।মোঃ শফিকুল ইসলাম।

(পর্ব-৩)

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের আনঅফিসিয়াল যাত্রা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েতের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) সময়। ১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ যুদ্ধে প্রথমবারের মত সোভিয়েতকে পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়। কিন্তু সোভিয়েতও দমে যাবার পাত্র নয়। তারা আর দ্বিতীয়বার হারার জন্য প্রস্তুত নয়। এজন্যই তারা মহাকশে সবচেয়ে বেশি সময় বিচরণ করার রেকর্ড গড়তে ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল সর্বপ্রথম ‘সালিউট-১ (Slayut-1)’ নামক সর্বপ্রথম স্পেস স্টেশন পাঠায় মহাকাশে।

মহাকশে লম্বা সময় বিচরণ এবং মিলিটারি সার্ভেইল্যান্সের পাশাপাশি মহাশূন্যে মানুষের শরীর খাপ খাওয়ানো ছিল সালিউটের অন্যতম মিশন। মহাকাশে অবতরণ এবং বিচরণের জন্য প্রথম যে বাধা সালিউটকে অতিক্রম করতে হয় তা হল- পৃথিবীর আকর্ষণ বল উপেক্ষা করে তার কক্ষপথে বিচরণ করা। সালিউটের পরিকল্পনা ছিল তিনজন ক্রু নিয়ে তিন সপ্তাহ মহাশূন্যে বিচরণ করা। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সালিউটকে পুরো সময় প্রতি ঘণ্টায় ২৮,০০০ কি.মি. বেগে চলতে হবে। রকেটের মাধ্যমে এই বেগ অর্জন করা সোভিয়েতের জন্য কঠিন কোন কাজ ছিল না। আর একবার মহাশূন্যে পাঠতে পারলে তো আর চিন্তা নাই, ওখানে এভাবেই চলতে থাকবে আজীবন।

সালিউট-১

মহাশূন্যকে ভ্যাকুয়াম বা বায়ুহীন হিসেবেই কল্পনা করা হত, এবং এ কারনেই নাম দেয়া হয়েছিল- মহা শূন্য। কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন প্রমাণিত হলো। মহাশূ্ন্যেও খুবই ক্ষুদ্র এবং অল্প পরিমান বায়ুকণা রয়েছে যেগুলো কম সময়ের মহাকাশ যাত্রার জন্য কোন সমস্যা নয়। কিন্তু সালিউটের ভ্রমণকাল ছিল তিন সপ্তাহ। আর এই লম্বা সময়ে ঐ ক্ষুদ্র বায়ুকণার আঘাতই বিধ্বংসী প্রমাণিত হল। বায়ুকণার আঘাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সালিউটের বেগ যদি কমতে থাকে তাহলে সালিউটের পক্ষে কক্ষপথে থাকা অসম্ভব হয়ে পরবে এবং একসময় তা ভূপাতিত হয়ে যাবে।

এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা একটা অতিরিক্ত রকেট সালিউটের পেছনে জুড়ে দেয়ার চিন্তা করলো। এখানে নতুনদের জন্য বলে রাখি, যেকোনো মহাকশযানই রকেটের মাধ্যমে মহাশূন্যে প্রেরণ করা হয় কিন্তু এটা ঐ যানের মূল কোনো অংশ নয়। পৃথিবীর অভিকর্ষের প্রভাব মুক্ত হওয়া মাত্রই রকেট ছেড়ে দেয়া হয় এবং মহাকাশযান পূর্বে অর্জনকৃত বেগে চলতে থাকে। সেই হিসেবে স্পেস স্টেশন সালিউটেও মহাশূন্যে পৌঁছানোর পর আর কোন রকেট সাথে ছিলোনা। এখন, ক্ষুদ্র বায়ুকণার আঘাতে বেগ যাতে কমে না যায় সেজন্য একটি রকেটের মাধ্যমে শক্তির যোগান দেয়ার চিন্তা করা হয়। কিন্তু রকেট অনেক শক্তিশালী হলেও এর ভর অনেক এবং জ্বালানী ক্ষণস্থায়ী। এটি রকেট সালিউটের জন্য শেষ পর্যন্ত বিপদজনক হতে পারে।

এ সমস্যার সমাধান ঘটায় কোরিয়ান যুদ্ধ। কোরিয়ান যুদ্ধ? যুদ্ধও কি কোন কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে? আসলে পারে না। তবে যুদ্ধের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে প্রযুক্তির অনেক দ্রুত বিকাশ ঘটে। তোমরা যারা এই সিরিজের প্রথম লেখা পড়েছ তারা নিশ্চয় স্মরণ করতে পারো যে মানুষের প্রথম মহাকাশে পাঠানো বস্তু ছিল একটি জার্মান মিসাইল। কোরিয়ান যুদ্ধ কীভাবে সালিউটের ভূপাতিত  হওয়ার সমস্যার সমাধান দিল তা বলার আগে এই যুদ্ধ সম্পর্কে একটু বলে নিই, তা নাহলে আবার তোমাদের মনে একটু খটকা লেগে থাকবে। ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কোরিয়া ছিল জাপানের শাসনাধীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কোরিয়াতে জাপানের ৩৫ বছরের শাসন শেষ হয় এবং কোরিয়ার অংশবিশেষ যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতের হাতে পরে। কিন্তু এদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের দরুন একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে কোরিয়া প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি বরং উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুইটি জাতির জন্ম হয়। ১৯৫০ সালে দুই কোরিয়া সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির সাথে সাথে একে অপরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে।

ইউএস মিলিটারি রকেটম্যান

স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েতসহ অন্যান্য দেশ এতে অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদেরকে দ্রুত একস্থান থেকে সরিয়ে আরেক স্থানে নেয়ার জন্য খুবই ছোট আকারের রকেট ব্যবহার করা হয় যেটা পিঠে লাগিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে উড়ে যাওয়া যায়। এই রকেটে খুবই সাধারন একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো হয় যাতে জ্বালানী অনেক কম লাগে, বিনিময়ে অনেক শক্তি পাওয়া যায়। বিক্রিয়াটি হল হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের (H2O2) ডিকম্পোজিশন বা ভাঙ্গন। অল্প পরিমান H2O2 উপযুক্ত পরিবেশে ভাঙ্গতে পারলে অক্সিজেন আর প্রচুর পরিমাণ পানি বাষ্প আকারে বের হয় যা দিয়ে রকেটম্যানকে সহজেই উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কোরিয়ান যুদ্ধের এই রকেটম্যান আইডিয়া দিয়েই সালিউটের পতন ঠেকানো হয়। H2O2 এর ডিকম্পোজিশন রিঅ্যাকশন দ্বারা পরিচালিত কিছু ক্ষুদ্র রকেট সালিউটের গায়ে জুড়ে দেয়া হয় যা সময়ে সময়ে পরিচালিত হয়ে সালিউটকে তার কক্ষপথে ধরে রাখে। আর এভাবেই ২১ দিনের মিশন থাকলেও ২৩ দিন মহাকাশে অবস্থান করে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সালিউট।

সালিউট প্রেরণের সমসাময়িক কালে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের স্পেস স্টেশন বা স্পেস ল্যাবের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলো। যদিও তারা এই পদক্ষেপে সোভিয়েতের পেছনে পরে যায় কিন্তু খুব দ্রুতই রসদসহ ময়দানে ফিরে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের এই রসদের নাম হল ‘স্কাইল্যাব (Skylab)’ । ১৯৭৩ সালের ১৪ই মে স্কাইল্যাব তিনজন ক্রুসহ মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। ক্রুসংখ্যায় সালিউটকে (সালিউটেরও ক্রু ছিল তিনজন) অতিক্রম করতে না পারলেও সালিউটের ২৩ দিন অবস্থান রেকর্ড গুড়িয়ে দিয়ে সর্বমোট ৮৪ দিন মহাশূন্যে অবস্থান করে স্কাইল্যাব।

স্কাইল্যাব

সালিউটের মত কক্ষপথে বিচরণ নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি স্কাইল্যাবের কিন্তু নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। তা হল- পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ (Communication)। স্কাইল্যাবের স্বত্ত্বাধিকারীরা চাচ্ছিলো সার্বক্ষণিক স্কাইল্যাবের ক্রুদের সাথে যোগাযোগ রাখতে। আর এজন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো রেডিও ওয়েব। কিন্তু সমস্যা হল রেডিও ওয়েব কেবলমাত্র সরলরেখা বরাবর কাজ করে। অর্থাৎ স্কাইল্যাব কেবলমাত্র যখন পৃথিবীতে অবস্থিত কন্ট্রোল রুমের রেডিও ওয়েব বরাবর আসবে তখনই যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। স্কাইল্যাব প্রতি ৯০ মিনিটে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে। সুতরাং প্রতি দেড় ঘন্টায় একবার অল্প কিছু সময়ের জন্য স্কাইল্যাবের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব যা পর্যাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত গ্রহণের জন্য একেবারেই অপ্রতুল।

এ সমস্যা সমাধানের জন্য নাসা (NASA  হলো যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান) ভূ-পৃষ্ঠে অতিরিক্ত ১১ টি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন স্থাপন করে। কিন্তু এতেও সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরিভাগ যোগাযোগের বাইরেই থেকে যায়। এজন্য জাহাজের উপরে স্টেশন স্থাপন করা হয়। কিন্তু একটা জাহাজে কি আর পুরো সমুদ্র কভার করা যায়, আর মহাকাশযানের গতির সাথে পাল্লা রেখে কি জাহাজ চলতে পারে? নাসার আরো গতিশীল কিছু রেডিও রিসিভার দরকার তাই আগের সব আইডিয়া বাদ দিয়ে বিমানের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। বিমানের মাথায় রেডিও রিসিভার বসিয়ে নাসার আটটি বিমান স্কাইল্যাবের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়িয়ে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ স্থাপন প্রক্রিয়া সফলভাবে সমাধান করা হয়।

পৃথিবী আর চাঁদকে সাক্ষী রেখে অ্যাপোলো আর সয়ুজের ঐতিহাসিক বিয়ে

মহাশূন্যে বিচরণ হলো, অবস্থান হল এমনকি পৃথিবীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগও স্থাপন হলো। এবার মহাকাশে ঘর বাঁধার পালা। তো বিয়ে ছাড়া কি ঘর বাঁধা যায়? সেটি ভূমিতেই হোক আর আসমানেই হোক। জ্বি বন্ধুরা, মহাকাশে বসবাসের এই পর্যায়ে একটা বিয়ের খুব দরকার। আর এই বিয়ে যেনতেন বিয়ে নয়। দুই চিরশত্রুর বিয়ে। হুম, মহাকাশ গবেষণার দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত আর যুক্তরাষ্ট্রের মিলনের মাধ্যমে শুরু হয় মহাকাশে ঘর বাঁধার প্রাথমিক প্রক্রিয়া। ঐতিহাসিক এই মিলন কীভাবে সম্ভব হলো? আর এই মিলনের ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয়া অ্যাপোলো-সয়ুজ (Apollo-Soyuz)  প্রজেক্ট কীভাবে মহাকশে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারল সেই কাহিনী কি জানতে চাও? জানতে চাইলে চোখ রাখো আগামী ব্যাপন পর্বগুলোর পাতায়। ঠিক ঠিক হাজির হব এক সময়। সেই পর্যন্ত আল্লাহ হাফিজ।

নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৪