।আশরাফ পিন্টু।

[গত সংখ্যার পর]

সিজান বলল, তুমি কে? এটা কোন জায়গা?

অদ্ভুত জীবটি জবাব দিলো, আমার নাম টোটো। এটা ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’- যা তোমাদের পৃথিবীরই মিরর ইমেজ।

-সেটা আবার কী?

-তুমি বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মধ্য দিয়ে এখানে ঢুকে পড়েছো। এর আগে অনেকেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে ঢুকেছে কিন্তু অধিকাংশই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। সবার আসার ক্ষমতাও এখানে থাকে না। তবে যাদের জীবনী শক্তি বেশি তারা এখানে টিকে যায়।

-কি বলছো এসব!

-ঠিকই বলছি। আমরা কেউ মিথ্যে কথা বলি না। আমিই তোমাকে বারমুডার সুড়ঙ্গ পথ থেকে উদ্ধার করে এখানকার দ্বীপে রেখে এসেছিলাম। আমরা তোমাদের পৃথিবী সম্পর্কে জানতে খুবই আগ্রহী।

– কেন?

-বলতে পারো এটা আমাদের মহাকাশ গবেষণারই একটি অংশ। তবে বর্তমান পৃথিবী সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানতে পারি নি। এ ব্যাপারে তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারো।

-হ্যাঁ। সিজান মাথা ঝাঁকাল। তবে তার আগে বলো কী হবে পৃথিবী সম্পর্কে জেনে?

-পরে বলছি। চলো। টোটো সিজানকে ওখান থেকে উঠিয়ে পাশের একটি রুমে নিয়ে গেল।

আপনার প্রিয় ব্যাপন ম্যাগাজিনটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন

সিজান রুমে ঢুকে আরো অবাক হয়ে গেল। দেখল টোটোর মতো আরো অনেকে কম্পিটারের মতো যন্ত্রের সামনে বসে আছে। প্রায় সারা শরীরেই ছোট ছোট যন্ত্রপাতি। মনিটরের সামনে তাকিয়ে সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত।

টোটো বলল, ওরা সবাই মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। কোথাও আমাদের চেয়ে উন্নত বা অনুন্নত জীব আছে কি না।

-তা জেনে তোমাদের কি লাভ?

-তুমি বোকার মতো প্রশ্ন করছো কেন? তুমিও তো একজন বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী মানেই তাদের মধ্যে থাকে সবসময় কল্যাণ চিন্তা। এখানে যাদের দেখছো তারা সবাই বড় মাপের বিজ্ঞানী। আমাদের চেয়ে যারা সভ্যতায় পিছিয়ে আছে তাদেরকে আমরা হাতে-কলমে সভ্যতা শিখিয়ে আসি। আমরা চাই মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহের জীবেরা উন্নত থেকে উন্নততর হোক।

-বুঝলাম না।

আবার অজ্ঞতা প্রকাশ করে সিজান কিছুটা লজ্জিত হলো।

-তোমাদের গ্রহেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে গিয়েছিলেন।

-কেন গিয়েছিলেন?

-তোমাদের পূর্বপুরুষদের সভ্যতা শিখাতে। গ্রিক সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা এটা তো আমাদেরই অবদান।

-বলো কী!

-হ্যাঁ। পিরামিড তৈরি করার কলা-কৌশল তো আমরাই শিখিয়েছি। ওই সময়ে তোমাদের পৃথিবীর মানুষের বুদ্ধিমত্তা এত উন্নত ছিল না। কীভাবে মৃতদেহ সজীব রাখা যায় তার জন্য রাসায়নিক বস্তু আমরাই সরবরাহ করেছি।

-তারপর?

