| মোঃ মোখলেছুর রহমান |

বন্ধুরা, তোমাদের একটি সত্য গল্প বলি। উনিশ শত ছিয়ানব্বই সালের শেষের দিকে জাপানের সুকুবাতে সুমিও ইজিমা নামের একজন গবেষক এনইসি ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন। তিনি কার্বন এর যৌগ গ্রাফাইট বা পেন্সিলের কালি (তোমরা যা ব্যবহার করেছ বা করো) নিয়ে বিভিন্ন বিক্রিয়া করতেন। একদিন তিনি ল্যাবরেটরিতে পাশাপাশি দুটি গ্রাফাইট রড নিস্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়ামের মধ্যে রেখে তড়িৎ ক্ষরণ ঘটান। যার ফলে রডগুলো উত্তপ্ত হয়ে বাষ্পীভূত হতে থাকে। এক সময় গ্যাস চেম্বারের গায়ে অধঃক্ষেপ পড়তে শুরু করে। তিনি নিজেও জানতেন না আসলে কী উৎপন্ন হতে যাচ্ছে? তিনি ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে দেখলেন অধঃক্ষেপটি আর কিছু নয়। কিছু পাতলা ও লম্বাটে গঠনের সমন্বয়। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লম্বা গঠনগুলো একটির ভিতরে অন্যটি সেঁটে থাকে। দেখতে অনেকটা পুতুলের মত। এটি বিজ্ঞানী মহলকে কার্বন এর নতুন রূপ হিসেবে জানান দেয়। আর ইজিমার এ তন্তুগুলোর নাম দেয়া হল ন্যানোটিউব।

কার্বন নিয়ে আর দু-একটা কথা বললে তোমরা হয়ত এর পার্থক্য আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবে। ডায়মন্ড বা হীরকের নাম কেইবা শুনেনি আর পেন্সিল ছাড়া তো পড়ালেখার কথা ভাবাই যায় না। তোমরা আশ্চর্য হবে এ জন্য যে, ডায়মন্ড বা হীরক এবং পেন্সিল কালির যৌগ উভয়েই কার্বন অণুর সমন্বয়ে গঠিত।কিন্তু ধর্ম, গুণাবলি, দাম একদমই আলাদা। হীরক পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম বস্তু। অন্যদিকে গ্রাফাইট পৃথিবীর সবচেয়ে নরম বস্তুগুলোর একটি। অথচ গ্রাফাইটের অভ্যন্তরে বিদ্যমান বন্ধনগুলো হীরকের বন্ধনের চেয়ে অনেক বেশী শক্ত। স্বচ্ছতার দিক থেকে হীরকের জুড়ী মেলা ভার অথচ গ্রাফাইটের বর্ণ ধূসর এবং সাধারণজনের কাছে হীরকের যে মুল্য রয়েছে, গ্রাফাইট মূল্য ঠিক বিপরীত। গ্রাফাইট যেমন- ভাল পরিবাহক হীরক কিন্তু তার উল্টো। হীরক গ্রাফাইটের চেয়ে অনেক বেশী ঘন এবং উচ্চচাপে গ্রাফাইটকে হীরকে পরিণত করা যায়।
আমরা এতক্ষণ যে, গ্রাফাইট নিয়ে আলোচনা করলাম সেই গ্রাফাইট রড থেকেই ন্যানো পরিবারের জন্ম। ন্যানো পরিবারের মধ্যে ন্যানো টিউব ছাড়াও আছে ফুলেরিন, ন্যানো-অনিয়ন। এখন ন্যানোটিউব সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

