| অঙ্কন চৌধুরী |

হঠাৎ বিকট আওয়াজের মিসাইল আঘাত হানল। চারদিকে মানুষের হাহাকার এবং তীব্র চিৎকার। কী হল? সবার একই চিন্তা! কী বিভীষিকা ! কী হল? তাহলে আর কেউ না।  ড্রোন!  ড্রোন!  হ্যাঁ, ড্রোন এর কথাই বলছি। ড্রোন এখনকার সময়ের নতুন ঝলক।

ড্রোন DRONE) শব্দের আভিধানিক অর্থ গুঞ্জন। এর চলার শব্দের সাথে মৌমাছির গুঞ্জন এর মিল থাকার কারনেই এর এই নাম। ভালই তো মিল। ইহা মনুষ্যবিহীন বিমান। মানে কি জানো? এটি পাইলট ছাড়াই আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে। শুধু কি তাই, এ বিমান আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, শত্রুদের বেতার ও রাডার সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। অবাক করা বিষয় হল, নিজ দেশের আকাশসীমা পাহারা দেয়া, আড়ি পেতে তথ্য জোগাড় করা থেকে শুরু করে প্রয়োজনে আরও ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। আর মজার ব্যাপার কি জানো, এসব বিমান পাইলটবিহীন হওয়ায় যুদ্ধে পাইলটের মৃত্যুঝুঁকি থাকে না তাই যে কোনো পরিস্থিতিতে এ ধরনের বিমান ব্যবহার করা যায়। কত্তো সুবিধা! এতক্ষনে নিশ্চয় তোমাদের কৌতূহলী মন জানতে চাচ্ছে কোথা থেকে আসলো আবার এই ড্রোন? চলো  ইতিহাস পাতা থেকে জেনে আসি এর উৎপত্তির আসল কাহিনী।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রথম এর সূচনা। সেই পেছনের কথা যখন তোমাদের জন্মও হয়নি। ১৯৫৯ সালে আমেরিকার বিমান বাহিনী প্রথম এই মনুষ্যবিহীন বিমান তৈরিতে হাত দেয়। ১৯৬৪ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধে টনকিন উপসাগরে প্রথম ব্যবহার হয় এই পাইলটবিহীন যুদ্ধবিমান। এরপর ১৯৭৩ সলে আমেরিকা স্বীকার করে তারা ভিয়েতনামের যুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করেছে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সিরিয়ার মিসাইল ব্যাটারী যখন একের পর এক ইসরাইলী বিমানকে ধারে কাছে ভিড়তে দিচ্ছিল না, তখন আসলো প্রযুক্তির খেলা। তখন চমক দেখিয়ে ইসরাইল তৈরী করে UAV. এরপর থেকে শুরু হয়ে যায় ড্রোনের প্রচলন। ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধে ইসরাইল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে ড্রোন। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার সেনাবাহিনী আরো আধিকমাত্রায় ব্যবহার করে এই ড্রোন।

কিন্তু কিভাবে উড়ে এই ড্রোন? দেখো, এটা দেখতে অনেকটা  উড়োজাহাজ এর মত।  মূলত ড্রোন বার্নোলি সমীকরণ (Bernoulli Equation) মেনে চলে। চারটি বলের সমন্বয়ে ড্রোন চলে। যখন বাতাস  বক্র জায়গার পাখার উপর দিয়ে যায় তখন এটি  বেশি পথ অতিক্রম করে। কিন্তু যখন একই ঘনত্বের সমান বাতাস পাখার নিচ দিয়ে যায় তখন এটি কম পথ অতিক্রম করে । যখন বাতাস বেশি বেগে যায় তখন চাপ কমে যায়। ফলে পাখার উপরে বাতাসের উচ্চবেগ এবং নিম্নচাপের কারণে পাখা উপরে lift করে, যার ফলে ড্রোন ফ্লাইট করে। ওজন বল বিপরীত দিকে ড্রোনটির lift ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে। ইঞ্জিনের ধাক্কা ড্রোনটিকে সামনের দিকে বাতাসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলে। আর টান বল (Drag) যেটা বাতাসের মধ্যে দিয়ে গেলে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে। ফলে ড্রোনটি বাতাস মাড়িয়ে সামনে যেতে পারে ও ভারসাম্য রক্ষা হয়।

তোমাদের কাছে কি কঠিন লাগছে? তর সইছে না আর। আজকেই শিখতে হবে কিভাবে তৈরি করা যায় এই ড্রোন। কিভাবে কন্ট্রোল করা যায় এটাকে। জানতেই হবে। ঠিক আছে, এসো জেনে নেই। ড্রোন সিস্টেমে যা যা থাকে –

(i) চালক বিহীন বিমান

(ii) গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম (Ground Control System)

(iii) ডাটালিংক (Datalink)।

বিজ্ঞানের জাদুতে এইসব কারিশমা দিয়ে এইবার আমরা কন্ট্রোল করবো ড্রোন। হ্যাঁ, উপগ্রহ ড্রোন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা পাঠিয়ে দেয় ভূমিতে অবস্থিত রিসিভারে। রিসিভার থেকে তা যায় গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেমে। এই গ্রাউন্ড কন্টোল সিস্টেমে থাকেন পাইলট। কম্পিউটারের সাহায্যে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে নির্দেশ দেন যা মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছিয়ে দেয় বিমানে এবং বিমান পাইলটের নির্দেশ পালন করে। পুরো ঘটনাতে সময় লাগে কত জানো ? – মাত্র ২ সেকেন্ড। কি বিজ্ঞানের সাহস! ভূমিতে বসে আকাশ নিয়ন্ত্রণ।

বিভিন্ন ধরনের ড্রোন রয়েছে। Unmanned Air Vehicle, Unmanned Aircraft System, Remotely Piloted Aircraft এর কাজ অনুসারে ড্রোনকে ৬ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা – (১) টার্গেট বিমান (২) গোয়েন্দা বিমান (৩) আক্রমণ বিমান (৪) পরিবহন বিমান (৫) গবেষনা ও উন্নয়ন বিমান (৬) বেসামরিক ও বানিজ্যিক বিমান ।

বিশ্বে আলোচিত বিভিন্ন ড্রোনঃ 

(১) RQ – 170 – Sensial: রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম যা ৫০০০০ হাজার ফুট উপর দিয়ে উঠতে পারে

(২) MQ – 1 Predator:  অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্যামেরা ও সেনসর সংবলিত এ ড্রোনটি ১০০০০ ফুট উপরে উঠে

(৩) Scar Eagle: ইহা গোয়েন্দা বিমান

(৪) এইটান (Eitan)

(৫) হারপি (Harpy)

(৬) সেলেক্স গালিলো ফ্যালকো (Selex Galileo Falco)

ওদিকে ইরান বিশ্বের প্রথম ‘ভিটিওএল’ ড্রোন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ভার্টিক্যাল টেকঅফ ও ল্যান্ডিংয়ের ক্ষমতা সম্পন্ন ড্রোনকে সংক্ষেপে ভিটিওএল ড্রোন বলা হয়। এ ধরনের ড্রোনের উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য কোনো ধরনের রানওয়ের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো স্থান থেকে সোজা ওপরে উঠতে পারে এবং যে কোনো স্থানে নেমেও যেতে পারে। সম্প্রতি ইরানের গবেষকরা ১০০ কেজি ওজন বহনে সক্ষম ড্রোন তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন। ইরানের তৈরি লিকু নামের ওই ড্রোন রাডার ফাঁকি দিয়ে একাধারে ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম।

আমরা কি পেছনে আছি। না, না। মজার বিষয় হল, বাংলাদেশে এখন ড্রোন তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রথম ড্রোনটি কবে তৈরি করা হয়েছিলো জানো? না, এখন না, দুই বছর আগেও না, প্রথমদিককার একটি ড্রোন তথা দূরনিয়ন্ত্রিত উড়োযান তৈরি করা হয়েছিলো আজ থেকে ২২ বছর আগে সেই ১৯৯২ সালে। বুয়েটের তড়িৎকৌশল বিভাগের ছাত্র মোঃ আসিফুর রহমান অন্তুর মাথায় হঠাৎ ভূত চাপলো, ড্রোন বানাবেন। তখন ইন্টারনেট নেই, কিছু জানতে হলে লাইব্রেরিতে গিয়ে এ বই, সে বই ঘেঁটে ঘেঁটে বেড়াতে হতো । কিন্তু কিভাবে? প্লেন ডিজাইন করতে পারেন এমন কেউ তো নেই আশে পাশে। অন্তু থামলেন না, ব্রিটিশ কাউন্সিলের সংগ্রহে থাকা একটি ম্যাগাজিনে প্লেনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার একটি সার্কিট পেলেন। এর সাথে যোগ করলেন নিজের ডিজাইন করা একটি সার্কিট। বুয়েটের ল্যাব থেকে কিছু কেমিক্যাল ধার করে নিজেই বানিয়ে নিলেন সেই সার্কিট বোর্ড। এবার, প্লেনটা বানাবার পালা। ডিজাইন আছে। কিন্তু প্লেনের বডি বানাবার জন্য লাগবে দুষ্প্রাপ্য সব উপকরণ। কিন্তু অন্তুকে দমিয়ে রাখা গেলো না। বরিশালের দেশলাই ফ্যাক্টরি থেকে জোগাড় করলেন ম্যাচবক্সে ব্যবহৃত হালকা ওজনের কাঠ, যা দিয়ে বানানো হলো প্লেনের বডির কিছু অংশ। ধাতব অংশের জন্য এলুমিনিয়াম পেলেন তেজগাঁর পুরানো এয়ারপোর্টের ময়লার স্তুপ থেকে। সেই এলুমিনিয়ামের টুকরা ধোলাইখালে গলিয়ে বানানো হলো প্লেনের বডি। ইঞ্জিনের গিয়ার বানালেন পাটুয়াটুলির ঘড়ির দোকানে পাওয়া প্লাস্টিক গিয়ার দিয়ে। আর রাইফেলের গুলির একটি খোসা জোগাড় করে নিয়ে সেটা দিয়ে বানালেন ইঞ্জিনের পিস্টন। নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে নিজেই তৈরী করে ফেললেন প্লেনের ইঞ্জিনের ফুয়েল। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই প্লেনটি দিব্যি উড়ে গেলো আকাশে।  অন্তুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলো।

উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালেয়ই ড্রোন তৈরি হচ্ছে। তাহলে তো আমরাও শুরু করতেই পারি।

ড্রোন আজকে আমাদের কাজকে অনেক সহজ করে দেয়েছে, তাই না। অনেক কঠিন ও বিপদসংকুল কাজ এখন হাতের নাগালে। ড্রোন ব্যবহারের ফলে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত পাইলটের দরকার নেই। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পরিবেশে এটি কাজ করতে পারে। ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত আকাশে থেকে দিন রাত এমনকি অন্ধকারের মধ্যেও কাজ করতে সক্ষম। কুয়াশা বা মেঘের মধ্যেও সঠিকভাবে দ্রুততম সময়ে বারবার স্ক্যান করতে পারে। কোন এলাকার মোবাইল ফোন, রেডিও বা টেলিভিশন সংকেতকেও পর্যবেক্ষন করতে পারে। অনেকক্ষেত্রে  গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ হারালেও এটি  স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে সক্ষম। অনুসন্ধান ও উদ্ধার তৎপরতায় এটি পাহাড়–পর্বত মরুভূমি বা যেকোন পরিবেশ উদ্ধারে, উদ্ধার এলাকা চিহ্নিতকরণে, জাহাজ ও নৌচলাচল পর্যবেক্ষণে, বায়ুদূষণ মাত্রা নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়।

তবে এটাক এখনো অনেক ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার করা হয়। শক্তিশালী দেশগুলো এটা যুদ্ধে ব্যবহার করছে। অনেক সময় সঠিক যোগাযোগ না থাকায় ড্রোন কন্ট্রোল করা যায় না । ফলে অনেক ধরনের ক্ষতি হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টফার হেইন্স সংস্থাটির সাধারণ পরিষদের কাছে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান । শীর্ষ দুটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন পাকিস্তান ও ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের চালকবিহীন বিমান হামলার কঠো (ড্রোন) সমালোচনা করেছে। সংগঠন দুটি বলছে, এসব হামলায় বেআইনি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং কিছু ঘটনা যুদ্ধাপরাধের শামিল।

আসলে আমরা হাঙ্গামা চাই না। আমরা চাই না ড্রোন দিয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হোক। মরা যুদ্ধের দামামা চাই না, আমরা শান্তির পথে ড্রোনকে কাজে লাগাতে দেখতে চাই। বিজ্ঞানকে আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে দেখতে চাই। এই হোক আমাদের দাবি।