-এরপর গ্রিক এবং ভারতেও গিয়েছি। কীভাবে জমি চাষ করতে হয়, কীভাবে ফসল ফলাতে হয়- এসব তোমাদের পৃথিবীর লোকদের শিখিয়েছি। আমাদের উন্নত প্রযুক্তি আর ক্ষমতা দেখে ওরা তো আমাদের দেবতা মনে করেছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা চলে আসার পর অনেকে সত্যিকারের স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে আমাদের কল্পিত মূর্তি বানিয়ে পূজাও করেছে; হয়তো এখনও করছে।

-কী বলছ এসব! তা, এখন তোমাদের কার্যক্রম কী?

-আমাদের কার্যক্রম তো যুগ যুগ ধরে অব্যাহত আছেই। অসীম এ মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে করতে মাঝে-মধ্যে তোমাদের পৃথিবীর কথা ভুলেই যাই। তবে যখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’-এর গবেষণা কেন্দ্রে আসি তখন পৃথিবীর কথা আমাদের মাথায় আসে। এ কারণে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে দুর্যোগে পতিত অনেককেই আমরা মাঝে-মধ্যে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।

-তোমরা আসলে কোন গ্রহের বাসিন্দা?

-আমরা F-7 গ্রহের বাসিন্দা।

-তোমাদের গ্রহটি কী ধরনের?

-আমাদের গ্রহটি ফোর ডাইমেনশন বা চতুর্মাত্রিক জগতের গ্রহ। ওখানে অতীত ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। সবই বর্তমান কাল।

-এই প্যারালাল পৃথিবীটা কোন জগৎ?

-এটা যেহেতেু পৃথিবীর মধ্যেই অবস্থিত সুতরাং এটি ত্রিমাত্রিক জগতের আওতাভুক্ত। তবে আমরা মাঝে মাঝে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পিছনে ফেলে এখানকার কিছু কিছু মানুষকে আমাদের ওখানে নিয়ে যাই।

-তার মানে তুমি তোমাদের F-7 গ্রহের কথা বলছো?

-হ্যাঁ।

-আমি এখান থেকে আবার কীভাবে পৃথিবীতে ফিরব?

-তা তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি নিজেই তোমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দেবো। তার আগে তোমাদের পৃথিবী সম্পর্কে কিছু বলো?

পৃথিবী সম্পর্কে সিজান কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। পৃথিবীর সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে কিন্তু পৃথিবীর মানুষেরা পারমাণবিক বোমার ধ্বংসাত্বক ব্যবহার, খুনোখুনি নিয়ে মেতে আছে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যে দূষণ হচ্ছে সে সম্পর্কে কি কিছু বলবে? সিজানকে চুপ থাকতে দেখে টোটো বলে ওঠে, কী ভাবছ?

-কী বলব ভেবে পাচ্ছি না?

-তোমাদের বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলো?

-আমরা চাঁদে গিয়েছি কিন্তু এ পর্যন্ত মঙ্গলে যেতে পারি নি।

-চাঁদ! সেটা কোথায়?

-সেটি আমাদের পৃথিবীরই একটি উপগ্রহ।

হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে টোটো। চাঁদ তো একটি ছোট্ট উপগ্রহ। ওখানে এখনো আমাদের যোগাযোগ হয়নি। তাই চিনতে পারি নি। তবে তোমাদের পাশের গ্রহ মঙ্গলে গিয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা। ওখানে এক সময় জীব ছিল কিন্তু উন্নত পরিবেশ না পেয়ে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে।

-তোমরা সাহায্য করতে পারো নি?

-না, সে জীবগুলো তোমাদের মতো এত উন্নত প্রাণী ছিল না।

-আমরা পৃথিবীবাসীরা কি ভবিষ্যতে তোমাদের মতো উন্নত বুদ্ধিমান প্রাণী হতে পারব?

-কেন পারবে না?

-তোমাদের মতো সময় জ্ঞান, ন্যায়-নিষ্ঠা, কর্মদক্ষতা এগুলোর তো চরম অভাব আমাদের মধ্যে।

-তা ঠিক। এগুলো তোমাদের আগে কাটিয়ে তুলতে হবে। এগুলো ছাড়াও তোমাদের মধ্যে আরো বড় সমস্যা আছে।

-কী?

– তোমরা খাবারের জন্যই অধিকাংশ সময় নষ্ট করে দাও। চিন্তা বা গবেষণার সময় পাও কখন?

-তা ঠিক। খাবারের জন্য তোমরা সময় অপচয় কর না?

-না। আমরা তো বায়বীয় খাবার খাই, বায়ু আলো খেয়ে বেঁচে থাকি। সময় নষ্ট হবে কীভাবে?

-তোমাদের বংশ বৃদ্ধি হয় না?

-হয়। যখন প্রয়োজন হয় তখন আমরা আমাদের কোষ থেকে ক্লোনের মাধ্যমে আরেকটা জীব তৈরি করে ফেলি। দেখছ না আমাদের সকলের চেহারা সেজন্য একই ধরনের।

সিজান টোটোর কথায় কম্পিউটারে কর্মরত সব বিজ্ঞানীদের মুখের দিকে তাকালো। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর বলল, হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। তবে তোমাদের কি মৃত্যু নেই?

-আছে। তবে আমরা সব ধরনের জরা-ব্যাধিকে জয় করে দীর্ঘজীবন লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।

-তোমরা কত বছর বাঁচো?

-গড়ে পনের শ’ বছর।

-তোমরা কি মৃত্যুকে জয় করার ব্যাপারে কিছু ভাবছ?

-হ্যাঁ, এখন কোষ নিয়ে গবেষণা করছি। বৃদ্ধ কোষগুলোকে যদি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যায় তবে আমরা হয়ত একদিন অমর হতে পারব। একটু থেমে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে টোটো বলে-

-অনেক কথা হলো, এবার বলো তুমি কি খাবে?

-এখানে আসার পথে কয়েকটা কলা খেয়েছিলাম। এখন প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে।

-তোমাদের তো দিনে তিন-চার বার খাও। আমরা কিন্তু ২৪ ঘণ্টায় মাত্র একবার খাই। যাই হোক, তুমি কি খেতে চাও?

-আমি ভাত-মাছ খেতে চাই।

-এখানে তো ভাত পাওয়া যাবে না। তবে মাছ বা ফল-মূল তোমাকে খাওয়াতে পারবো।

-আচ্ছা ফল-মূল দিলেই হবে। এবার বলো আমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দিবে কখন?

-এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? খাওয়ার পর পরই তোমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দেবো।

কথা শেষ করে টোটো ওর হাতের যন্ত্রটার ওপর একটি ফুঁ দিলো। কিছুক্ষণ পরে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রলিতে বিভিন্ন রকমের ফল-মূল চলে আসলো। খাওয়া শেষ করে সিজান বলল,

-তোমরা কি আমাদের উন্নত প্রযুক্তি শেখাতে পৃথিবীতে আবার যাবে?

-তা সঠিক বলতে পারছি না। তবে তোমাদের পৃথিবীকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতে আমরা মাঝে-মধ্যে যাই। যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রযুক্তি শেখাতে ওখানে গিয়েছিল তখন পৃথিবীর মানুষ অজ্ঞ ও বর্বর হলেও তাদের মনটা ছিল সহজ-সরল। তাদের মধ্যে কোনো হিংষা-বিদ্বেষ, দলাদলি ও খুনোখুনি ছিল না। সত্য যুগের মানুষেরা তো সততার দিক দিয়ে ফেরেশতার মতোই ছিল। কিন্তু এখন অনেক বদলে গেছে পৃথিবী। তোমরা এখন নিজেরাই মারামারি খুনোখুনি করে মরছো। তোমাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়-অত্যাচার ভয়াবহ রকমের বেড়ে গেছে। যার দরুণ তোমাদের সভ্যতা সুষ্ঠু ভাবে বিকশিত হতে পারছে না। সভ্যতার চরম শিখরে তোমাদের পৌঁছানোর কথা ছিল কিন্তু এ সব কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে।

-তাহলে তোমাদের যাবার ইচ্ছে নেই পৃথিবীতে?

