| মুসা ইয়াহিয়া ও ইকরামুল হাসান |

একই পরিবারের সদস্য বিশেষ করে ভাই-ভাই, পিতা-পুত্র বা মা-মেয়ের মধ্যে অনেকগুলো সদৃশ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। অনেক সময় দেখেই বোঝা যায়- আচ্ছা! এই দুই জন তাহলে ভাই-ভাই।

কিন্তু দুইজন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য একই রকম হয় কেন? আবার আমরা দেখি কারো মাথায় কোঁকড়া চুল, আবার কারো মাথার চুলের রং সোনালি বা বাদামি। মানুষে মানুষে এই  বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের পেছনে কে দায়ী? এক সময় এর উত্তর ছিল আমাদের বংশগতির ধারক বাহক ‘ক্রোমসোম’। পরে জানা গেল, মূলত ক্রোমসোমের মধ্যে ডিএনএ-ই আমাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। অবশ্য, এখন আমরা জানি, ডিএনএ এর মধ্যে থাকা আলাদা আলাদা জিন আবার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। এই ডিএনএ এবং এর ডাবল হেলিক্স গঠন আবিষ্কারে অবদানের জন্যে প্রাপ্ত নোবেলই আমাদের এ সংখ্যার নোবেলের আলোচ্য বিষয়।

আসলে, ব্যাপন বন্ধুদের রসায়ন আর পদার্থবিদ্যায় নোবেলের সাথে পরিচয় করে দেয়া হলেও বাদ পড়ে যাচ্ছিল ফিজিওলজি (Physiology) বা মেডিসিন। নাম শুনে আবার কেউ মনে করে বসো না শুধু ডাক্তাররাই এই শাখায় নোবেল পায়। জীববিজ্ঞানের আধুনিক শাখাসমূহ যেমন জৈবরসায়ন (Biochemistry), মলিকিউলার বায়োলজি বা অণুপ্রাণ বিজ্ঞান (Molecular Biology), মাইক্রোবায়োলজি বা অণুজীববিজ্ঞান (microbiology), জেনিটিকস বা বংশগতিবিদ্যা (Genetics), বায়োটেকনোলজি বা জীবপ্রযুক্তি (Biotechnology)- সবই এই শাখার অন্তর্ভুক্ত। এমনকি এই শাখায় এমন অনেকেই নোবেল পেয়েছেন যারা পড়াশুনা করেছেন অন্য বিষয় নিয়ে। আমরা আজ যে তিনজনের কথা বলবো তাদের দু’জনই ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র।

মূল আলোচনায় যাবার আগে চলো চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল সম্পর্কে কিছু টুকটাক তথ্য জেনে নেই। এ পর্যন্ত ২০৭ জন বিজ্ঞানী এই শাখাটিতে নোবেল পেয়েছেন। এর মধ্যে এককভাবে পাওয়া নোবেলের সংখ্যা ৩৮টি। এই শাখায় নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানীদের গড় বয়স ৫৮ বছর। চিকিৎসাবিদ্যায় সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল পেয়েছেন ফ্রেডারিক ব্যান্টিং (৩২)। অন্য দিকে পেইটন রৌস নোবেল পান সবচেয়ে বেশি বয়সে (৮৭)। মহিলা নোবেল লরেটদের মধ্যে বিজ্ঞানের এই শাখায় নোবেল প্রাপ্তদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। যেখানে মাত্র ১৬ জন মহিলা বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নোবেল পেয়েছেন, সেখানে তাদের ১১ জনই কিন্তু পেয়েছেন চিকিৎসায়!

আজকে আমাদের নোবেলের বিষয় হলো ডিএনএ। আর মেডিসিনে নোবেল পাবার ক্ষেত্রে ৪৮টি নোবেল নিয়ে এই শাখাটিই সবার শীর্ষে আছে। গত বছর মেডিসিনে নোবেলের মূল্য মান ছিল বাংলাদেশী টাকায় প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা।

কিছুদিন আগেও আমরা অনেকেই শুধু ইলেকট্রিক্যাল কিংবা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। এখন আমরা এর পাশাপাশি জেনেটিক বা বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নও দেখি। যে স্বপ্ননায়কেরা এই স্বপ্নের সূচনা করেছেন তারা হলেন মরিস উইলকিন্স, জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক। ১৯৫৩ সালে ডিএনএ আবিষ্কার করার মাধ্যমে ১৯৬২ সালে এই তিন বিজ্ঞানী DNA (Deoxyribonucleic Acid) ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।

Science 03

এই তিনজনের সাথে আরেকজনও আছেন যিনি নোবেল না পেলেও বাকি তিনজনের চেয়ে কোনো অংশে কম অবদান রাখেন নি। সেই ক্ষণজন্মা নারীটি হচ্ছেন রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন। ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন ছিল না। নোবেল প্রাইজ একসাথে তিনজনের বেশি দেয়ার কোনো বিধান নেই। একাকী পাওয়ারও কোনো সুযোগ হয়নি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার কারণে।

DNA নিয়ে জানার আগে এর আবিষ্কারকদের জীবনী সম্পর্কে খানিকটা জেনে এলে মন্দ হয় না।

প্রথমে আসি মরিস উইলকিন্সের কথায়। তার জন্মস্থান পাখির দেশ নিউজিল্যান্ডে। পড়াশুনা করেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। তিনি মূলত একজন নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার বিভীষিকা দেখে নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মে যায়। পরে তিনি বায়োফিজিকস নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে DNA এর গঠন বের করার চিন্তা প্রথম উইলকিন্সের মাথায়ই আসে।

জেমস ওয়াটসন জন্মেছিলেন আমেরিকার শিকাগো শহরে। তিনি শিকাগো ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাণিবিজ্ঞানে  ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ২৩ বছর বয়সে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ক্যাভেন্ডিস গবেষণাগারে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি তার পোস্ট-ডক্টরাল পড়াশুনার জন্য ডেনমার্কে যান। ১৯৫১ সালে প্রাণিবিজ্ঞানের ওপর এক সম্মেলনে তার পরিচয় হয় উইলকিন্সের সাথে এবং DNA নিয়ে তার গবেষণা সম্পর্কে অবহিত হন। তিনি উইলকিন্সের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং সেজন্যই আবার ক্যামব্রিজ ফিরে আসেন।

এবার আসি ফ্রান্সিস ক্রিকের কথায়। তিনিও পড়াশুনা করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডার ডেভেলপমেন্ট এবং ম্যাগনেটিক মাইন তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনিও ক্যাভেন্ডিস গবেষণাগারে যোগদান করেন এবং এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে কাজ করেন। তবে তিনি DNA এর এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে কাজ করেননি, কাজ করেছেন লোহিত রক্ত কণিকার প্রোটিন অণু হিমোগ্লোবিন নিয়ে।

Science 04

ওয়াটসন যখন ক্যামব্রিজে ফিরে আসেন তখন তিনি কাজের সহযোগী হিসেবে ক্রিককে নিয়ে আসতে চাইলেন। ক্রিকও রাজি হয়ে গেলেন। এবার দুইজন মিলে DNA এর এক্স-রে ইমেজ নেয়া শুরু করলেন এবং সব ছবি ও প্রাপ্ত ডেটার ওপর ভিত্তি করে DNA এর মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কাজ হচ্ছিল না। তারা তখন রোজালিন ফ্রাঙ্কলিনের আরো নিখুঁত ছবিগুলো দেখলেন। এখানেই ছিল মেধাবিনী ঐ মহিলা বিজ্ঞানী রোজালিনের অবদান। ওয়াটসন এবং ক্রিক অবশ্য তার অনুমতি ছাড়াই ছবিগুলো ব্যবহার করে ফেলেন যা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই ঠিক কাজ ছিল না।

যাই হোক, ওয়াটসন এবং ক্রিক রোজালিন ফ্রাঙ্কলিনের ছবির সাহায্যে DNA এর গঠন বের করেন। এরপর তাদের এই আবিষ্কার প্রকাশ করেন বিখ্যাত জার্নাল ‘ন্যাচার’-এ। তাদের এই কাজ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। আর তারা নোবেল পান ১৯৬২ সালে। কিন্তু তার আগেই- ১৯৫৮ সালে রোজালিন ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যু হয়। নোবেল না পেলেও DNA এর নামের পাশে রোজালিন ফ্রাঙ্কলিনের নাম লেখা থাকবে তাই স্বর্ণাক্ষরে।

এখন আসি DNA এর গল্পে। DNA হচ্ছে বংশপরম্পরায় বৈশিষ্ট্যের নির্ধারক ‘জিন’ এর ধারক ও বাহক। আমরা কেউ আমাদের বাবার মত, কেউ মায়ের মত আবার কেউ দাদা-দাদি বা নানা-নানীর মত হয়ে থাকি। DNA-B আমাদের পূর্ব পুরুষদের বৈশিষ্ট্য আমাদের মাঝে নিয়ে এসেছে এবং একইভাবে আমাদের বৈশিষ্ট্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাবে।

Untitled-4

DNA একটি পলিমারিক যৌগ যার মনোমার হচ্ছে নিউক্লিওটাইড। বিষয়টি একটি বিল্ডিং এর সাথে তুলনা করা যায়- বিল্ডিং যদি পলিমার হয় তবে তার মনোমার হবে ইট কারণ অসংখ্য ইট একত্রিত হয়েই তৈরি হয় বিল্ডিং। উল্লেখ্য, গ্রিক ‘পলি’ শব্দের অর্থ ‘বহু’ এবং ‘মার’ (mer) অর্থ ‘অংশ’। শব্দটির ব্যাকরণ বুঝতেই পারছো।

নিউক্লিওটাইড দিয়ে গঠিত হয় বলেই আরএনএ এর পাশাপাশি ডিএনএ ও আসলে এক ধরনের নিউক্লিক এ্যাসিড। DNA এর নিউক্লিওটাইড-এ তিনটি জিনিস থাকে- একটি পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট মনোস্যাকারাইড, নাইট্রোজেনাস ক্ষারক এবং একটি ফসফেট গ্রুপ। ক্ষারকরা আবার হতে পারে ৪ রকম- অ্যাডেনিন (A), থাইমিন (T), গুয়ামিন (G) ও সাইটোসিন (C)। এই ক্ষারকগুলো বিভিন্ন সমাবেশে DNA এর ডাবল হেলিক্সের দুই তন্তুর পাশে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে।

অসংখ্য নিউক্লিওটাইড একত্রিত হয়ে DNA অণুর এক একটি হেলিক্স তৈরি হয়। প্রাণী, কোষ ও গ্যামেটভেদে একেকটি ডিএনএতে আলাদা সংখ্যক নিউক্লিওটাইড থাকে। পাশাপাশি দুই হেলিক্সের নাইট্রোজেনাস বেসের মধ্যে থাকে হাইড্রোজেন বন্ধন যা তাদেরকে একত্রে রাখতে সাহায্য করে। আর সবকিছু মিলিয়ে DNA অণুর গঠন হছে টুইস্টেড বা বাঁকানো-অনেকটা মি. টুইস্ট চিপসের মতই। অধিকাংশ ডিএনএ অণুই?ট বায়োপলিমার দিয়ে যুক্ত হয়ে গঠন করে বিখ্যাত ডাবল হেলিক্স।

Untitled-5

প্রত্যেক প্রজাতির প্রাণীর DNA ই একই অক্ষের সাপেক্ষে আবর্তিত দুটি হেলিক্সের শিকল দিয়ে নির্মিত। উল্লেখ্য, ত্রিমাত্রিক কার্ভ বা বক্ররেখাকে গণিতের ভাষায় হেলিক্স বলে। হেলিক্সের পুরুত্ব ও ব্যাসার্ধ যথাক্রমে ৩৪ ও ১০ এ্যাংস্ট্রম। উল্লেখ্যে, ১ এ্যাংস্ট্রম হচ্ছে ১ ন্যানোমিটারের এক-দশমাংশ। এক ন্যানোমিটার আবার ১ মিটারের ১ বিলিয়ন তথা ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগের সমান। DNA কি বিশাল বড়, তাই না? এক একটি নিউক্লিওটাইড আবার লম্বায় ৩ দশমিক ৩ এ্যাংস্ট্রম।

ডিএনএ এর ক্ষদ্র এককগুলো এত ছোট হলেও ডিএনএ এর পলিমার নিজে কিন্তু লম্বায় অনেক বড়। যেমন ক্রোমসোম-১ নামক মানুষের বৃহত্তম ক্রোমসোমের ডিএনএ ২২ কোটি ক্ষারক জোড় দিয়ে তৈরি। একে লম্বালম্বিভাবে রাখলে ৮৫ মিলিমিটার জায়গা দখল করবে। পরিমাণটা ছোট্ট মনে হলেও মনোমারের তুলনায় কিন্তু সত্যিই বিশাল।

একটি কোষ তার নিয়মিত কাজগুলো করে যাবার জন্য যে যে প্রোটিন ও অন্যান্য অণুগুলোর প্রয়োজন হয়, ডিএনএতে তার সব তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে। ১৯৫৩ সালে ডিনএনএ এর ডাবল হেলিক্স আবিষ্কৃত হলেও ১৮৬৯ সালেই মিশার সর্বপ্রথম ডিএনএ শনাক্ত ও আলাদা করেন।

DNA এর মধ্যে রয়েছে জিন। আমরা আগেই বলেছি, এই জিনই আমাদের সকল প্রকার বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। জিন নিয়ে সারা বিশ্বে এখন ব্যাপক গবেষণা চলছে। আমাদের দেশও একেবারে পিছিয়ে নেই এক্ষেত্রে। কিছুদিন আগে আমরাও পাটের জিনোম সিকুয়েন্স আবিষ্কার করে দেখিয়ে দিয়েছি জিন নিয়ে মাথাব্যথা আমাদেরও কম নেই। একটি জিনের মধ্যে অবস্থিত নিউক্লিওটাইডের ক্রম (Order) খুঁজে বের করার নামই হলো ডিএনএন সিকুয়েন্সিং (DNA Sequencing)। এখনও এ নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। আমাদের ব্যাপন বন্ধুরাও একদিন জিন বা বিজ্ঞানের অন্য কোন শাখায় অবদান রেখে দেশকে উপহার দিবে নোবেল পুরষ্কার, আর বিশ্বকে উপহার দিবে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচনকারী আবিষ্কার-সেই আশা রেখে আজকের মত বিদায়। আল্লাহ হাফেজ।