| সাকিব হাসান |
ছোটবেলায় দেখা আলিফ লায়লা কিংবা গল্পে পড়া সিন্দবাদের অভিযানে সিন্দবাদ হারিয়ে যায় মাঝসমুদ্রে; সেখান থেকে কোন এক অজানা দ্বীপে। কোথায় আছে সে নিজেই জানে না। যদি এমন হত, তার হাতে একটা জাদুকরী যন্ত্র থাকত যেটা বলে দিত সে এখন কোথায় আছে! ধরো তুমি একজন পর্যটক, আমার মত বনে জঙ্গলে ঘুরতে পছন্দ করো। কয়েকজন বন্ধু আর ব্যাগপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে চলে গেলে জঙ্গলে, গভীর থেকে গভীর জঙ্গলে। আনন্দ উল্লাস করলে, নতুন কিছু আবিষ্কার করলে। কিন্তু ফেরার সময় বাধল বিপত্তি। ফেরার পথ আর খুঁজে পাচ্ছ না। পুরো একদিন পথ খোঁজার চেষ্টা করে দেখলে জঙ্গলের একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছ। কিভাবে ফেরত আসবে তোমার মায়ের কোলে! তখন মনে মনে কামনা করছ, কেউ একজন এসে হেল্প করুক, কেউ একজন পথ দেখাক। যদি তোমার হাতে এমন কিছু থাকত যা তোমাকে পথ দেখাত। হ্যাঁ, বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে সম্ভব একটা ছোট ডিভাইস তোমাকে পথ দেখিয়ে দিয়ে আসবে, ফিরিয়ে আনবে তোমাকে লোকালয়ে। কিন্তু কোন সেই ডিভাইস? কিভাবে সেটা কাজ করে? আজ তোমাদের তা জানানোর চেষ্টা করব।
তোমার অবস্থানকে সঠিকভাবে জানার জন্য যে প্রযুক্তি সেটা হল গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (Global Positioning System) বা সংক্ষেপে জিপিএস (GPS)। এটা আমেরিকার মালিকানাধীন স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেম যা তোমাকে যেকোন আবহাওয়ায় ও পৃথিবীর যে কোন জায়গায় তোমার অবস্থান এবং ওই জায়গার সময় জানাবে। একসময় মানচিত্র, কম্পাস, স্কেল ইত্যাদি দিয়ে মেপে ও অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানের অবস্থান নির্ণয় করা হত। এখন জিপিএস সিস্টেমের সাহায্যে খুব সহজে ও নিখুঁতভাবে পৃথিবীর কোন স্থানের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। আমেরিকান সরকার এই সিস্টেম তৈরি করেছে। জিপিএস ২৪ ঘন্টা কাজ করে এবং এর জন্য তোমাকে কোন সাবস্ক্রিপশন ফি কিংবা সেটআপ চার্জ দিতে হবে না। এটা পুরোপুরি ফ্রি। আমেরিকান প্রতিরক্ষা বিভাগ নিজস্ব প্রয়োজনে জিপিএস প্রযুক্তির কাজ শুরু করে ১৯৭৭ সালে। প্রথম জিপিএস স্যাটেলাইট ১৯৭৮ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে এর উন্নয়ন ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ১৯৯৫ সালে ২৪টি স্যাটেলাইটের সমন্বয়ে সৃষ্ট নেটওয়ার্ককে পৃথিবীর সব জায়গা থেকে ব্যবহারযোগ্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সিস্টেম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পূর্বে জিপিএস সিস্টেম শুধুমাত্র আমেরিকান মিলিটারিরা ব্যবহার করতে পারত। সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করতে দেয়া হত না। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন জিপিএস প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জিপিএস সিস্টেম তিনটি সেগমেন্ট নিয়ে গঠিত। স্পেস সেগমেন্ট, কন্ট্রোল সেগমেন্ট ও ইউজার সেগমেন্ট। আমেরিকান বিমান বাহিনী স্পেস ও কন্ট্রোল সেগমেন্ট-এর সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এখন জানা দরকার স্পেস সেগমেন্ট কী?
স্পেস সেগমেন্ট: ব্যবহারকারীদের কাছে রেডিও সিগন্যাল প্রেরণ করতে থাকা স্যাটেলাইটের সমাবেশ (constellation) নিয়ে স্পেস সেগমেন্ট গঠিত। অন্তত ২৪টি স্যাটেলাইট কর্মক্ষম রাখার জন্য আমেরিকা অঙ্গীকারবদ্ধ। এই অঙ্গীকারকে রক্ষা করতে আমেরিকান বিমান বাহিনী ৩১টি কর্মক্ষম জিপিএস স্যাটেলাইট পরিচালনা করছে। জিপিএস স্যাটেলাইট প্রায় ২০২০০ কিলোমিটার উচ্চতায় পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থান করে। প্রতিটি স্যাটেলাইট পৃথিবীকে প্রতিদিন দুইবার করে প্রদক্ষিু করে।
জিপিএস স্যাটেলাইট সমাবেশ (constellation) পৃথিবীকে প্রদক্ষিু করতে থাকা ৬টি সমদূরত্বের কক্ষপথ plane এ সাজানো থাকে। প্রতিটা plane এ চারটি করে স্লট (slot) থাকে। এই ২৪টি স্লট এমনভাবে সাজানো থাকে যে বস্তুত একজন ব্যবহারকারী পৃথিবী থেকে অন্তত চারটি স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্কের আওতায় থাকে। সাধারণত ২৪টিরও বেশি স্যাটেলাইট পরিচালনা করা হয় জিপিএস এর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কিন্তু অতিরিক্ত স্যাটেলাইটগুলো মুল স্যাটেলাইট constellation এর অন্তর্ভুক্ত ধরা হয় না।
জুন ২০১১ তে ২৪টি স্লটের মধ্যে ৩টি স্লট সম্প্রসারণ করা হয় এবং ৬টি স্যাটেলাইট পুনঃস্থাপন (reposition) করা হয় এবং আরও তিনটি অতিরিক্ত স্যাটেলাইট constellation এর অন্তর্ভুক্ত হয়। যার ফলে জিপিএস এখন ২৭টি স্লটের constellation এ পরিণত হয়েছে এবং পৃথিবীর কোনায় কোনায় আরও উন্নতমানের কভারেজ দিয়ে যাচ্ছে। স্পেস সেগমেন্ট-এর প্রাথমিক আলোচনার মধ্যে মোটামুটি এইটুকুই। এখন জানা দরকার কন্ট্রোল সেগমেন্ট সম্পর্কে।
কন্ট্রোল সেগমেন্ট: এই সেগমেন্ট এ আছে নেটওয়ার্ক সংযুক্ত পৃথিবীতে অবস্থিত কিছু স্টেশন। জিপিএস স্যাটেলাইটকে ট্র্যাক ও মনিটর করা, বিশ্লেষণ করা এবং কমান্ড ও তথ্য স্যাটেলাইট constellation এ প্রেরণ করা কন্ট্রোল সেগমেন্ট এর কাজ। বর্তমানে কন্ট্রোল সেগমেন্ট এ একটি মাস্টার কন্ট্রোল স্টেশন, একটি অতিরিক্ত মাস্টার কন্ট্রোল স্টেশন, ১২টি কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল এন্টেনা এবং ১৬টি মনিটরিং সাইট রয়েছে। এই স্টেশনগুলো ম্যাপে দেখানো হয়েছে। পৃথিবীর কোথায় কোথায় এই স্টেশনগুলো রয়েছে তোমরা তা ম্যাপ থেকে জানতে পারবে।
ইউজার সেগমেন্ট: এটি মূলত ব্যবহারকারীর অংশ। কিভাবে তুমি জিপিএস ড্যাটা পাবে? সাধারণত জিপিএস রিসিভার দিয়ে জিপিএস ড্যাটা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে জিপিএস রিসিভার কেনাটা একটু ব্যয়বহুল। তবে উন্নত বিশ্বে অনেক কম খরচে জিপিএস রিসিভার পাওয়া যায়। তাই বলে মন খারাপ করো না। তোমার মোবাইল ফোনটা কিন্তু জিপিএস রিসিভার। বর্তমানে প্রায় সকল স্মার্ট ফোনেই জিপিএস এর সুবিধা থাকে। তোমার মোবাইলে গুগল ম্যাপে তোমার সঠিক অবস্থান কিভাবে দেখায় জানো? এই জিপিএস এর সাহায্যে। তাছাড়া কিছু মোবাইল এপ আছে যেগুলো তোমাকে তোমার অবস্থানের জিপিএস ড্যাটা দেখাতে পারবে। তোমার অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ জানাতে পারবে। তবে মোবাইল জিপিএস-এর ড্যাটাতে কিছুটা বিচ্যুতি থেকে যায়।
জিপিএস তোমাকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেবেঃ
– আমি কোথায়?
– আমি কোথায় যাচ্ছি?
– আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য উত্তম রাস্তা কোনটি?
– কখন আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছাবো?
– আমি যেখানে আছি সে জায়গায় এখন ঘড়িতে কয়টা বাজে?
জিপিএস এর ব্যবহারঃ জিপিএস এর কোন সীমিত ব্যবহার নেই। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাজে জিপিএস ব্যবহার হচ্ছে। তবুও তোমাদের জানার জন্য কয়েকটা উদাহরন দেই।
– কৃষিকাজে
– বিমানচালনায়
– পরিবেশ বিজ্ঞানে ও রিসার্সে
– সামুদ্রিক কাজে ও জাহাজ চালনায়
– পাবলিক সেফটিতে
– দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যাবস্থাপনায়
– রেল পরিচালনায়
– বিনোদনে
– সড়ক ও জনপথ
– লোকেশন ট্র্যাকিং এ
– জরিপ ও ম্যাপিং এ
– সময় নির্ধারনে
– সেনাবাহিনীতে
– ছোট বাচ্চাদের অবস্থান জানতে
– গাড়ি ট্র্যাকিং এ ও চুরি যাওয়া গাড়ি খুঁজে বের করতে
এছাড়া আরও অনেক কাজে জিপিএস ব্যবহার হয় যা আমাদের কল্পনারও বাইরে। উপরে উল্লেখিত উদাহরণগুলোর বিস্তারিত আর লিখলাম না। তোমরা আস্তে আস্তে নিজেরাই পড়াশুনা করে সব জানতে পারবে এই বিশ্বাস আমার আছে। লেখার শুরুতে বলেছিলাম জঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে গেলে, এবার জিপিএস ডিভাইস নিয়ে গেলে আর হারাবেনা তুমি। কারন জিপিএস ডিভাইসে তুমি যে পথ দিয়ে গিয়েছ সেটা মার্ক হয়ে থাকবে। ফেরার সময় সেই পথ ধরে আবার ফিরে আসতে পারবে। তো, হারিয়ে যাও যেখানে খুশি, কিন্তু আসলে তা-তো আর পারবেনা, যদি জিপিএস ডিভাইস সাথে থাকে…।
No Comment