মুশফিকুর রহমান।

 

ভেজাল। শব্দটা শুনে বিরক্ত হলে নাকি? অবশ্য বিরক্ত হবারই কথা। আমাদের চারপাশে যে পরিমাণ ভেজাল তাতে বিরক্ত হবারই কথা। সত্যিকথা বলতে সব ভেজাল যে খারাপ তা কিন্তু নয়, কিছু ভেজাল প্রয়োজন এবং ভাল কাজে ব্যবহার হয়। মূল কথা, এটা কে কোথায় কীভাবে ব্যবহার করছে তাই লক্ষণীয়। যেমন ফরমালিন, এটা মানুষের প্রয়োজনে বিভিন্ন বস্তু সংরক্ষণের অথবা ঔষধ তৈরির জন্য ব্যবহার করা হত। আবার ইউরেনিয়ামের কথাই ধরো, এটা মানুষের শক্তির উৎসের যোগান দেওয়ার জন্যই সৃষ্টিকর্তা আমাদের উপহার দিয়েছিলেন, কিন্তু এটা আমরা নিজেদের ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করছি। কি অনেক উপদেশ দিয়ে ফেললাম? উপদেশ শুনতে শুনতে যে তোমরা বিরক্ত তা জানি, আর বয়সটা যদি হয় ফটিকের তাহলে তো সেরেছে!

যাক এবার মূল কথায় আসি, সেমিকন্ডাক্টর সম্পর্কে তোমরা তো জানো। সেমিকন্ডাক্টরকে নানা ভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। যেসকল পদার্থের শেষ কক্ষপথে চারটি ইলেকট্রন থাকে তাকে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী বলা হয়। আবার যেসকল পদার্থের পরিবাহীতা পরিবাহী এবং অপরিবাহীর মাঝামাঝি তাকে সেমিকন্ডাক্টর বলে। সেমিকন্ডাক্টর একটি অসাধারণ গুণসম্পন্ন পদার্থ। কিছু অদ্ভুত গুণের কারণে সেমিকন্ডাক্টরকে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়। বর্তমান যুগ হল ইলেক্ট্রনিক্সের যুগ। আর আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্সের প্রধান ভিত্তি হল সেমিকন্ডাক্টর (Semconducor)।

এবার এসো সেমিকন্ডাক্টর আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক।

সেমিকন্ডাক্টর আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ১৮৩৩ সালে বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে (১৭৯১-১৮৬৭) অদ্ভুত গুণ সম্পন্ন কিছু মৌলিক পদার্থ লক্ষ্য করেন। সাধারণত পরিবাহীর তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুৎ পরিবাহী ক্ষমতা কমে। আর অপরিবাহীর তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুৎ পরিবাহী ক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু কিছু কিছু পরিবাহী পদার্থের তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুৎ পরিবাহী ক্ষমতা বাড়ে। যা পরিবাহীর সম্পূর্ণ বিপরীত এবং এর পরিবহন পদ্ধতিরও কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করেন তিনি। তিনি আসলে অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরের বৈশিষ্ট্যই দেখতে পেয়েছিলেন। এরপর ১৮৯৭ সালে জে.জে. থমসন (১৮৫৬-১৯৪০) ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। এর পর ইলেকট্রনের উপর ভিত্তি করে পদার্থের পরিবহন ক্ষমতা ব্যাখ্যা করা হয়। এর কিছুদিন আগে ১৮৮৫ সালে সেমিকন্ডাক্টরকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য এতে ভেজাল মেশানোর ধারণা দেন শেলফোর্ড বিডওয়েল (Shelford Bidwell) (১৮৪৮-১৯০৯)।

এর অনেক পরে উনিশ শতকের শুরুর দিকে জন বার্ডিন (১৯০৮-১৯৯১) ডোপিং এর কার্যকারী পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। অবশ্য সেমিকন্ডাক্টর দ্বারা বিভিন্ন কম্পোনেন্ট তৈরি হওয়া শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। বিজ্ঞানী সি.ই.ফ্রিটস (১৮৫০-১৯০৩) রেক্টিফায়ার তৈরি করেন ১৮৮৬ সালে। তখন এটির আবিষ্কারের বাস্তব কোন ব্যবহার পাওয়া না গেলেও ১৯৩০ সালে এর সাহায্যে এসি ভোল্টেজকে ডিসি ভোল্টেজে রুপান্তর করার ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ১৯০১ সালে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) রেডিও সিগন্যাল খোঁজার জন্য সেমিকন্ডাক্টর ডায়োড ব্যবহার করেন। ১৯০৭ সালে এইচ.যে. রাউন্ড(১৮৮১-১৯৬৬) এল.ই.ডি আবিষ্কার করেন। সেমিকন্ডাক্টর দ্বারা তৈরি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হল ট্রানজিস্টর। ১৯৪৭ সালে ১৬ই ডিসেম্বর জন বার্ডিন, ওয়ালটার ব্রাটাইন, উইলিয়াম শকলিই যৌথ ভাবে ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন করেন। এটাকে ইলেক্ট্রনিক্সের হৃদয় বলা হয় এবং এটি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ছিল।

প্রাকৃতিক ভাবে যেসব বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর যেমন সিলিকন বা জার্মেনিয়াম পাওয়া যায় তাকে ইনট্রিনসিক বা বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর বলা হয়। কিন্তু এই ইনট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টর সরাসরি ইলেকট্রনিক্স উপকরণের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। এক্ষেত্রে ইনট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টরের সাথে কিছু ভেজাল মিশ্রিত করতে হয়। শুরুতেই বলেছিলাম ভেজাল সবসময় খারাপ নয়। একটি বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরে পরিবাহীর মত নির্দিষ্ট তড়িৎ প্রবাহিত হয়। কিন্তু এর সাথে কিছু ভেজাল মিশ্রিত করা হলে এতে চাহিদা অনুযায়ী তড়িৎ প্রবাহ করানো সম্ভব।

ভেজাল হিসেবে ট্রাইভ্যালেন্ট অ্যাটম (যে সকল পরমাণুর যোজনী ৩), যেমন বোরন (৫), অ্যালুমিনিয়াম(১৩), গ্যালিয়াম(৩১), ইন্ডিয়াম(৪৯), থেলিয়াম(৮১) এবং প্যান্টাভ্যালেন্ট অ্যাটম (যে সকল পরমাণুর যোজনী ৫), যেমন আর্সেনিক(৩৩), এন্টিমনি(৫১), বিসমাথ(৮৩) ব্যবহার করা হয়। ইনট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টরের সাথে ভেজাল মিশ্রিত করার প্রক্রিয়াকে ডোপিং বলে।

এই ভেজাল মিশ্রণের কারণ একটু ভালভাবে জানা করা দরকার।

যেমনটি বলেছিলাম, আমরা জানি, সেমিকন্ডাক্টরের তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা পরিবাহীর চেয়ে কম আর অপরিবাহীর চেয়ে বেশি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টরের তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা পরিবর্তন করা যায় অর্থাৎ, সেমিকন্ডাক্টরের তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে পরিবাহীর সমতুল্য করা যায় আবার কমিয়ে ইন্সুলেটর বা অপরিবাহীর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করে এ কাজটি করা সম্ভব নয় তাই ডোপিং তথা ভেজাল মিশ্রিত করতে হয়।

মূলত মুক্ত ইলেকট্রনের চলাচলের মাধ্যমেই কোন পদার্থের মধ্য দিয়ে তড়িৎ পরিবাহিত হয়। অন্যদিকে হোল হচ্ছে ইলেকট্রনের অভাবজনিত কারণে সৃষ্ট শূণ্যতা বা গর্ত যা ইলেকট্রন প্রবাহের বিপরীত দিকে ধাবিত হয়ে তড়িৎ প্রবাহের দিক নির্দেশ করে। ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ আর হোলের চার্জ পজিটিভ। মূলত ডোপিং এর মাধ্যমে ভেজাল মিশ্রিত করে সেমিকন্ডাক্টরে মুক্ত চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় ফলে সেমিকন্ডাক্টরের তড়িৎ পরিবাহিতা বৃদ্ধি পায়। ডোপিং এর মাধ্যমে যদি সেমিকন্ডাক্টরে মুক্ত ইলেকট্রন বা নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় তাহলে সৃষ্ট সেমিকন্ডাক্টরকে n-type সেমিকন্ডাক্টর বলা হয় অন্যদিকে যদি সেমিকন্ডাক্টরে পজিটিভ চার্জ বা হোলের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় তাহলে সৃষ্ট সেমিকন্ডাক্টরকে p-type সেমিকন্ডাক্টর বলা হয়।

এবার চলো p-type সেমিকন্ডাক্টর এর গঠন দেখে নিইঃ

p-type সেমিকন্ডাক্টর গঠনের জন্য বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে সিলিকন অথবা জার্মেনিয়াম ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে ভেজাল হিসেবে ত্রিযোজী ইলেকট্রন বিশিষ্ট পদার্থ যেমন বোরন (৫), অ্যালুমিনিয়াম (১৩), গ্যালিয়াম (৩১), ইন্ডিয়াম (৪৯) এদের যে কোনটি নেয়া হয়।

উপরের ছবিতে একটি p-type সেমিকন্ডাক্টরের গঠন দেখানো হয়েছে। যেখানে বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে জার্মেনিয়াম এবং ভেজাল দ্রব্য হিসেবে গ্যালিয়াম ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা জেনেছি যে জার্মেনিয়ামের যোজনী ৪ অর্থাৎ, জার্মেনিয়াম পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষপথে ৪ টি ইলেকট্রন রয়েছে। অন্যদিকে গ্যালিয়াম পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষপথে ৩ টি ইলেকট্রন রয়েছে। ভেজাল মিশ্রণের ফলে গ্যালিয়াম পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষপথের ৩ টি ইলেকট্রন ৩ টি জার্মেনিয়াম পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষপথের সাথে বন্ধন গঠন করে। কিন্তু জার্মেনিয়াম পরমাণুর ১টি ইলেকট্রন বন্ধন গঠন করতে না পেরে ফাঁকা থেকে যায়।

এই ফাঁকা জায়গাই হল হোল। নেগেটিভ চার্জের ঘাটতির কারণে হোল সৃষ্টি হয় বলে হোল পজিটিভ চার্জ বিশিষ্ট হয়। p-type সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে এই হোল পরমাণু থেকে পরমাণুতে স্থানান্তরিত হয়ে বিদ্যুৎ পরিবহণে অংশগ্রহণ করে। একটি p-type সেমিকন্ডাক্টরে যতগুলি গ্যালিয়াম পরমাণু ভেজাল হিসেবে মিশ্রিত করা হয় ঠিক ততটি হোল তৈরি হয়। আর এভাবেই p-type সেমিকন্ডাক্টর গঠিত হয়।

n-type সেমিকন্ডাক্টরঃ

বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরের সাথে পঞ্চযোজী ইলেকট্রন বিশিষ্ট পদার্থ (যেমন As, Sb) কে ডোপিং এর সাহায্যে মিশ্রিত করলে যে মিশ্রিত পদার্থের সৃষ্টি হয় তাকে n-type সেমিকন্ডাক্টর বলা হয়। মিশ্রণের ফলে সেমিকন্ডাক্টরের গঠনে একটি পরিবর্তন ঘটে। ।

উপরের ছবিতে (চিত্র-৩) একটি n-type সেমিকন্ডাক্টরের গঠন দেখানো হয়েছে। যেখানে বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে জার্মেনিয়াম এবং ভেজাল দ্রব্য হিসেবে আর্সেনিক ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা জানি যে জার্মেনিয়ামের যোজনী ৪ অর্থাৎ জার্মেনিয়াম পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষপথে ৪ টি ইলেকট্রন রয়েছে। অন্যদিকে আর্সেনিক পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষপথে ৫ টি ইলেকট্রন রয়েছে।

n-type সেমিকন্ডাক্টর গঠনে জার্মেনিয়াম পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষপথের ৪ টি ইলেকট্রন আর্সেনিক পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষপথের ৪ টি ইলেকট্রনের সাথে বন্ধন গঠন করে। কিন্তু আর্সেনিকের ১ টি ইলেকট্রন মুক্ত অবস্থায় থেকে যায়। যে ইলেকট্রনটি পরমাণু থেকে পরমাণুতে স্থানান্তরিত হয়ে বিদ্যুৎ পরিবহনে অংশগ্রহণ করে।পঞ্চযোজী ইলেকট্রন বিশিষ্ট পদার্থ মিশ্রণের ফলে মিশ্রণে ইলেকট্রনের সৃষ্টি হয় এবং মিশ্রিত সেমিকন্ডাক্টরটি বিদ্যুৎ পরিবাহী হয়।

আর এভাবেই n-type সেমিকন্ডাক্টর গঠিত হয়। একটি n-type সেমিকন্ডাক্টরে যতগুলি আর্সেনিক পরমাণু ভেজাল হিসেবে মিশ্রিত করা হয় ঠিক ততটি মুক্ত ইলেকট্রন তৈরি হয়।

উপরের বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, p-type সেমিকন্ডাক্টরে পজেটিভ চার্জ বা হোলের পরিমাণ বেশি থাকে। এই অবস্থায় ইলেকট্রন বা নেগেটিভ চার্জ কম থাকে। আবার n-type এ বিপরীত ঘটনা ঘটে। সেমিকন্ডাক্টরে যে চার্জের আধিক্য বেশি থাকে তাকে মেজরিটি চার্জ ক্যারিয়ার বলে। আর যার পরিমাণ কম থাকে তাকে মাইনরিটি চার্জ ক্যারিয়ার বলা হয়। অর্থাৎ, p-type সেমিকন্ডাক্টরে প্রচুর পরিমাণ হোল বা পজেটিভ চার্জ সৃষ্টি হয়।

সামান্য কিছু মুক্ত ইলেকট্রন বা নেগেটিভ চার্জ থাকে তাই p-type সেমিকন্ডাক্টরে মেজরিটি চার্জ ক্যারিয়ার হলো হোল এবং n-type সেমিকন্ডাক্টরে প্রচুর পরিমাণ ফ্রি ইলেকট্রন সৃষ্টি হয়। সামান্য কিছু হোল থাকে তাই n-type সেমিকন্ডাক্টরে মেজরিটি চার্জ ক্যারিয়ার হলো ইলেকট্রন।

অপর দিকে p-type সেমিকন্ডাক্টরে প্রচুর পরিমাণ হোল সৃষ্টি হয় এবং সামান্য কিছু ফ্রি ইলেকট্রন থাকে তাই p-type সেমিকন্ডাক্টরে মাইনরিটি চার্জ ক্যারিয়ার হলো ইলেকট্রন। n-type সেমিকন্ডাক্টরে প্রচুর পরিমাণ ফ্রি ইলেকট্রন সৃষ্টি হয়। সামান্য কিছু হোল থাকে তাই n-type সেমিকন্ডাক্টরে মাইনরিটি চার্জ ক্যারিয়ার হোল।

ইলেকট্রনিক্স এর মূল উপাদান এই সেমিকন্ডাক্টর। তাই সেমিকন্ডাক্টর সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরি। আজ এ পর্যন্তই, বন্ধুরা একাট ধাঁধাঁ দিয়ে শেষ করি, বলতো কোন সংখ্যা সমান দুই ভাগ করলে শূন্য হয়..।

ভাল থেকো আবার দেখা হবে।

 

জুলাই-আগস্ট ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ২