।ডা. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম।
হাফিজের গোঙ্গানীর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল হাফিজের স্ত্রীর। হাফিজ কোন কথা বলছে না। শুধু অস্ফুট শব্দ বের হয়ে আসছে তার মুখ থেকে। কয়েকবার ডাকার পরেও সাড়া না পেয়ে একটু ধাক্কা দিতেই গোঙ্গানীর আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তার মাঝে ক্লান্তি আর ভয়ের ছাপ এখনও স্পষ্ট। হাফিজের সমস্যটা আজ নতুন নয়। ছোট বেলা থেকে এমন ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে হাফিজের।
ঘুমের মধ্যে কখনও হয়ত কোন ভয়ংকর প্রানী তার বুক চেপে ধরেছে হত্যার উদ্দেশ্যে, আর সে মুক্তির আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারছে না। সে চিৎকার করে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে কিন্তু তার মুখ থেকে কোন শব্দও বের হচ্ছে না। অথবা কেউ ধাওয়া করছে আর সে মুক্তির জন্য দৌড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। ধরে ফেলার মূহুর্তে অথবা ধরে ফেলার পরপর ক্লান্তির ছাপ নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে।
ঘুমের মধ্যে এসব ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি কিছু সুখকর বা মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে হাফিজের। কোন আক্রমণ বা ভীতিকর অবস্থা হতে মুক্তির জন্য তার হাতটাকেই পাখা বানিয়ে উড়তে শুরু করেছে এবং নিরাপদ দূরুত্বে যাওয়ার পর তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সহজেই নিজ দেশ অথবা প্রভাবশালী কোন দেশের রাষ্ট্র প্রধানের সাথে দেখা হওয়া আর কথা বলতে পেরে পুলকিত হয়েছে।
ঘুম ও স্বপ্নের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সবার ক্ষেত্রে এক হয় না। অনেকে আছে ঘুমের মধ্যে জাগাতে গেলে মারমুখী আচরণ শুরু করে। কেও কেও স্বপ্নের মধ্যে প্রীতি ভলিবল ম্যাচ খেলার সময় হেড করতে গিয়ে পাশে ঘুমানো কারও মাথায় আঘাত করে বসে। স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের কেও হয়ত খেলার ফাঁকে মাঠের পাশে অতি নির্জনে প্রস্রাব করতে গিয়ে বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে। স্বপ্ন মূলত আমাদের কর্ম ও চিন্তার প্রতিফলন। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন,প্রতি রাতে আমরা ৪-৬ বার স্বপ্ন দেখি।
ঘুম ও স্বপ্ন কেন প্রয়োজন?
Gary L. Wenk তার Your Brain on Food নামক বইয়ে লিখেছেন, দিনে আমরা যা করি তার দ্বারাই রাত্রি প্রভাবিত হয়। আমরা দিনে যেসব তথ্য সংগ্রহ করি তার কিছু অংশ রেখে দিয়ে বেশীরভাগই মুছে ফেলার প্রয়োজন হয়। আমাদের মস্তিষ্ক নিয়মিত পরিষ্কার না করলে অনর্থক জিনিসে তা পূর্ণ হয়ে যাবে। তথ্যগুলোর পূর্ণ প্রক্রিয়ার জন্য মস্তিষ্কের কার্যক্রম বন্ধ করা প্রয়োজন, বাইরের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হল কাজ করার জন্য আমাদের শুধুমাত্র একটা মস্তিষ্কই রয়েছে।
ঘুম গবেষক রবার্ট স্টিকগোল্ড এর মতে, আমরা জাগ্রত অবস্থার চেয়ে ঘুমের মধ্যে বেশী কাজ করে থাকি। আমাদের মস্তিষ্ক ২ ঘন্টা অনলাইনে (জেগে থেকে) ব্যয় করে যে নতুন তথ্য সংগ্রহ করে, তার অর্থ খুঁজে বের করার জন্য ১ ঘন্টা অফলাইন (ঘুম) প্রয়োজন। আগে থেকে সংগৃহীত তথ্য প্রস্তুত করার জন্য (ব্যবহার উপযোগী) নতুন তথ্য গ্রহন বন্ধ করতে মস্তিষ্কের অফলাইন বা ঘুমের প্রয়োজন।
