।মাবরুর আহমাদ নাকীব।

প্রিয় বন্ধুরা, মহাকাশ নিয়ে আমাদের আকর্ষণের কোন কমতি নেই সেই প্রাচীনকাল থেকেই। কখনো খালি চোখে, কখনো দূরবীন, কখনো বা টেলিস্কোপ দিয়ে নানান তথ্য উদ্‌ঘাটনে মহাকাশকে তন্নতন্ন খুঁজে ফিরেছে নামজাদা বিজ্ঞানীসহ অনেক সাধারণ মানুষও। এখন এতো এতো গবেষণার তথ্য উপাত্তের ভীড়ে আমাদের মনে হুট করে প্রশ্ন জাগতে পারে, পৃথিবী তো ৭১ শতাংশ পানিতে নিমজ্জিত, তাহলে কি মহাকাশে কোন পানি নেই? থাকলেই বা তা কতটুকু? কোথায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি পানি? এই প্রশ্নগুলো গুছিয়ে দিতে এসো আজ দেখে নেয়া যাক- মহাকাশে পানির পরিমাণ কতটুকু এবং কোথায় বা সবচেয়ে বেশি পানি রয়েছে?

আমরা সকলেই জানি যে, প্রাচুর্যতায় ভরপুর আমাদের এই পৃথিবী ছাড়া বিশ্বজগতের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব এখন অবধি প্রমাণিত হয়নি। কোথায় প্রাণের বিকাশের পূর্বশর্ত হিসেবে সেখানে পানির উপস্থিতি থাকা বাঞ্ছনীয়। যার স্বয়ংসম্পূর্ণতা আমাদের এই পৃথিবীতে রয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো,পৃথিবীর চেয়েও বহুগুণ পানি রয়েছে আমাদের সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ এবং উপগ্রহে! এখন তোমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নের উদয় হতে পারে, পানি যেহেতু আছে, প্রাণ থাকবে কেন? কিম্ভুতকিমাকার চেহারার সায়েন্স ফিকশনের সবুজ ঘড়িওয়ালা এলিয়েন থাকবে না কেন? তোমাদের বুঝতে হবে, পানি মানেই কিন্তু যে স্বচ্ছ শীতল নির্মল পানি হতে হবে এমন নয়। কল কারখানার চালিকাশক্তি হিসেবে যে পেট্রোল ডিজেল ব্যবহার করা হয়, তাও কিন্তু একপ্রকার পানি। কিন্তু তুমি কি তাকে স্বাভাবিক পানি বলবে? নিশ্চয় না। তেমনি অন্যান্য গ্রহের নানান প্রকার গ্যাস, গলিত পদার্থ, চাক চাক বরফকে আমরা সাধারণভাবে পানি বললেও- তা আসলে বহু যৌগ পদার্থের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হওয়া রাসায়নিক তরল। যেমন, বিজ্ঞানীদের ধারণা ইউরেনাসের হাইড্রোজেন-মিথেন এর পিছনে রয়েছে উত্তপ্ত এক সমুদ্র। এই সমুদ্রে পানির সাথে দ্রবীভূত আছে অ্যামোনিয়া।

মূল কথায় আসা যাক, এখন প্রথমত প্রশ্ন আসতে পারে- সৌরজগতের কোথায় সবচেয়ে বেশি পানি রয়েছে এবং তার পরিমাণ কতটুকু? মহাকাশ সংস্থা নাসার দেয়া পরিসংখ্যান দেখে নেয়ে যাক। তোমরা নড়চড়ে বসো কিন্তু। কারণ বিজ্ঞানের তথ্যগুলো সাদা দৃষ্টিতে নয়, অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয় ধীরেসুস্থে। নইলে চোখের পড়া পড়ে যাবে, কিন্তু মাথা থাকবে শূন্য। আচ্ছা, তোমার অন্তরের চোখ কয়টা? দাঁড়াও, দাঁড়াও। গোণার আগে তথ্যগুলো অন্তরের দৃষ্টি বুলানো যাক।

পৃথিবীতে তরল পানির পরিমাণ হলো- ১.৩৩৫ জেটালিটার (ZL)। এক জেটালিটার মানে, একশ কোটি ঘন কিলোলিটার! সংখ্যায় লিখলে যা হবে, ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ ঘন কিলোলিটার! কি, মাথায় চক্কর কাটছে? দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়ো তাড়াতাড়ি।

আমাদের প্রিয়তম পৃথিবীর ভর হলো ১,০৮.২১ জেটালিটার (তুলনার সুবিধার্থে ভরকে লিটারে প্রকাশ করা হয়েছে)। অর্থাৎ ভরের তুলনার পৃথিবীতে পানির পরিমাণ হলো মাত্র ০.১২ শতাংশ! যা পৃথিবীর উপরিভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সমুদ্রতলের সবচেয়ে গভীরতম খাদ ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা প্রায় ১১ কিলোমিটার। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠস্থ সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্টের চেয়েও ৩ কিলোমিটারের মতো বেশি গভীর! স্বাভাবিকভাবে মাটি খুঁড়তে থাকলে তিন কিলোমিটারের পরে আর পানি পাওয়া যাবে না। তারপর থেকে পৃথিবী আস্ত এক গমগমে আগুনের গোল্লা। যাকে ভিতরে রেখে আমাদের বসবাসের জন্যে পৃথিবীপৃষ্ঠ অনেকটা শীতলপাটির মতো বিছিয়ে আছে।

অন্যদিকে সৌরজগতের অন্যতম বস্তু ট্রিটন- তরল পানির আয়তন হলো, ০.০৩ জেটালিটার। আর তার ভর হলো ১০.৩৫ জেটালিটার। ট্রিটনের ভর অনুযায়ী তার মধ্যে পানি আছে ৬৫ শতাংশ! যেখানে পৃথিবীর ভর অনুযায়ী তাতে পানির পরিমাণ মাত্র ০.১২ শতাংশ।

সুতরাং সহজেই বুঝে নেয়া যায় যে, ভরের পাল্লায় ট্রিটনের পানির পরিমাণ বহুগুণ বেশি! এটাই শেষ নয়, উদাহরণ এখনো বাকি আছে যে। তোমরা বরং একগ্লাস পানি খেয়ে নাও। আর ভাবতে থাকো এই একগ্লাস পানি, ভূপৃষ্ঠের ০.১২ শতাংশ পানির কত শত জেটালিটার ক্ষুদ্র অংশ? জানি, পারবে না। কারণ তা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আর এখানেই আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয় তা জানেন। তাকে কোন সীমাবদ্ধতা স্পর্শ করতে পারে না।

তারপর, চমৎকার সুন্দর গ্যাসীয় বলয় থাকা বামন গ্রহ প্লুটোর ভর হলো ৭.০১ জেটালিটার। আর প্লুটোতে পানির পরিমাণ হলো ১.০ জেটালিটার। যা তার ভরের ৬২ শতাংশ। বৃহস্পতি গ্রহের অন্যতম উপগ্রহ ইউরোপার ভর- ১৬.০৬ জেটালিটার। আর তার অভ্যন্তরস্থ পানির পরিমাণ, ২.৬ জেটালিটার। যা ভরের ১৮ শতাংশ। শনির উপগ্রহ এনসেলেডাসের ৬৮%-ই পানি দিয়ে পরিপূর্ণ।

১৬১০ সালে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও’র আবিষ্কার করা বৃহস্পতি গ্রহের ৬৭টি উপগ্রহের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং সৌরজগত পরিবারের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ ক্যালিস্টো’র ভর হলো, ৫৮.৬৩ জেটালিটার। যার অভ্যন্তরে তরল পানির পরিমাণ, ৫.৩ জেটালিটার। অর্থাৎ ভরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি।

২৫শে মার্চ ১৬৫৫ সালে ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস- এর আবিষ্কার করা শনি গ্রহের বৃহত্তম এবং ঘন বায়ুমণ্ডল বিশিষ্ট একমাত্র উপগ্রহ টাইটানের ভর, ৭১.৬০ জেটালিটার। আর তার মধ্যে তরল পানির অস্ত্বিত্ব রয়েছে- ১৮.৬ জেটালিটার। টাইটানের মোট ভরের ৪৪ শতাংশ।

বৃহস্পতির সর্ববৃহৎ উপগ্রহ গ্যানিমিড হলো সৌরজগতের বৃহত্তম উপগ্রহ। আকারে যা বুধগ্রহের চেয়েও বড়। গ্যানিমেইড ৬ লাখ ২১ হাজার মাইল দূর দিয়ে বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করে। গ্যানিমিডের ভর হলো, ৭৬.২৯ জেটালিটার। আর তরল পানির আয়তন, ৩৫.৪ জেটালিটার। যার প্রেক্ষিতে ভরের তুলনায় পানি হলো, ৬৯ শতাংশ।

কি বন্ধুরা, ঝিমিয়ে পড়লে নাকি? মনের চোখ খোলা আছে তো? আরে, তোমরা না ইয়াংম্যান! টগবগে রক্তের অধিকারী, ভবিষ্যতের কাণ্ডারি। তোমরাই যদি ঝিমিয়ে পড়ো, তবে চলবে কি করে?

তা এখন মাথা খাটিয়ে বলো দেখি, সৌরজগতের কোথায় সবচেয়ে বেশি পানি আছে?

তোমরা যারা পেরেছো আর যারা পারোনি উভয়পক্ষকেই উদ্দেশ্য করে আমিই বলে দিচ্ছি- সৌরজগতের সবচেয়ে বেশি পানি রয়েছে বৃহত্তম উপগ্রহ গ্যানিমিডে। যার ভিতরে তরল পানির উপস্থিতি রয়েছে ৩৫.৪ জেটালিটার। যা তার ভরের ৬৯ শতাংশ। তোমরা কি খেয়াল করেছো? পানির উপস্থিতিতে শীর্ষের দিকে থাকা ইউরোপা, ক্যালিস্টো, গ্যানিমিডের অবস্থান পৃথিবীর তুলনায় দশগুণ বিশাল সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতিতে। এখন তাহলে কি আমরা বলতে পারি না, গ্রহের অন্তর্ভূক্ত পরিবার হিসেবে বৃহস্পতি গ্রহে সবচেয়ে বেশি পানি রয়েছে। বোধহয় পারি!

প্রিয় বন্ধুরা, দেখলে তো- পৃথিবীর তুলনায় ভরের সাপেক্ষে কত কত বেশিগুণ পানি সৌরজগতের অন্যান্য সদস্যরা ধারণ করে আছে। অথচ সেখানে আজো পর্যন্ত প্রাণের কোন অস্তিত্বের সন্ধান পায়নি বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা। সেখানে বসবাস করার মতো উপযুক্ত উপকরণই নেই!

সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের এই পৃথিবীকে কতই না মনোরম বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করে আমাদেরকে সুন্দরভাবে বসবাসের জন্যে সাজিয়ে দিয়েছেন! নিশ্চয় তিনি তা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি। এজন্যই বোধহয় কুরআনের অনেক জায়গায় বলা হয়েছে, “আর এতে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন।” বন্ধুরা, তোমরা কি চাও না সেসব চিন্তাশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতে?

 

জুলাই-আগস্ট ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ২