।মুশফিকুর রহমান।

১৭১২ সালে থমাস নিউকমেন (১৬৬৪-১৭২৯) খনি থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য নিউকমেন স্টিম ইঞ্জিন নামক বাষ্পচালিত পানির পাম্প তৈরি করেন। এরপরে  ১৭৬৯ সালে জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯) বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন। এরপরে ১৮৮২ সালে এডিসন ইলেকট্রিক লাইট স্টেশন হলে প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। যেখানে ১২৫ অশ্বশক্তির বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। এটাই প্রথম বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

মূলত শিল্পবিপ্লব ছিল শক্তির বিপ্লব। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের উদ্ভাবনেই মাধ্যমেই এই বিপ্লব শুরু হয়েছিল। এর মাধ্যমে মানুষ ও পশুর শ্রমকে যন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বলতে তাপ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সকল কেন্দ্রকে (যেমন গ্যাস, ডিজেল,নিউক্লিয়র এবং বাষ্প) বুঝায়। আজ আমরা বাষ্প দিয়ে চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে জানবো।

 

জেমস ওয়াট ও থমাস নিউকমেন

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে তাপ ইঞ্জিনের মাধ্যমে যান্ত্রিক শক্তি উৎপাদিত হয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়্‌ তাপশক্তির পুরোটা যান্ত্রিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে না, কিছু তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।  তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দক্ষতা সাধারনত ৩৩-৪৮% হয়ে থাকে।

সৌরবিদ্যুৎ বাদে বাকি সব বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতি প্রায় একই। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানিকে তাপ দিয়ে বাষ্পে পরিণত করে টারবাইনকে ঘুরানো হয়। আর টারবাইনের সাথে জেনারেটর কাপলিং করা থাকে। টারবাইন ঘুরার ফলে জেনারেটরও ঘোরে আর আমাদের কাঙ্খিত তড়িৎ উৎপন্ন হয়।

 

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গঠন

 

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র মূলত দুই পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। ওপেন সাইকেল আর ক্লোজ সাইকেল। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গঠন প্রক্রিয়া অনেক সহজ। তোমরা চিত্র দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো? প্রথমে বয়লারে থাকা পানিকে তাপ দিয়ে বাষ্পে পরিণত করা হয়। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উৎপাদিত বাষ্পকে আবার উত্তপ্ত করা হয়। এই উচ্চ চাপ ও তাপ সম্পূর্ণ বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘোরানো হয়। প্রথম টারবাইন ঘুরানোর পরেও বাষ্পে যথেষ্ট চাপ থাকায় তা দিয়ে দ্বিতীয় টারবাইন ঘুরানো হয়। পরিত্যক্ত বাষ্পকে আবার পানিতে রূপান্তরের জন্য কন্ডেন্সার (Condenser) ব্যবহার করা হয়।

কন্ডেন্সার মূলত ঠাণ্ডা পানির সংস্পর্শে বাষ্পকে ঘনীভূত করে পানিতে রূপান্তর করে। সিস্টেম লসের কারণে ঘাটতি পূরণে বাইরে থেকে পানি সরবরাহ করা হয়। রূপান্তরিত পানি আর নতুন পানি পাম্পের মাধ্যমে আবার বয়লারে প্রেরণ করা হয়। প্রেরণের পূর্বে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ফিড ওয়াটার (নতুন পানি) চিমনির পরিত্যক্ত ধোঁয়া অথবা বাষ্প দিয়ে ফিড ওয়াটারকে পুনরায় উত্তপ্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ১৫-২০% জ্বালানি সাশ্রয় হয়। এই প্রক্রিয়াটি বারবার আবর্তন হয় বলে একে ক্লোজ সাইকেল বলা হয়। আর টারবাইনকে ঘুরানোর পর পরিত্যক্ত বাষ্পকে যদি পুনরায় ব্যবহার না করা হয় তাকে ওপেন সাইকেল পদ্ধতি বলা হয়। তবে শীতপ্রধান দেশে পরিত্যক্ত বাষ্পকে ঘর-বাড়ি ও খামারে ব্যবহার করা হয়।

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বয়লার হলো মৌলিক অংশ। বয়লার বলতে পানি রেখে উত্তপ্ত করার পাত্রকেই বোঝায়। সাধারণত বয়লারের পরিধি ৫০ ফুট (১৫ মিটার), দৈর্ঘ্য ১৩০ ফুট (৪০ মিটার)  আর পূরুত্ব  ২.৩ ইঞ্চি হয়। বয়লার সাধারনত দুই ধরণের হয়ে থাকে, ফায়ারটিউব বয়লার আর ওয়াটারটিউব বয়লার। ফায়ারটিউব (Firetube) বয়লারের ভিতরে আগুন থাকে আর বাইরে থাকে তরল পদার্থ। আর ওয়াটারটিউবের ভিতরে থাকে তরল আর বাইরে আগুন। তবে ব্যয়বহুল ও জটিল হলেও ফায়ারটিউব বয়লার বেশি নিরাপদ।

 

টিউব বয়লার

 

সাধারণত ১০০ ডিগ্রী সেঃ তাপে পানি বাষ্প হয়। তবে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বয়লারে বাষ্পের তাপমাত্রা ৩০০  ডিগ্রী সেঃ এর উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্টিম টারবাইন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে মূলত জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস বা ফার্নেস অয়েলও ব্যবহার করা হয়। দেশের সবচেয়ে বড় স্টিম টারবাইন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নরসিংদী জেলার ঘোড়াশালে অবস্থিত। ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি এবং ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিটের মাধ্যমে এ কেন্দ্রটি সর্বমোট ৯৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম।

দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়ায় অবস্থিত। এ কেন্দ্রে রয়েছে ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মোট দুটি ইউনিট। একই ক্ষমতার আরেকটি ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে চীন। উৎপাদনের ৬৫.৫% আসে তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। তার চাহিদার ৭৫% পূরণ করে তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে পরিবেশ সম্পর্কিত নানা সমস্যা ও সমালোচনা রয়েছে। সহজ গঠনপ্রনালী, কম খরচ ও জ্বালানির সহজলভ্যতার কারণে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়ে থাকে। তবে পরিবেশের কথা চিন্তা করে যতদুর সম্ভব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো উচিৎ।

আজ এ পর্যন্তই, ভালো থেকো আবার দেখা হবে.

 

নভেম্বর-ডিসেম্বর। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৪