মস্তিষ্কের মধ্যে তথ্য ব্যবস্থাপনার জন্যই শুধু ঘুম প্রয়োজন তা নয় বরং দেহের কাজ সঠিক ভাবে সম্পাদনের জন্যও ঘুমের প্রয়োজন। উদাহরণস্বরুপ, রাতের একটি ভাল ঘুম পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য একটা ভ্যাক্সিনকে সক্ষম করে তোলে। অপর্যাপ্ত ঘুম শরীরের ইনসুলিন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এটা গবেষণা স্বীকৃত যে, ঘুম স্মৃতি জমা করার মাধ্যমে শিখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দিপ্ত করার মাধ্যমে রোগের সাথে লড়াই করতে সক্ষম করে ,আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সম্ভবত মুটিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুম ও স্বপ্ন বিশেষজ্ঞ রুবিন নাইমান বলেন, ভাল স্বপ্ন সুস্থ স্মৃতি রক্ষার্থে সহায়তার মাধ্যমে আমাদের মানসিকভাবে ভাল থাকতে ভূমিকা রাখে, বিষণ্ণতা দূর করে এবং সাধারণ সীমাবদ্ধ জ্ঞানকে প্রশস্ত আত্মিক জগতে বিস্তৃত করে।
কতটুকু ঘুম প্রয়োজন?
একজন মানুষের ঠিক কতটুকু ঘুম প্রয়োজন তা ব্যক্তির বয়স,শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। ।আবার একই বয়সের সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ঘুমের পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। যাইহোক বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, তুমি যদি দিনের বেলা তন্দ্রা অনুভব কর এমনকি বিরক্তিকর কাজের ক্ষেত্রেও তা অনুভব হয় তাহলে তোমার পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের নতুন সুপারিশ অনুযায়ী বিভিন্ন বয়সের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ঘুমের পরিমান নিম্নরূপ-
ঘুম ও স্বপ্নের মধ্যে কি ঘটে?
ঘুমের ২ টা মূল পর্যায় আছে । ১. REM sleep(Rapid Eye movement sleep): এ সময়েই আমাদের স্বপ্ন দেখার প্রবণতা বেশী থাকে। ২. Non REM sleep: এ সময় মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কম থাকে এবং আমরা অধিকাংশই স্বপ্ন দেখি না।
১৯৫৩ সালের পরে যখন বিজ্ঞানীরা ১ বছর বয়সী বাচ্চাদের ঘুমের ক্ষেত্রে প্রথম REM sleep এর বর্ণনা দিলেন, তখন থেকেই তারা সতর্কতার সহিত ঘুম এবং স্বপ্ন নিয়ে গবেষনা শুরু করলেন। তারা দ্রুতই অনুধাবন করলেন যে, অদ্ভূত ও অযৌক্তিক অভিজ্ঞতা যেটাকে আমরা স্বপ্ন বলে থাকি প্রায় সব সময় REM sleep এর মধ্যেই ঘটে থাকে। বেশীর ভাগ স্তন্যপায়ী এবং পাখিদের ক্ষেত্রে REM sleep প্রদর্শিত হলেও সরিসৃপ এবং অন্য শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীরা তা প্রদর্শন করে না।
