| আহমদ আব্দুল্লাহ |
কোন কোন প্যারাডক্স সবার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। আর সব প্যারাডক্সই কারো না কারো মাথা ঘুরিয়ে দেয়। তোমাদের কারো যদি মাথা নাও ঘুরে, তবে আমার নিজের মাথা ঘোরার মাধ্যমে আমার বাণীটি (গণিতের ভাষায় বললে ‘প্রতিজ্ঞাটি’) সত্য হচ্ছে। তবে এই প্রতিজ্ঞাটি থুক্কু বাণীটি কোন এক মনীষীর- যাকে আমি গাণিতিক প্রতিজ্ঞার রূপ দিয়েছি।
আজকে প্যারাডক্সের মই বেয়ে আমরা উপরে উঠবো। তবে আগে একটি প্রাসঙ্গিক কৌতুক। তোমরা কি সেই কৌতুকটা শুনেছো?
দুই বন্ধু গল্প করছে-
১ম বন্ধু : আমার দাদার বিশাল এক গোয়ালঘর ছিল। সে গোয়ালঘরের এক প্রান্ত থেকে কোন বাছুর হাঁটা শুরু করলে, অন্য প্রান্ত দিয়ে বের হতে হতে বয়স্ক গরু হয়ে যেত।
২য় বন্ধু: আরে রাখ তোর দাদার গোয়ালঘর। আমার দাদার ছিল ইয়াবড় আর লম্বা এক মই। সে মই দিয়ে আমার দাদা নীল আর্মস্ট্রংদের আগেই চাঁদ ভ্রমণ করে এসেছেন।
১ম বন্ধু : বললেই হলো। অতবড় মই রাখত কোথায়?
২য় বন্ধু : কেন? তোর দাদার গোয়ালঘরে!
তুমিও চাইলে হিসেব শুরু করে দিতে পারো, পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত যেতে কত লম্বা মই লাগবে, আর গরুর বাছুর বয়স্ক গরু হবার জন্য একটানা কত পথ হাঁটতে হবে। এরপর মিলিয়ে দেখো মইটাকে আসলে গোয়ালঘরে রাখা যাবে কিনা। ততক্ষণে আমি অন্যদের নিয়ে আরেকটি প্যারাডক্সে ডুব দেই।
আচ্ছা বলো তো ৩ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি মইকে কি আড়াই ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি ঘরে দৈর্ঘ্য বরাবর রাখা যাবে? যারা একটু কৌশলী তারা হয়তো ভাবছো হ্যাঁ, যাবে। একটু বাঁকা করে উপর-নিচ করে রাখলেই তো কেল্লা ফতে! না রে ভাই, তা করা যাবে না। এবার কেউ কেউ অন্য পথ ধরবে। বলবে, ঘরের দুই বিপরীত বেড়ায় দুটি ছিদ্র করে মইখানা ছিদ্র দিয়ে ঝুলিয়ে রাখবো। তাতে মইটির কিছু অংশ হয়তো বাইরে থাকবে। কিন্তু রাখা তো গেছে।
না! ওসব হবে না।
সর্বশেষ হয়তো ভাবছো মইটাকে দুইভাগ করে ফেলি। এটা শুনে সাহিত্যিক ইব্রাহিম খাঁর একটি গল্পের কথা মনে পড়ল। এক চাচা জমি কিনতে কিনতে এতো বেশি কিনেছেন যে রাখার জায়গা নেই। পরে, একটা জমির উপর আরেকটা নাকি ভাঁজ করে রেখেছেন!
আমরা এত কষ্ট করতে রাজি নই। চলো, তার চেয়ে একটু আইনস্টাইনের সাথে দেখা করে আসি।
১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। আপেক্ষিক তত্ত্বের একটি অন্যতম অংশ হলো দৈর্ঘ্য সংকোচন। এই নীতির বক্তব্য হলো, গতিশীল অবস্থায় বস্তুর দৈর্ঘ্য হ্রাস পায়। আরো আনুষ্ঠানিক ভাষায় বললে, “কোন পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে গতিশীল বস্তুর দৈর্ঘ্য ঐ পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে নিশ্চল অবস্থায় ঐ একই বস্তুর দৈর্ঘ্যরে চেয়ে ছোট হবে”।
দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে কত হবে, সেটা নির্ভর করবে বস্তুর বেগ আলোর বেগের কত কাছাকাছি তার ওপর। এর মান বের করারও সূত্র আছে। ধরা যাক, কোন দর্শকের সাপেক্ষে কোন বস্তুর নিশ্চল অবস্থায় দৈর্ঘ্য L, ঐ বস্তুটির বেগ V এবং ঐ দর্শকের সাপেক্ষে V বেগে চলার সময় বস্তুটির দৈর্ঘ্য l,, তাহলে বস্তুটির দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে দাঁড়াবে,
যেখানে, C হলো আলোর বেগ যার মান প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩০ কোটি মিটার। বুঝতেই পারছো, বেগ আলোর অনেক কাছাকাছি না হলে দৈর্ঘ্য যথেষ্ট সংকুচিত হবে না। যেমন, ৩ ফুটের মইকে আড়াই ফুট করতে হলে বেগ কত হতে হবে, যদি আমরা বের করি, তবে তা দাঁড়াবে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১২ কোটি মিটার!
আচ্ছা, মনে করলাম আমরা এখন ৩০০০ সালে বাস করি এবং এই বেগ অর্জন করা আমাদের বাম হাতের খেল। তাহলে, এখন যদি এই মইটাকে এই বেগটি দিয়ে ঐ ঘরের মধ্যে চালনা করে দেই তাহলে কী হবে? ধরো, মইটাকে ঘরে প্রবেশের সুবিধার জন্যে বিপরীত প্রান্ত বরাবর দুই পাশে দুটি জানালা কেটে রাখলাম। এবার মইটা খোলা জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে একেবারে আঁটসাঁট হয়ে বসে যাবে। তোমার আগের ট্রিকসের মত কিন্তু এখানে মইটা একটুও বেরিয়ে থাকবে না। মই ছোট হয়ে যাওয়ায় ঘরের দৈর্ঘ্যই মইকে ধারণ করবার জন্যে যথেষ্ট।
এখন পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু আবার প্যারাডক্স তৈরি হলো তোমার আরেক বন্ধুর ভাবুক মনের কারণে। সে বলতে চাইলো-আমরা যখন ট্রেনে করে কোথাও যাই, তখন রাস্তা বা আশেপাশের বাড়ি-ঘর, গাছপালা আমাদের একই বেগে বিপরীত দিকে ছুটে যায়। ট্রেন ও রাস্তা দু’জনেই একে অপরের সাপেক্ষে গতিশীল। তাহলে মইয়ের এখানেও মই ও ঘর দুটোই একে অপরের সাপেক্ষে গতিশীল। অতএব ঘরকে স্থির বিবেচনা করলে মই ছোট হবে, ঠিক আছে। কিন্তু ঘরও তো আসলে মইয়ের সাপেক্ষে গতিশীল। তাহলে মইকে স্থির মনে করে ঘরকে গতিশীল বিবেচনা করলে ঘরটিই আরো ছোট হয়ে যাবে। ফলে মইয়ের ভাগ্য খারাপ, ঘরে আর জায়গা হবে না।
ব্যাস! হয়ে গেল প্যারাডক্স। তাহলে সমাধানটা কী?
আসলে এই ঘটনায় কোন প্যারাডক্স নেই। প্যারাডক্স মনে হবার কারণ হচ্ছে- আমাদের মস্তিষ্ক মনে করে সবার জন্যেই সময়ের প্রবাহ একই রকম। কিন্তু আসলে তা নয়। একে অপরের সাপেক্ষে চলমান দর্শকের জন্যে সময় প্রবাহিত হয় ভিন্ন গতিতে [বেগ যখন আলোর বেগের কাছাকাছি থাকে, তখন আবার কাল দীর্ঘায়নও ঘটে বলে]।
ফলে ঘরে থাকা কোন দর্শক মনে করবে মইয়ের উভয় প্রান্ত একই সাথে ঘরের ভেতরেই আছে। অন্য দিকে মইয়ের সাথে থাকা দর্শকের কাছে মইয়ের উভয় প্রান্ত ঘরের ভেতরে থাকার ঘটনা দুটি একই সাথে ঘটবে বলে মনে হবে না। ফলত, ঘরে মইয়ের স্থান হবে না।
ব্যাপারটিকে মনে হয় অন্ধ বন্ধুদের হাতি দেখার গল্পের সাথে তুলনা করা যায় যেখানে একেক বন্ধু হাতির একেক অঙ্গ ধরে আলাদা আলাদা বিবরণ দিয়েছিল।
শেষ কথা হলো, এটা প্যারাডক্স কিনা নির্ভর করে আমাদের বোঝার উপর। আমরা যদি ব্যাপারটি বুঝে ফেলি, তবে এতে কোন প্যারাডক্স নেই। আর না বুঝলে প্যারাডক্স আছে! আপেক্ষিক তত্ত্বে এই ঘটনাটি মই প্যারাডক্স (Ladder Paradox) নামে পরিচিত।
No Comment