-আপাতত নেই। এবার চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

সিজান উঠে দাঁড়িয়ে টোটোকে অনুসরণ করল।

সিজান যখন চোখ মেলে তাকাল তখন দেখল, ও একটি ছোট্ট দ্বীপে পড়ে আছে। আরে আমি এখানে কখন পৌঁছলাম? এটি কি আগের দ্বীপেরই কোনো অংশ? চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখল ও। নাহ্, এটি কোনো নতুন দ্বীপ মনে হচ্ছে। কিন্তু টোটো আমাকে না বলেই চলে গেল? সিজান কীভাবে এখানে আসল তা মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। ও বুঝতে পারল টোটো ওকে অচেতন করে নিয়ে এসে এখানে ফেলে চলে গেছে। ওরা পৃথিবীর মানুষের কাছে ধরা দেবে না, সবকিছুই রহস্যের মধ্যে রাখতে চায়।

সিজান দেখল দ্বীপটিতে তেমন গাছপালা নেই। জনবসতিও থাকার কথা নয়। কীভাবে ও দেশে পৌঁছাবে? সাগরের দিগন্তরেখা বরাবর তাকাল। দেখল, অনেক দূরে বিন্দুর মতো কিছু চোখে পড়ছে। বুঝতে পারল ওগুলো জাহাজ। মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো, আজ হোক কাল হোক একদিন সে দেশে ফিরতে পারবেই।

কয়েক দিন পর সিজান জাহাজে চেপে দেশে অর্থাৎ আমেরিকায় পৌঁছে গেল। নাসায় পৌঁছানো মাত্রই হৈ-চৈ পড়ে গেল চারিদিকে। সবাই জানত বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কবলে পড়ে তরুণ বিজ্ঞানী সিজানের অকাল মৃত্যু হয়েছে। ওকে ফিরে পেয়ে সকলে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। সিজানের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য ওর বন্ধু ও সহকর্মীরা পরদিন একটি সেমিনারের আয়োজন করল।

সেমিনারের দিন।

অগণিত দর্শক আর আর নাসার বিজ্ঞানীদের উপস্থিতিতে হল রুম ভর্তি। সবাই কৌতুহল ভরে অপেক্ষা করছে সিজানের ‘‘জার্নি টু বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’’-এর অভিজ্ঞতার কথা শুনতে।

সিজান প্রথম থেকেই তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করল। কীভাবে তাদের বিমান বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মধ্যে ডুবে গেল, কীভাবে সে সে ‘প্যারালাল পৃথিবীতে’ পৌঁছাল, সেখানে অন্য গ্রহের জীবদের সাথে কি সব কথা হলো সে একে একে সব বলতে লাগল। সিজানের কথা শুনে অনেক বিজ্ঞানীর চোখেই অবিশ্বাসের দৃষ্টি দেখা গেল। কেউ কেউ নিঃশব্দে কক্ষ ত্যাগ করল।

কিছু সাধারণ দর্শক হাততালি দিয়ে সিজানকে উৎসাহ যোগালেও বক্তৃতা শেষ হবার অনেক পূর্বেই কক্ষ জনশূন্য হয়ে পড়ল।

 

জুলাই-আগস্ট ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ২

 

বিপজ্জনক ভাইরাসেরা

 

ছোট ম্যাজেলানিক ক্লাউড

 

চিনে রাখি অসুখগুলি

মহাশূন্যে বসবাস

বাদুড়ের অজানা অধ্যায়

শ্বাস-প্রশ্বাসের গল্প

সৌরজগতের জলাধার

ন্যানো প্রযুক্তির ঘরে

ফুটবলে বিজ্ঞানঃ টেলস্টার ১৮

স্বপ্নঃ রহস্যঘেরা এক বাস্তবতা