REM sleep শুরু হয় মস্তিষ্কের ভিত্তি হিসেবে কাজ করা ‘পনস্’ নামক অংশ থেকে সিগনাল আসার মাধ্যমে। এই সিগনাল মস্তিষ্কের থ্যালামাসে যায় যা আবার সিগনালটিকে মস্তিষ্কের কর্টেক্সে (বহিরাংশ) পাঠিয়ে দেয় যে অংশটি তথ্য জানা, চিন্তা করা একত্রীকরনের(সংরক্ষনে ) জন্য দায়ী। ‘পনস্’ স্পাইনাল কর্ডেও সিগনাল পাঠিয়ে তার স্নায়ুগুলোর কাজ বন্ধ করে দেয় যা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাংশ পেশীগুলোকে অবশ করে ফেলে। এই প্রক্রিয়ায় কোন ব্যাঘাত ঘটলে মানুষ শারীরিক ভাবে স্বপ্ন থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে যা বিরল মারাত্মক REM sleep behavior disorder নামে পরিচিত। REM sleep মস্তিষ্কের এমন একটি অংশকে উদ্দিপ্ত করে যা জানার কাজে ব্যাবহৃত হয়। এটা ১ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের মস্তিষ্ক ডেভেলপমেন্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে যে কারনে তারা প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় বেশী ঘুমায় বলে ব্যাখ্যা করা যায়।
কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, স্বপ্ন হল REM sleep এর সময় মস্তিষ্কের কর্টেক্স কর্তৃক যথেচ্ছভাবে গৃহীত সংকেতের মর্ম খুঁজে বের করার প্রয়াস। কর্টেক্স হল মস্তিষ্কের এমন একটা অংশ যা কোন কিছু ইন্টারপ্রিট করে এবং চেতন অবস্থায় পরিবেশ থেকে সংগৃহীত তথ্য সংগঠিত করে।
Gary L.Wenk তার Your Brain on Food নামক বইয়ে লিখেছেন, প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বেই (বর্তমান ধারণা অনুযায়ী) মস্তিষ্ক রাতকে ২ ধরনের ঘুমের মাধ্যমে বিভক্ত করে স্মৃতি প্রক্রিয়াকরণ সমস্যা সমাধানের পর্যাপ্ত সক্ষমতা অর্জন করেছিল।
যার একটি বর্তমানে short wave sleep (Non REM sleep) এবং অপরটি rapid eye movement sleep (REM sleep) নামে পরিচিত।আমরা যে কোন স্তরে স্বপ্ন দেখতে পারি কিন্তু তার মধ্যে গুণগতভাবে বেশপার্থক্য বিদ্যমান। short wave sleep এবং REM sleep এর অনন্য এবং অপূর্ব বৈশিষ্ট্যই আমাদের বলে দেয়,আমরা আসলে কেন ঘুমাই এবং কেন স্বপ্ন দেখি।দিনে আমাদের শেখা অনেক কিছুই মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসে জমা হয়। তারপর আমরা যখন short wave sleep স্তরে থাকি তখন হিপ্পোক্যাম্পাস সামনের কর্টেক্সকে movie (দিনে ধারণকৃত চিত্র গুলো) দেখাতে ব্যস্ত থাকে। মুভিগুলো অস্বাভাবিকভাবে প্রচুর তথ্যে ঠাসা থাকে।ঘটনাগুলো ১০ গুণ বেশী গতিতে প্রদর্শিত হতে থাকে। short wave sleep স্তরে স্বপ্নগুলো বেশীরভাগই স্থির,পুরাতন স্মৃতি অথবা পুরোপুরি আবেগময়। তুমি যদি কখনও স্বপ্নে দেখ যে, তোমাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে অথবা কোন জন্তু তোমার বুকে চেপে বসেছে তাহলে সম্ভবত তুমি সে সময়ে short wave sleep স্তরে আছ। দুঃস্বপ্ন,বিছানায় প্রস্রাব করা,ঘুমভাব নিয়েই হাঁটা,ভীত সন্ত্রস্তভাবে জেগে ওঠার ঘটনাগুলো অধিকাংশ লোকজনেরই short wave sleep স্তরে ঘটে।
এরপর যখন আমরা গভীর ঘুম স্তরে প্রবেশ করি তখন নতুন তথ্য প্রসেসিং করার জন্য সামনের কর্টেক্সকে সুযোগ করে দিতে হিপ্পোক্যাম্পাসের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কর্টেক্স অপ্রয়াজনীয় তথ্য থেকে প্রয়োজনীয়গুলো বাছাই করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। এ সময়ে দেখা স্বপ্নগুলো বর্ণনাযোগ্য এবং বাস্তব অনুভূত হয়।
তথ্যসূত্রঃ
- PsychCentral.com
- livescience.com
- psychologytoday.com
- sleepfoundation.org
নভেম্বর-ডিসেম্বর।বর্ষ ৪।সংখ্যা ৪
No Comment