।যায়েদ শাহনেওয়াজ।

ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ারের কথা কখনো শোনেনি বা জানেনা এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথবা ব্যাটম্যান! যে কিনা বাদুড়ের মুখোশে মানুষকে সাহায্য করে থাকে। হলিউডের এসকল চরিত্র সামনে আসলে একটি মাত্র প্রাণীর কথাই শুধু মাথায় আসে। আর তা হলো বাদুড়।

তো বন্ধুরা, কতটুকু জানি আমরা এই বাদুড় সম্পর্কে? স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র  উড়তে সক্ষম এই  প্রাণীটি দেখতে যতটা ভয়ঙ্কর আদতে এরা কিন্তু ততটাই নিরীহ। বাদুড়কে Bat বা Flying fox বা উড়ন্ত শিয়ালও বলা হয়। এরা মূলত স্তন্যপায়ী শ্রেণীর Pteropus বর্গের প্রাণী।

ছোটবেলায় আমরা পড়েছি, বাদুড় চোখে দেখতে পায় না, এরা পথ চলে শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘Echolocation’। আসলে কিন্তু এরা মোটেও অন্ধ নয়। এবং মজার ব্যাপার হলো, বাদুড়ের একটি উপবর্গ Megabat বা Megachiroptera সরাসরি দেখার মাধ্যমেই পথ চলে বা শিকার করে।

এদের Fruit bat বা Old World fruit bats ও বলা হয়ে থাকে। এরা বাদুড়ের সবচেয়ে বড় প্রজাতি। Fruit bats এর ঘ্রাণশক্তি প্রবল। এরা উড়ে বেড়ানো পোঁকা-মাকড়ও শিকার করতে পারে।

চিত্র-১ঃ Fruit Bat পথ চলে চোখে দেখেই

ব্যতিক্রম শুধু মিশরীয় ফ্রুট ব্যাট। এরা সাধারণত গুহায় বাস করে এবং জিহ্বা দিয়ে একপ্রকার শব্দ করে গুহায় উড়ে বেড়ায়। বাদুড়কে অনেকে ভয় পায় এদের সূঁচালো দাতের জন্য। বাদুড় বাঁচে ফলমূল, ফুলের রস বা মধু খেয়ে। কিছু প্রজাতি পোকামাকড় খায়। সাধারণত এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে এদের দেখা মেলে।

ধারণা করা হয়, বর্তমান বর্গ Pteropus বহু প্রাচীন Megachiropteran থেকে এসেছে। আমেরিকায় প্রাপ্ত একটি ফসিল থেকে ধারণা করা হয় যে, প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর পূর্ব থেকে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে এরা।

বাদুড় সাধারণত উল্টোদিকে ঝুলে থাকে। তারা তাদের পায়ের নখর দিয়ে কোন বস্তুকে আঁকড়ে ঝুলে থাকতে পারে। এটি বাদুড়ের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য।যখন উড়বার প্রয়োজন হয়, এরা নখর উন্মুক্ত করে দেয়। এদের ডানা থাকা সত্ত্বেও এরা পাখিদের মত স্বাভাবিকভাবে উড়তে পারেনা।

প্রায় ৬ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে যারা ঝুলতে পারে না। তারা তাদের পায়ের শোষণকারী প্যাড ব্যবহার করে যে কোন সমতলে আটকে থাকতে পারে। ঝুলে থাকা অবস্থায় খাবার খাওয়ার জন্য এরা যেকোন একটি পা এবং ডানায় থাকা নখর ব্যবহার করে। বেশ মজার ব্যাপার, তাইনা?

চিত্র-২ঃ মিশরীয় ফ্রুট ব্যাট

আমরা সকলেই জানি বাদুড় যে পথে খাদ্য গ্রহণ করে ঠিক সে পথেই মলমূত্র ত্যাগ করে। কিন্তু এটা কি জানি যে, বাদুড়ের মল থেকে পাওয়া যায় মূল্যবান সম্পদ! বাদুড়ের মলকে গুয়ানো বলা হয় এবং এতে থাকে উচ্চমাত্রায়  পটাসিয়াম নাইট্রেট যা সল্টপিটার নামে পরিচিত। এটি উৎকৃষ্ট মানের সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এটা থেকে আরো তৈরী করা যায় গানপাউডার এবং বিষ্ফোরক দ্রব্য। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় এসকল বস্তু মূলত বাদুড়ের মল থেকেই তৈরী করা হতো। এছাড়া ফসিল সংরক্ষণেও গুয়ানো ব্যবহার করা হতো।

বাদুড় যে খাবার খায় তা হজম করতে তার সময় লাগে আধ ঘন্টা থেকে সর্বোচ্চ একঘন্টা। এই দ্রুত পরিপাক প্রক্রিয়া তাকে ভারমুক্তভাবে উড়তে সহায়তা করে। আরো কিছু স্তন্যপায়ী রয়েছে যারা লাফ দিয়ে ভেসে থাকতে পারে। এদের মধ্যে ফ্লায়িং স্কুইরেল অন্যতম।

পৃথিবীতে প্রায় ১২০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। এদের অধিকাংশই নিরামিষাশী আর কিছু প্রজাতি পোকা মাকড় খায়। কিন্তু তিন ধরণের প্রজাতি রয়েছে যারা রক্তচোষা। এদের সাধারণত ভ্যাম্পায়ার বলা হয়ে থাকে। Pteropus vampyrus হচ্ছে এমন একটি প্রজাতি।

তবে ভয় পাবার কিছু নেই। এরা যাকে কামড়াবে সে ই ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। এদের লালায় বিভিন্ন প্রজাতির ভাইরাস থাকে যা থেকে রোগ সৃষ্টি হতে পারে।

চিত্র-৩ঃ ফ্লায়িং স্কুইরেল

সম্প্রতি আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়া নিপাহ্ ভাইরাসটিও বাদুড়ের অবদান (!)। তবে যে যা ই বলুক না কেন, সন্ধ্যা বেলায় গাছের ডালে বাদুড় ঝুলতে দেখা খানিকটা গা ছমছমে ব্যাপারই বটে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাদুড়ের অনেক প্রজাতিই ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এই প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেলে সেটা যে পরিবেশের উপর একটি বিরূপ প্রভাব ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

তাই পরিবেশবিদদের উচিত এর সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। আর হ্যাঁ,ভ্যাম্পায়ার নামটা বাদুড়ের একটি প্রজাতি থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ড্রাকুলার সাথে বাদুড়ের কি সম্পর্ক থাকতে পারে ভেবে দেখেছো কি?

জুলাই-আগস্ট ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ২