ভব মনে করা জিনিসটিও দৃশ্যপটে ধরা দিল। ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপ (Event Horizon Telescope- EHT) নামক সম্মিলিত ৮টি টেলিস্কোপ ব্যবস্থা।

২০টি দেশের ৫৯টি প্রতিষ্ঠানের ২০০ জন গবেষক এক দশকেরও অধিক সময় ধরে কাজ করেছেন। এই প্রজেক্টের নাম− ইভেন্ট হোরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। ব্ল্যাক হোলের যে সীমানা পর্যন্ত আলো, বিকিরণ কোনো কিছুই ফিরে আসতে পারে না তাকে ব্ল্যাক হোলের ঘটনাদিগন্ত বলে।  

ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলার জন্য বিজ্ঞানীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মোট আটটি টেলিস্কোপকে সমন্বিত করেন। আর এই সমন্বয় করা হয় ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরিকে অনুসরণ ও খুব দীর্ঘ বেসলাইন ইন্টারফেরোমেট্রি (Very Long Baseline Interferometry-VLBI) ব্যবহার করে।

এখানে ইন্টারফেরোমেট্রি হলো কতগুলো টেলিস্কোপের এমন বিন্যাস যার মাধ্যমে টেলিস্কোপগুলো একটি একক ইউনিট হিসেবে কাজ কাজ করে মহাজাগতিক বস্তুর (গ্রহ, তারকা, সুপারনোভা, নেবুলা, গ্যালাক্সি ইত্যাদি) খুবই ভালো মানের ছবি তুলতে পারে।

আর এই সমন্বয় খুবই কার্যকরভাবে পৃথিবীর সমান একটি ভার্চুয়াল টেলিস্কোপ তৈরি করে। এই সমন্বয়কে টেলিস্কোপের বৈশ্বিক সমন্বয় বলা যেতে পারে। ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবিটি দৃষ্টিগোচরে আসার প্রধান জাদু হলো অনন্য টেলিস্কোপ সমন্বয় ব্যবস্থা।

চিত্র-৩ : এই আটটি টেলিস্কোপকে তাদের অবস্থানসহ দেখানো হয়েছে।

সমন্বিত টেলিস্কোপগুলো মাত্র পাঁচ দিনে ৫,০০০ ট্রিলিয়ন বাইট ডাটা সংগ্রহ করে। এই ডাটা ৫০,০০০ বছরের MP3 ফাইলের সমান অথবা ৪০,০০০ মানুষের সারা জীবনের সেলফি ডাটার সমান। বিজ্ঞানীরা এই ডাটা স্পেকট্রো-কম্পিউটার দিয়ে প্রসেসিং করে ইমেজ তৈরি করেন।

এ কাজ করতে ২০০ জন গবেষকের ২ বছর সময় লাগে। টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত নিয়ে ছয়টি সিরিজ পেপার দ্য এস্ট্রোফিসিক্যাল জার্নাল লেটারস (The Astrophysical Journal Papers)-এ প্রকাশিত হয়। এসব জার্নালে বিস্তারিতভাবে প্রজেক্টের এ টু জেড তুলে ধরা হয়েছে।

পেপার-২-এ ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপের সমন্বয়, বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে প্রযুক্তির উন্নয়ন, ইন্সট্রুমেন্টেশন, সূক্ষ্ম সনাক্তকরণ ব্যবস্থার সৃষ্টি এবং টেলিস্কোপ সমন্বয়ের মাধ্যমে অনন্য ইমেজিং কৌশল ব্যবস্থা তৈরির ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।

পেপার-৩-এ ডাটা সংগ্রহ, ডাটা প্রক্রিয়াকরণ, অ্যালগরিদম ক্রমাঙ্কন (Calibration), বিশ্লেষণের উপযুক্ত ডাটা বাছাইকরণের জন্য কঠোর বৈধতা নীতির ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

পেপার-৪-এ ইমেজ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া ও পথ (Process & approach) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রচলিত ইমেজিং অ্যালগরিদম ও ইএইচটি যন্ত্র উপযোগী নতুন এলগরিদম কৌশলের কঠোর মূল্যায়ন এবং সাংশ্লেষিক ডাটা সেট বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে ইমেজিং এলগরিদমকে কয়েক মাস ধরে টেস্ট করা হয়েছে। এভাবে ব্ল্যাক হোলের চূড়ান্ত ইমেজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

পেপার-৫-এ জেনারেল রিলেটিভিস্টিক ম্যাগনেটোহাইড্রোডাইনামিক (জিআরএমএইচডি) সিমুলেশন ও উন্নত রশ্মি চিহ্নিতকারক ব্যবস্থা ব্যবহার করে ইমেজ ও ডাটার বিশ্লেষণ করে ব্ল্যাক হোলটির পরিবৃদ্ধি (Accretion) ও প্রচন্ড বেগপূর্ণ বিকিরণের (জেট রেডিয়েশন) ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

পেপার-৬ এ মডেল উপযুক্তকরণ, ডাটা দিয়ে করা সিমুলেশনের তুলনা করা হয়েছে। ব্ল্যাক হোলের ইমেজ থেকে আলোক রিং-এর আকার-গঠন, ব্ল্যাক হোলের ভর, ব্ল্যাক হোলের প্রকৃতি ও বেষ্টনকারি স্পেস টাইমের ওপরে বিরাজমান প্রভাবকের তথ্য বের করা হয়েছে।

পেপার-১ এ পেপার ২-৬ এর সারমর্ম বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং ব্ল্যাক হোলের ছবিটি মাত্র কয়েক কিলো বাইট কিন্তু এটি সংশ্লেষণ করা হয়েছে কয়েক হাজার টেরাবাইট ডাটা থেকে।

তথ্যসূত্র :  

১. https://iopscience.iop.org/journal/2041-8205/page/Focus_on_EHT

২. https://amp.cnn.com/cnn/2019/04/10/world/black-hole-photo-scn/index.html

৩. https://relay.nationalgeographic.com/proxy/distribution/public/amp/science/2019/04/first-picture-black-hole-revealed-m87-event-horizon-telescope-astrophysics

৪. www.space.com

৫. https://eventhorizontelescope.org

৬. https://www.sciencenewsforstudents.org/article/black-hole-first-photo-event-horizon-telescope

মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১

অ্যাপেন্ডিক্স কি আসলেই অপ্রয়োজনীয়!

বিটকয়েনের দৌরাত্ন্য

রেডিয়েশন : অসাধারণ ত্যাগের আবিষ্কার

আবরার নাফির ফিজিক্সে রৌপ্য জয়ের গল্প

চুম্বকত্বের আদ্যোপান্ত

চিনে রাখি অসুখগুলি

দুরন্ত বাড়ন্ত e

অবলোহিত আলো দেখতে চাও?

মস্তিষ্ক দখল

মহাবিশ্বের স্ফীতি

মাটির ভুবনে

তোমাদের প্রশ্ন আমাদের উত্তর

কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন

সহজে মিলাও সুডোকু

ফোটোনিক্স ও গবেষণা

মস্তিষ্ক দখল

ইভিএম কীভাবে কাজ করে?

পৃথিবীর বিপদ যত!

ইউরেনিয়াম: অবিশ্বাস্য শক্তির ভ্রুণ

একটি গ্রহ ও দুটি নিঃসঙ্গ কোটর

মহাশূন্যে বসবাস

চিনে রাখি অসুখগুলি

শুন্যে আমি

চুম্বকত্বের আদ্যপান্ত