ইজিমার আবিষ্কারের পরপরেই শুরু হয় এ নিয়ে আরো গবেষণা এবং কেমন করে একে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন গবেষকরা। কিছু গবেষক বললেন, টিউবের ভিতরের অংশকে টেস্টটিউব হিসেবে ব্যবহার করে রসায়নের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় একে কাজে লাগানো যায়। আর একদল বললেন একে অতি সুক্ষ্ম ধাতব তার হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। এর স্থিতি স্থাপকতা সবচেয়ে বেশী, প্রসারণ ঘটানোর শক্তি ও তাপীয় স্থিতিও বেশী। অবশ্য এসব কারণে আণুবীক্ষণিক রোবট, আঘাতে সইতে পারে এমন মোটর গাড়ির বডি এবং ভূমিকম্প। ভবন তৈরীতে ন্যানোটিউবের বেশি কাজে লাগবে বলে শুরুর দিকে ধারণা করা হচ্ছিল। শুরুতে ন্যানোটিউবের প্রয়োগ হয়েছে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে ন্যানোটিউবের ব্যবহারে আরো বেশি কাজে লাগবে। এখন এসো এর দৃঢ়তা পরিমাপ করি।
মানুষের মাথার চুলের চেয়ে হাজার গুণ ক্ষুদ্র ব্যাসের ন্যানোটিউবের শক্তি কেমন করে পরীক্ষা করা সম্ভব। সত্যিই কঠিন ব্যাপার বৈকি! ন্যানোটিউব দিয়ে ইলেক্ট্রিক সার্কিট তৈরীর ভাবনা যতটা সুন্দর শোনায়, আদতে তৈরী করা কিন্তু ততটা সহজ নয়। ন্যানোটিউবের তারকে ব্যাটারীর সাথে যুক্ত করে এর রোধক ক্ষমতা নির্ণয় করা অসম্ভব।ন্যানোটিউবের দৃঢ়তা নির্ণয় করে টমাস এবসন ও তার সহযোগীরা দারুণভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এবসন আশান্বিত করে বলেছেন যে, ন্যানোটিউব এ যাবত কালের উদ্ভাবিত পৃথিবীর সকল পদার্থ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী দৃঢ় ও শক্ত। এবসন তাপীয় কম্পাঙ্ক ও তাপমাত্রার পরিবর্তন এ ন্যানোটিউবের বিস্তৃতি দিয়ে দৃঢ়তা পরিমাপ করেছিলেন ইয়ং মডুলাস স্কেল দিয়ে এবং সফলভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন। দেখা গেল, ইস্পাতের ইয়ং এর মডুলাস ২০০ গিগা প্যাস্কেল। সবচেয়ে শক্ত পদার্থ হীরকের ইয়ং এর মডুলাস যেখানে ১০০০ গিগা প্যাস্কেল সেখানে ন্যানোটিউবের ইয়ং এর মডুলাস প্রায় ১২০০ গিগা প্যাস্কেল। সুতরাং ইয়ং এর মডুলাস থেকে নিশ্চয়ই বুঝাতে পারছো ন্যানোটিউব-ই হল পৃথিবীর শক্ত ও দৃঢ় বস্তু। দৃঢ়তা ও কাঠিন্য এ দুটো গুন একসংগে বিদ্যমান বলে এবসন বিশ্বাস করেন, ন্যানোটিউব কে অতিমাত্রিক কঠিন পদার্থেও পরিণত করা সম্ভব যা সিরামিক হতেও অধিকতর শক্ত হবে।
বজ্ঞানীরা ন্যানোটিউব নিয়ে ক্রমশই অধিকতর উৎসাহী হয়ে উঠছেন। উৎসাহের কারন হল ন্যানোটিউবের অভ্যন্তর ভাগ ফাঁকা। বিজ্ঞানীদের মতে ফাঁকা অংশে যদি অন্য কোনো পদার্থ সেঁটে দেয়া যায় তাহলে হয়ত ন্যানোটিউবের গুণগত ধর্ম পরিবর্তন আসবে। এ বিষয় হয়ত উম্মোচন করবে নতুন কোন বিজ্ঞানের দ্বার।
সবচেয়ে ক্ষুদ্র ন্যানোটিউবের ব্যাস হল দশমিক সাত ন্যানোমিটার। এরকম সংক্ষিপ্ত পরিসরে রেখে দেয়া অন্য কোনো পদার্থ তখন অদ্ভুত আচরণ শুরু করবে। পদার্থ যদি তরল হয় সেক্ষেত্রে হয়ত গলনাংক যাবে বদলে, কঠিন হলে হয়ত অর্জন করবে নতুন কোন ক্রিস্টালাইন গঠন। ন্যানোটিউবের গঠন, ব্যবহার প্রকৃতি নিয়ে এরকম হাজারো সম্ভাবনাময় স্বপ্ন ছড়িয়ে আছে গবেষকদের মাঝে। দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্রতম বস্তুগুলো নিয়েই মানুষের ভাবনা বিশাল পরিম-ল লাভ করেছে। তাই ন্যানোটিউব নিয়েও চিন্তাভাবনার কমতি নেই মানুষের। ন্যানোস্কোপিক যন্ত্র, ন্যানো কম্পিউটার উদ্ভাবনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।