| প্রকৌশলী সাব্বির আহমেদ |

তোমরা তো জানোই পৃথিবীতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে মানুষ, কিন্তু মানুষের পর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী কোনটি? তা কি তোমরা জানো? এই তো কিছুদিন হলো গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, মানুষের পর ডলফিনই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী! এ নিয়ে অবশ্য বিতর্কও আছে। কয়েকজন বিজ্ঞানী বলছেন, প্রাণীটির হাসি-হাসি মুখ দেখে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি!’ সে তর্কে আমরা না-ই গেলাম, কিন্তু নিঃসন্দেহে পানিতে দাপাদাপি করে বেড়ানো প্রাণীটি বেশ মজার! আসো আজ আমরা মজার প্রাণী ডলফিন নিয়ে গল্প করবো।

আগেই বলে রাখি, ডলফিন কিন্তু কোনো মাছ নয়, এরা স্তন্যপায়ী। তারা মাছের মত পানিতে বসবাস করে, সাঁতার কাটে কিন্তু মাছের মত ডিম পাড়ে না। মা ডলফিন ছোট্ট বাচ্চা ডলফিনের জন্ম দেয়। সেই ছোট্ট ডলফিন মায়ের দুধ খেয়ে বড় হতে থাকে। আর এজন্যই এদের স্তন্যপায়ী বলা হয়ে থাকে। অনেকে ধারণা করেন, একসময় ডলফিন ডাঙায় বাস করত। পরবর্তী সময়ে ডাঙায় প্রতিকূল পরিবেশ আর জলে খাদ্যের প্রাচুর্য দেখে এরা পানির সঙ্গেই খাপ খাইয়ে নিয়েছে। যদিও এর পেছনে খুব একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
পৃথিবীতে ১৭টি গণে প্রায় ৪০টি প্রজাতির ডলফিন রয়েছে। ৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৪০ কেজি ওজন থেকে শুরু করে ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১০ টন ওজন পর্যন্ত বিভিন্ন আকারের ডলফিন দেখা যায়। পৃথিবীজুড়ে সব স্থানেই ডলফিন দেখা যায়, বিশেষ করে মহীসোপানের কাছের অগভীর সমুদ্রে এদের অবস্থান বেশি। ডলফিন মাংসাশী প্রাণী, মাছ এবং স্কুইড এদের প্রধান খাদ্য। ধারণা করা হয় দশ মিলিয়ন বছর আগে মায়োসিন যুগে ডলফিনের উদ্ভব। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা আমাদের কাছে ডলফিনকে খুবই জনপ্রিয় করে তুলেছে।

ডলফিনের শরীর
ডলফিনের শরীর এমনভাবে তৈরি যাতে করে সে দ্রুত চলাফেরা করতে পারে। তাদের শরীরের সামনের দিকে দুটি ডানার মত অংশ রয়েছে এগুলোকে বলা হয় ফ্লিপার (Flipper)। পানির মধ্যে চলাফেরা করা, সাঁতার কাটা এবং ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ডলফিন এই ফ্লিপার ব্যবহার করে। বেশিরভাগ ডলফিনের পেছনে একটা লম্বা পাখনা আছে। তার এই লম্বা লেজটাকে বলে ফ্লুইক্স (Flukes) ডলফিন তার এই ফ্লুইক্স দিয়ে পানিতে ঢেউ তুলে সাঁতার কাটে। ডলফিনের চামড়ার নিচে থাকে পুরু চর্বির আস্তরণ। এই চর্বির জন্যই তাদের শরীরের তাপমাত্রা ঠিক থাকে। এমনকি ঠান্ডা পানিতেও ডলফিনের শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য ঠিক থাকে।

ডলফিনের শ্বাসগ্রহণ
ডলফিন সমুদ্রে থাকে অথচ পানি থেকে শ্বাস নিতে পারে না। আগেই বলেছি এরা স্তন্যপায়ী প্রাণী। তাই পানিতে বসবাস হলেও এরা মানুষের মতোই বাতাসে শ্বাস নেয়। এজন্য কিছুক্ষণ পর পর এদের পানির উপর ভেসে উঠতে হয়। সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর মত ডলফিন ফুসফুস দিয়েই শ্বাস গ্রহণ করে। তার মাথায় একটি ছিদ্র আছে যার সাহায্যে সে নিঃশ্বাস নেয়। সে বড় শ্বাস নিয়ে পানির ভেতরে চলে যায়। একবারে সে দুইশত ফুট গভীর পর্যন্ত যেতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখার জন্য ডলফিনকে দুই-তিন মিনিট পরপরই পানির উপরে চলে আসতে হয়। শ্বাসগ্রহণের সুবিধার কথা চিন্তা করেই ডলফিন সবসময় সমুদ্রের উপরের উপরের স্তরে থাকে।

এখন তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যখন ডলফিন ঘুমিয়ে পড়ে তখন সে কিভাবে শ্বাস নিবে? সে যদি পানিতে ডুবে যায়? মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়, অর্থাৎ আমি চাই বা না চাই ফুসফুস নিজের মতো স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যায়। কিন্তু ডলফিনের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বয়ংক্রিয় নয়, সেটা তাদের সচেতন সিদ্ধান্তের বিষয় হওয়ায় ডলফিন যদি ঘুমিয়ে পড়ে এবং সময়মতো না জাগে, তাহলে দম আটকে মারাও যেতে পারে। এই বিপদের সমাধান হিসেবে ডলফিনের মস্তিষ্কের অর্ধেক কিছুক্ষণ ঘুমায়, বাকি অর্ধেক ঘুমায় পরের পালায়। তাদের অন্তত অর্ধেক মস্তিষ্ক সবসময় জেগে থাকে, তাই তারা শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ঘুমের মধ্যেও প্রয়োজনীয় সময়ে ভেসে ওঠে। মাঝে-মধ্যে ডলফিনকে পানির প্রায় উপরিতলে হালকাভাবে নিস্তেজ অবস্থায় ভেসে থাকতে এবং চক্রাকারে ঘুরতে দেখা যায়। এটাই তাদের ঘুমন্ত অবস্থা। ডলফিনের ঘুমের এ বিষয়টি বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাফির (ইইজি) মাধ্যমে। এই পদ্ধতিতে ডলফিনের মাথায় তার লাগিয়ে মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। এভাবে প্রাপ্ত ইইজির ফলাফলে দেখা গেছে ঘুমের সময় ডলফিনের অর্ধেক মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে। বলা যায়, আমরা যেমন কখনো কখনো আধা ঘুম আধা জাগরণের মধ্যে থাকি, ডলফিনের ঘুমও সেরকম।

ডলফিনের খাবার-দাবার
ডলফিন খাবার দাবারের বেলায় বেশ সৌখিন। মাংস ছাড়া অন্য কিছু তার মুখে রোচে না। ডলফিনদের প্রিয় খাবার ছোট ছোট মাছ। তারা মাছ ধরে ধরে শিকার করে এবং আয়েশ করে খায়। অক্টোপাসও তার খাদ্য তালিকায় বড় স্থান জুড়ে রয়েছে। তার খাবারে মেন্যুতে আরো রয়েছে কচ্ছপ ও সামুদ্রিক পাখি। ডলফিনের রয়েছে ২৫০টির মত ধারালো দাঁত। তারা এগুলো শিকারকে কামড়ে ধরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং চিবিয়ে খায়। ডলফিন প্রায়ই দলবদ্ধভাবে শিকারে বের হয়। মাছেরা যখন ঝাঁক বেঁধে চলাফেরা করে তখন ডলফিন দল চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। অতঃপর এক যোগে আক্রমণ করে ফলে মাছেরা আর পালাতে পারেনা।

ডলফিনদের কথা বলা
ডলফিন শব্দ তৈরি করতে পারে। একে ক্লিক সাউন্ড বলে। গভীর সমুদ্রে কাদাযুক্ত স্থানে যেখানে খুব অন্ধকার সেখানে ডলফিন এই সাউন্ড সৃষ্টি করে তার প্রতিধ্বনির শুনে অনুমান করতে পারে তার সামনে কোন বাঁধা আছে কি নেই। তারা এই শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কথা বিনিময় করে, ভাব বিনিময় করে, শিকার ধরার পরিকল্পনা করে, শত্রুকে ঘায়েল করার চক তৈরি করে। কিছু কিছু ডলফিনের প্রজাতি সুর করে গান করতে পারে। ডলফিনরা খুব কেয়ারিং। যখন কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় সে সাহায্যে আবেদন করে ডাক দেয়। তার এই ডাক যারাই শুনতে পায় তারাই ছুটে আসে সাহায্য করার জন্য। যখন কোন ডলফিন আহত হয় বা অসুস্থ হয় তখন সঙ্গীরা তাকে ভেসে থাকতে সহায়তা করে যাতে সে ডুবে না যায়। এই সহযোগিতা অনেক ডলফিন মানুষকেও করেছে। এই ধরণের উদাহরণ আছে অনেক, জাহাজডুবির পর ডলফিনরা দলবেঁধে মানুষদের উদ্ধার করে পাড়ে তুলে দিয়েছে।

সামাজিক প্রাণী ডলফিন
সামুদ্রিক প্রাণীদের মাঝে মানুষের খুব প্রিয় একটি প্রাণী হল ডলফিন। এর বুদ্ধি আর মিশুক আচরণের ভক্ত সবাই। এরা মানুষের কাছাকাছি থাকতে খুব পছন্দ করে। তাই ডলফিনকে মানুষের কল্যাণের কাজে লাগানোর জন্য সকল চেষ্টাই করছেন বিজ্ঞানীরা। ডলফিন একটি বুদ্ধিমান প্রাণী। প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে বানরের মত এরাও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে। এমনকি সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে বয়স্ক ডলফিন থেকে বাচ্চা ডলফিন জ্ঞান আহরণ করতে পারে, ঠিক যেমনটা মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
সাম্প্রতিককালে ডলফিনদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে মনোচিকিৎসা দেওয়ার কাজে। অত্যন্ত মিশুক এবং চঞ্চল এই প্রাণীটি মানসিক প্রতিবন্ধকতা, “ডাউন সিনড্রম” এবং অটিসমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেরে উঠতে সাহায্য করে। মিলিটারি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ডলফিনদেরকে। হ্যাঁ, তোমরা অবাক হলেও ঘটনা ঠিকই। ডুবে যাওয়া জাহাজের খোঁজ করার জন্য মানুষকে উদ্ধার করা জন্য এদের ব্যবহার করা হয়। সদা চলমান এই প্রাণীটিকে চলমান ক্যামেরা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এদের চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সীমান্ত পাহারার কাজও করছে নৌবাহিনী।

ডলফিনদের প্রাকৃতিক বসবাসের এলাকাগুলোতে মানুষের অনধিকার প্রবেশের কারণে ডলফিনদের অস্তিত্ব হয়ে পড়ছে বিপন্ন। মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে কমে আসছে এদের বাসস্থান এবং খাদ্য সংগ্রহের এলাকা, পানি দূষণের ফলে এরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাছাড়া অসাধু লোকদের অবৈধ শিকারের জন্য ডলফিন দিনে দিনে সংখ্যায় কমছে। যা খুবই উদ্বেগজনক। আজ তবে এই পর্যন্তই।