| পারভেজ মাহির চৌধুরী |

[ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি আগ্রহটা আমার একটু বেশিই। বিভিন্ন সময় গণিতকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে দেখে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা মাথায় এসেছে যা একেবারেই খামখেয়ালিপনা। তবে এরকম খামখেয়ালিপনা থেকেই মাঝে মাঝে বের হয়ে এসেছে সুন্দর ও মজার কিছু বিষয়, যা থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি গণিতের সৌন্দর্য। আমার লেখাগুলো আসলে এরকম কিছু অগোছালো চিন্তাকেই কাগজের পাতায় তুলে ধরার সামান্য প্রয়াস।]

৩০০০০ এর আগের সংখ্যাটি কত? উত্তর লিখলাম-

৩০০০

-১

—————

 ২৯৯৯

৩য় শ্রেণীর ১ম সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নের এমনই উত্তর করেছিলাম ১৯৯৯ সালে। চোখে ৩০০০০ এর ১টি শূন্য কম ধরা পড়েছিল; কারণ বইয়ে অঙ্কটি ৩০০০ দিয়ে করা ছিল। ২ ঘন্টার পরীক্ষা মাত্র ১৫ মিনিটে শেষ করে রিভিশনের ধার না ধেরে খাতা জমা দিয়ে সোজা বাসার উদ্দেশে রওনা। তৃতীয় শ্রেণীর ১ম সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নের এমনই উত্তর করেছিলাম ১৯৯৯ সালে। সাথে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু রাকিবও ছিল। দু’জনে হাঁটছি আর প্রশ্নের উত্তর মিলাচ্ছি। সে ৩০০০০-এর আর একটি শূন্য চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিল। এরপর বাসায় না ঢুকে সিঁড়ির নিচে লুকালাম। কিন্তু কতক্ষু? মা’র চোখে ধরা পড়ে গেলাম। অংকে ভুল করার জন্য খেলাম আরও একদফা পিটুনি। প্রতিবারই পাটিগণিত পরীক্ষায় কিছু না কিছু ভুল আর সেই সাথে সব সময়ের জন্য কিছু পিটুনি নির্ধারিত ছিলই। তখন মনে মনে ভাবতাম, ‘পাটিগণিত’ নামটি সার্থক হয়েছে; তবে আরও ভাল হতো যদি নামটি রাখা হতো “পেটানো গণিত”!!!

‘পাটিগণিত’ এর ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে ‘Arithmetic’ যা গ্রিক arithmos শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে ‘সংখ্যা’। এটি গণিতের একেবারে প্রথম ও সবচেয়ে মৌলিক শাখা। সৃষ্টির শুরু থেকেই গণনার প্রবৃত্তি মানুষের সহজাত। গণনার বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া বিভিন্ন চড়াই উতরাই পেরিয়ে বর্তমানে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। গণনার আদর্শ দশমিক পদ্ধতি ও এর আনুষঙ্গিক কিছু নিয়ম-কানুন (যেমন, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি) মিলিয়ে গণিতের যে শাখা, তাই পাটিগণিত নামে অভিহিত।

শিশুদেরকে গণনা শিখানোর পরই যে জিনিসটি শিখানো হয় তা হলো যোগ (addition)। রাহাতকে সেদিন যোগ শিখাচ্ছিলাম। ওকে বললাম, তোমার কাছে ৫টি আম আছে। আরও ৩টি আম তোমাকে দেওয়া হল। তাহলে, তোমার কাছে কয়টি আম হলো? সে হাতের আঙুলগুলো নিয়ে ৫ এর পর থেকে গণনা শুরু করল। একটি আঙুলকে সে এক এক করে গুনছিল। এভাবে ৫ এর পর থেকে ৩টি আঙুল গুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে সে উত্তর দিল ‘৮’। বললাম, আরও ২টি আম দিলাম। এবার সে ২টি আঙ্গুল গুনে বলল, ‘১০’। এরপর তাকে উল্টো করে প্রশ্ন করলাম, তোমার কাছে ২টি আম আছে, আরও ৮টি আম দিলাম। এবার কত হলো? সে এবার ২ এর পর থেকে হাতের আঙুল গুনা শুরু করল। কিন্তু বেচারা!! তার ডান হাতের ৫টি আঙুল শেষ হয়ে গেল, কিন্তু গুনা শেষ হলো না!!! বাম হাতের আঙুলগুলো গুনতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে আগেরটা ভুলে গেছে!!!

গল্পটা বেশি ছেলেমানুষি মনে হতে পারে। কিন্তু এটা একেবারে বাস্তব। প্রথম যে মানুষটি যোগ করতে গিয়েছিল, সে এই একই সমস্যায় পড়েছিল। পরবর্তীতে মানুষ আঙুলের সাহায্যে গুনার পরিবর্তে আঙুলের ‘কর’ এর সাহায্যে গণনার প্রচলন করে। কিন্তু এতেও ২০ এর বেশি গণনা করা সম্ভব হয় না। আর যদি দুই হাতই ব্যবহৃত হয়, তাহলেও সর্বোচ্চ ৪০ পর্যন্ত গণনা করা যায়। এই সমস্যার সমাধান মানুষ খুঁজে পেল স্থানীয়মান সংখ্যা পদ্ধতিতে (place-value/positional number system)।

ব্যাপনের প্রথম সংখ্যায় এই সংখ্যা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে একক, দশক, শতক, হাজারকে যথাক্রমে ধান, গম, ভুট্টা ও আলুর সাথে তুলনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ,

১০টি ধান = ১টি গম

১০টি গম = ১টি ভুট্টা

————————–

১০টি ভুট্টা = ১টি আলু

৩৮৬২ এর সাথে ১২৩ যোগ করতে হলে আমরা এই স্থানীয় মান পদ্ধতির সাহায্য নিই। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, আঙুলে ‘কর’ এর সাহায্যে এটা গুনতে গেলে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। স্থানীয় মান পদ্ধতিতে আমরা ‘৩৮৬২’ কে ৩টি আলু ৮টি ভুট্টা ৬টি গম ২টি ধান হিসেবে চিন্তা করি। ঠিক একইভাবে ‘১২৩’ অর্থ হলো ১টি ভুট্টা ২টি আলু ৩টি ধান। তাহলে, আলু, ভুট্টা, ধান, গম মোট কয়টি আছে হিসেব করলেই যোগ হয়ে যায়।

1

তাহলে, মোট ৩টি আলু ৯টি ভুট্টা ৮টি গম ৫টি ধান পাওয়া গেল। অর্থাৎ ৩৮৬২+১২৩ = ৩৯৮৫। ছোটবেলায় যখন প্রথম এভাবে যোগ করতে শিখলাম, খুব খুশি হয়ে প্রতিটি সংখ্যার সাথে তার পরের সংখ্যা যোগ করে দেখতে লাগলাম। ১০+১১=২১, ১১+১২=২৩, ১২+১৩=২৫, …… ভালই চলছিল। বিপত্তি ঘটল ১৫ আর ১৬ যোগ করতে গিয়ে।

2

এতক্ষু যোগফলগুলো ছিল ২১, ২৩, ২৫, …… এরকম, কিন্তু ১৫ আর ১৬ যোগ করতে গিয়ে হঠাৎ করে অনেক বড় একটা সংখ্যা ‘২১১’ পেলাম। মনের মধ্যে খটকা লাগল। মামণির কাছে ছুটে গেলাম। তিনি হাতে রাখার ব্যাপারটি বুঝালেন। তখন যোগ করে দেখলাম যোগফল ‘৩১’। এবার আগের সংখ্যাগুলোর কাছাকাছি যোগফলই এসেছে। সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষু পর মনে হলো, হাতে কেন রাখতে হয়? আর যাদের হাতই নাই তারা হাতে রাখবেই বা কী করে???

আসলে বিষয়টি হলো, যখনই ধান ৯টির বেশি হয়ে যাবে, তখন তো আর তাকে ধানের ঘরে রাখা যাবে না; কারণ সেখানে ৯টির বেশি রাখার জায়গা নেই। তখন আমরা ১০টি ধানকে একটি প্যাকেটে মুড়িয়ে তাকে ১টি গম হিসেবে চিন্তা করি এবং তাকে গমের ঘরে পাঠিয়ে দিই। সুতরাং ৫ + ৬ = ১১ হয়ে যাওয়ায় এখান থেকে ১০টি ধানকে প্যাকেটে মুড়িয়ে তাকে ১টি গম হিসেবে চিন্তা করে তাকে গমের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, অর্থাৎ হাতে রাখা হয়। আর বাকি ১টি ধানকে ধানের ঘরেই রাখা হয়। ফলে, গমের ঘরে ১ + ১ = ২টি গমের সাথে আরও ১টি ধানরূপী গম (হাতে থাকা গম) যুক্ত হয়ে মোট গম হয় ৩টি। সুতরাং ১৫ আর ১৬ যোগ করলে দাঁড়ায় ৩১।

3

তাহলে, বিয়োগ করার ক্ষেত্রে হাতে রাখার ব্যাপারটি কী রকম? কেনই বা এরকম হলো? তোমরা চিন্তা কর। আসলে গণিতের এরকম অনেক শৈল্পিক সৌন্দর্য আছে। এ সৌন্দর্যগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলে গণিত হয়ে উঠতে পারে নতুন এক ধরনের সাহিত্য।

(…… চলবে)