ওরা তিন বন্ধু, খুবই আন্তরিক আর গভীর সম্পর্ক তাদের। পড়াশুনা, ঘোরাঘুরি, চিন্তা-ভাবনা আর গবেষণা সকল কাজেই  তারা যেন একক সত্তা, একক প্রাণ। এই প্রানের সম্মিলিত প্রয়াস- মানব কল্যাণে নতুন নতুন আবিষ্কার, আর চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে অদম্য মেধার প্রস্ফুটন। অল্প বয়সেই নরম হাতের ছোঁয়ায় তৈরি করেছে ড্রোন, রোবট (ম্যানুয়েলি কন্ট্রলেবল অটোমেশন) সহ আরও কিছু। এ বছর ইসেব(ESAB), বিসিএসআইআর(BCSIR) সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় রেখেছে কৃতিত্বের স্বাক্ষর।

11245431_403782513163518_905844800_n

হ্যাঁ, বন্ধুরা কথাগুলো আবু আলিফ সজল, মাহমুদুল হাসান শুভ আর মোঃ ইমরান কবির  এ তিন ক্ষুদে বিজ্ঞানী সম্পর্কেই বলছি। এই তিনজন তরুন মেধাবী দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নটরডেম কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবারের ২০১৫ সেশনের এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। একাডেমিক শত ব্যস্ততার মাঝেও কিন্তু তাদের এ পথচলা থেমে নেই। দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তাদের চিন্তা সার্বক্ষণিকের। তাই তো তোমাদের অনুপ্রাণিত করতে এবারের সংখ্যায় তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে ব্যাপন প্রতিনিধি মোঃ তৌহিদুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলঃ

ব্যাপনঃ  কেমন আছ তোমরা?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছি।

ব্যাপনঃ  পরীক্ষা নিয়ে নিশ্চয়ই খুবই ব্যস্ত ও চিন্তিত? আজকের পরীক্ষা কেমন হল?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  হ্যাঁ, এখন অবশ্যই পরীক্ষা নিয়ে বেশি ব্যস্ত আছি। আজকের পরীক্ষাটা ভাল হয়েছে। আশা করি, পূর্বের মত এবারও ভাল ফলাফল লাভ করতে পারব, ইনশাল্লাহ।

ব্যাপনঃ  তোমাদের তিন বন্ধুর পরিচয় কখন থেকে? আর বন্ধুত্বের গভীরতা কেমন?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের পরিচয়। আমাদের পরস্পরের প্রায় একই রকম চিন্তা-ভাবনা আর বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রোজেক্ট নিয়ে আগ্রহের কারণে একসাথে পড়াশোনা, ঘুরাঘুরি ও কাজ করা হয়। আর তাতেই আমাদের বন্ধুত্ব এখন অনেক গভীর।

ব্যাপনঃ  বিজ্ঞানের প্রতি তোমাদের এমন ঝোঁক প্রবণতা ও আগ্রহ জন্মালো কি করে?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  বলতে পারেন, ছোটবেলায় এনালগ ইলেক্ট্রনিক্সের প্রতি ঝোঁক থেকে এ আগ্রহ তৈরি হয়। আর পরবর্তীতে গত বছর জানুয়ারিতে কলেজের একটি প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান অধিকার করে এ ব্যাপারে অনেক বেশি অনুপ্রেরণা পাই।

ব্যাপনঃ  ফেব্রুয়ারিতে বিসিএসআইআর আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় অসাধারণ প্রোজেক্ট নিয়ে গিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছো। এ বিজ্ঞানমেলায় তোমাদের অংশগ্রহণের চিন্তার শুরুটা জানতে চাই।

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  আমরা তিন বন্ধু মিলে প্রোজেক্টটা আগ থেকেই প্রস্তুত করছিলাম। বিসিএসআইআর এর মেলার সংবাদ পেয়ে আমাদের তৈরি এ যন্ত্রটি সবার সামনে উন্মোচন করা এবং সবাইকে এগুলো সম্পর্কে আগ্রহী করতে একটা তাগিদ অনুভব করি। আর এ চিন্তা থেকেই মেলায় অংশগ্রহণ করি। পুরষ্কারের চিন্তা আমাদের মাথায় ছিলই না।

ব্যাপনঃ  তোমাদের প্রোজেক্ট কি নিয়ে ছিল? মেলায় তো দর্শনার্থীদের সামনে প্রোজেক্টের বর্ননা করেছো। এখানে সংক্ষেপে তোমাদের অসাধারণ এ প্রোজেক্টের বর্ননা পাঠকবন্ধুদের জন্য শেয়ার করার অনুরোধ করছি।

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  এটা ছিল রোবট জাতীয় একটি যন্ত্র। এতে একটি সেন্সর আছে। আর প্রোগ্রামটি এমনভাবে করা যেন, সামনের যে কোন বাধা ডিটেক্ট করে তা পরিহার নিজে নিজে চলতে পারে। এটি তিন চাকা বিশিষ্ট এবং সর্বোচ্চ ১০ সেমি দূরত্বের বাধা বুঝতে পারে। এটিকে ম্যানুয়েলি কন্ট্রোল করাও সম্ভব। তাই এর নাম দিয়েছি- Manually Controllable Automation.

ব্যাপনঃ  তোমাদের এই প্রোজেক্টকে আরও অগ্রসর করে নেওয়ার ইচ্ছে আছে কি? থাকলে সেটা কিভাবে করবে বলে ভাবছো?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  হ্যাঁ, সেটাতো অবশ্যই আছে। কিছু পরিবর্তন ও সংযোজন করার পরিকল্পনা আছে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট আমাদের সাহায্য করবে আর আপনাদের মত ভাইয়ারা তো আমাদের বড় সহযোগী (হাসি)।

ব্যাপনঃ  বিজ্ঞান নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে তোমাদের পরিবারের সদস্যদের অনুভূতি কেমন?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  এ ধরনের বিভিন্ন প্রোজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেয়ে বরং সবসময় শুধুমাত্র একাডেমিক পড়াশোনার জন্য তাগিদ দিলেও আমাদের এমন কৃতিত্বে কিন্তু উনারা খুবই খুশি হয়েছিলেন। আসলে এটা পুরোপুরি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। তবে মজার বিষয় যে, পুরষ্কারের ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট দেখাতে পারলেও প্রাইজমানি অভিভাবকদের দেখাতে পারি নি। কারণ প্রাইজমানি পেয়েই তার পুরো অংশ দিয়ে আমাদের পরবর্তী প্রোজেক্টের যন্ত্রপাতি কিনে ফেলি।

ব্যাপনঃ  নতুন কোন প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করছ কিনা?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  হ্যাঁ, করছি। একটি ড্রোন নিয়ে কাজ করছি। যা প্রায়ই কমপ্লিট এবং এর জন্য ইসেব (ESAB) তাদের একটি প্রোগ্রামে আমাদের ইনভাইট করেছে। অবশ্য, পরীক্ষার ব্যস্ততার জন্য এসব থেকে কিছুটা দূরে আছি। তারপরও সাবমেরিনসহ আরও কয়েকটা প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আছে। আর গরীব শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমাদের আলাদা একটা পরিকল্পনা আছে।

ব্যাপনঃ  এক্ষেত্রে সাধারণভাবে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে? এগুলো কাটিয়ে উঠতে তোমাদের প্রত্যাশা কি?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  এক্ষেত্রে বারবার একই সমস্যা সামনে চলে আসে। অর্থ সংকট হতে পারে একটা বড় ফেক্টর। কিন্তু সিনিয়র কারও অনুপ্রেরনা আর সময়মত দিক-নির্দেশনা পেলে অনেক ভাল হত। আর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির স্বল্পতাও একটা বড় সমস্যা।

এক্ষেত্রে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কোন বিজ্ঞান সংস্থা আমাদের মত অনেকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কারিগরি পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে।

ব্যাপনঃ  বাংলাদেশে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা নিয়ে তোমাদের ভাবনা কি? তরুণদের জন্য তোমাদের পরামর্শ কি?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় শিক্ষাব্যবস্থার আরও উন্নতি সাধন করতে হবে। সকল বিষয়ের বাস্তবিক ও ব্যবহারিক দিকটি জানার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমানে প্রশ্ন ফাঁস শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তাই আশা করি, তরুণরা অন্তত এ ধরনের ফাঁদে পা দিবে না। আর ইন্টারনেটের এ যুগে দেশকে এগিয়ে নিতে বিজ্ঞান শিক্ষায় তরুণরা নিজেরাই উদ্যোগী হবে।

ব্যাপনঃ  অনেক ক্ষেত্রেই দিন দিন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে কোন কোন পর্যায় থেকে কি কি করনীয় থাকতে পারে বলে মনে কর?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  বিজ্ঞান কখনও এ ধরনের অবক্ষয়কে সমর্থন করে না। সময়ের সদ্ব্যবহারের অভাব আর অবসর সময়ে অতিরিক্ত ফেসবুক, মুভি, গেমস ইত্যাদির কারণে এ ধরনের সমস্যাগুলো হচ্ছে। তাই অবসর সময়গুলো বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় ব্যয় করতে পারলে এ ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা না। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সচেতনতাই মুখ্য। আর ধর্মীয় অনুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যাপনঃ  এইচএসসির পর তোমরা কে কোথায় পড়তে চাও?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  অবশ্যই, আমাদের সবারই টার্গেট ইঞ্জিনিয়ারিংএ পড়া। এক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক্স বিশেষ করে রোবটিক্স আমাদের আগ্রহের বিষয়।

ব্যাপনঃ  “ব্যাপন”  সম্পর্কে কি বলবে?

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  অনেক অনেক ভাল লেগেছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সংযোজিত আছে এখানে যা তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক বেশি উপকারী ও শিক্ষণীয় হবে। আর বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা-গবেষণার জন্য আগ্রহ তৈরি করার মত একটি ম্যাগাজিন এই “ব্যাপন”।

ব্যাপনঃ  বিজ্ঞানের কাজকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপনের প্রতি তোমাদের পরামর্শ-

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  খুব অল্প সময়ে “ব্যাপন” এর বিভিন্ন আয়োজন অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। আর এজন্যই সারাদেশে সকল শিক্ষার্থীদের কাছে “ব্যাপন”কে আরও বেশি ছড়িয়ে দিতে হবে। সহজলভ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর বিজ্ঞানচর্চায় উৎসুক শিক্ষার্থীদের পাশে ব্যাপন পরিবার থাকলে সেটা অনুপ্রেরণাদায়ক হবে নিশ্চয়ই (হাসি)।

ব্যাপনঃ  পরীক্ষার মাঝেও আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।

ক্ষুদে বিজ্ঞানীঃ  আপনাকেও ধন্যবাদ।