।তানজিদ তুষার।
উনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের প্যারিসে শুধুমাত্র নিজের বুদ্ধির প্রয়োগে অপরাধ জগতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন যিনি, তারই নাম আলফোঁজ বারটিলন (Alphonse Bertillon)। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বাস্তব জীবনের ডক্টর জোসেফ বেলকে দেখে। তার সময় তো বটেই, পরবর্তীকালে আলফোঁজ বারটিলন প্রদর্শিত পথে সারা বিশ্বের গোয়েন্দারা এমনকি পুলিশ পর্যন্ত অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
চিত্র-১: আলফোঁজ বারটিলন
আলফোঁজ বারটিলন অপরাধবিজ্ঞান জগতের চিরদিনের, চিরকালের চিরস্মরণীয় নাম। অপরাধবিজ্ঞানে হিসেবের তথ্যের অনুসন্ধানের যে বৈজ্ঞানিক রীতি বারটিলন প্রবর্তন করেছিলেন সারা পৃথিবী আজও সেই রীতি অনুসরণ করে চলেছে। এমনকি ফরাসিদের দাবি, আঙুলের ছাপ দেখে হত্যা রহস্য সমাধান করার প্রথম কৃতিত্ব আলফোঁজ বারটিলনের।
প্যারিসের একজন ডাক্তারের দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে বারটিলনের জন্ম হয়েছিল ১৮৫৩ সালে। পড়াশুনায় মোটেই ভালো ছিলেন না বলে বাড়ির লোকেরা তাকে খরচার খাতাতেই লিখে রেখেছিল। বড় হয়ে কাজের ক্ষেত্রেও খুব একটি সুবিধা করতে পারছিলেন না মঁসিয়ে বারটিলন।
এসময় বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার আহবান এল। সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সময় বারটিলন চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হলেন এবং মেডিকেল স্কুলের সান্ধ্যকালীন ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেলেন। মানুষের করোটি এবং কঙ্কালের বৈচিত্র দারূণভাবে তাকে আকর্ষণ করলো।
আলাদা আলাদা মানুষের ২২২টি হাড় মাপজোখ করে বারটিলন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, একজন মানুষের হাড়ের গঠনের সাথে আরেকজনের মানুষের হাড়ের গঠনের যথেষ্ট অমিল রয়েছে! সামরিক চাকরির মেয়াদ শেষ হলে ১৮৭৯ সালে প্যারিসের পুলিশ দপ্তরে কেরানির কাজ পেলেন।
সারাদিন যেসব অপরাধীদের ধরে আনা হত তাদের দৈহিক বিবরণ কপি করে রাখাই ছিল বারটিলনের কাজ। একই অপরাধী পুনরায় গ্রেফতার হলে এই বিবরণ পুলিশের কাজে আসত। কিন্তু সেই সময় বিবরণগুলো এতটাই মোটা দাগের, এতটাই সাধারণ ছিল যে অপরাধীরা নিজের চেহারায় সামান্য পরিবর্তন ঘটালে সেসব সাধারণ বিবরণ দিয়ে তাদের সনাক্ত করা সম্ভব ছিল না।
মেডিকেল স্কুলে এনাটমির ক্লাস করছিলেন বলে বারটিলন জানতেন যে ২০ বছর থেকে ৬০ বছরের মধ্যে মানুষের কোন কোন প্রত্যঙ্গের আর কোনই পরিবর্তন হয় না। অনেক গবেষণা করে তিনি এই সিদ্ধান্তে এলেন যে একমাত্র কানেরই কুড়িটা বিভিন্ন অংশের সাহায্যে হাজার হাজার অপরাধীকে একেবারে নির্ভুলভাবে সনাক্ত করা সম্ভব।
কারণ ঐ অংশগুলোর কিছু কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে কোনভাবেই বদলানো যায় না। পুলিশের প্রধান দপ্তরে যোগ দেওয়া সেসময় ২৬ বছরের যুবক, আলফোঁজ বারটিলন। তিনি একটি চার্টও তৈরি করে ফেললেন (যা পরবর্তীতে বেশ বিখ্যাত হয়) এবং নাম দিলেন অ্যানথ্রোপোমেট্রি (Anthropometry)।
মানুষের শরীরের যে ১১টি অঙ্গের আর কোন পরিবর্তন হয় না। তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয়া ছিল এই চার্টে। অপরাধীদের সনাক্ত করার ক্ষেত্রে এই চার্ট যে বিশেষ সুবিধা দান করবে সে বিষয়ে বারটিলনের কোনই সন্দেহ ছিল না।
বিপুল উৎসাহ সহকারে চার্টখানা নিয়ে প্যারিসের পুলিশপ্রধান মঁসিয়ে আন্দ্রিক্স এর সাথে দেখা করলেন বারটিলন। কিন্তু ফল হল সম্পূর্ণ বিপরীত। কাগজপত্র সব বান্ডেল করে বারটিলনের মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে ব্যঙ্গের সুরে তিনি বলে উঠলেন, এখন থেকে বুঝি একজন ক্লার্কের কাছে পুলিশের কাজ শিখতে হবে আমাদের (!)
খুব মনঃক্ষুন্ন হয়ে নিজের টেবিলে ফিরে গেলেন বারটিলন। তিন বছর পরে মঁসিইয়ে আন্দ্রিক্স এর জায়গায় নতুন পুলিশ প্রধান এলে। তিনি কিন্তু বারটিলনকে সামান্য ক্লার্ক বলে অবজ্ঞা করলেন না। মন দিয়ে তার সব কথা শুনলেন। তিনি বললেন, আমি আপনাকে একটি সুযোগ দিতে রাজি আছি বৈকি।
তবে একটি শর্ত আছে, যদি তিন মাসের মধ্যে আপনার এই অভিনব পদ্ধতির সাহায্যে কোন অপরাধীকে সনাক্ত করা যায় তবে আমি সকল পুলিশ বিভাগে আপনার এই চার্ট চালু করে দিব। কিন্তু যদি তা না পারেন, আমি কিন্তু তাহলে কিছুই করতে পারবনা মঁসিয়ে বারটিলন।
এত বড় একটি এক্সপেরিমেন্টের পক্ষে মাত্র তিন মাস সময় সত্যিই যথেষ্ট না। তবুও পুলিশ প্রধানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন বারটিলন। সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পরলেন বারটিলন। থানায় ধরে আনা অপরাধীদের এক রিভলবিং চেয়ারে বসিয়ে নানান অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলালেন।
পাশ থেকে তোলা মুখের ফটোর উপরই তিনি জোর দিলেন বেশি কারণ তা থেকে ভ্রু, নাক আর থুতনির অংশ ভালোভাবে বোঝা যেত। এছাড়া মুখের বিশেষ অংশের অনেকগুলো ক্লোজার ফটো নিতেন। ফটো তোলার পর অপরাধীদের দৈহিক মাপজোখের হিসাবগুলো টুকে রাখতেন চার্টে।
বিশেষ করে মাথা, ডান কান, বাম হাতের মধ্যমা, কনুই থেকে গোটা বাম হাত আর বাম পায়ের মাপগুলো খুব সাবধানে টুকে রাখতেন। প্রত্যেকের ফটোর সঙ্গে রাখা একটি করে ইনডেক্স কার্ডে এই মাপগুলো লেখা থাকত। তারপরে নামের আদ্যক্ষর অনুসারে সেগুলোকে ফাইল করে রাখা হত।
বারটিলনের নিজের হাতে তৈরি সেসব ফাইল আজও প্যারিসের পুলিশ দপ্তরে আইডেনটিটি হিসেবে রাখা আছে। এদিকে দুমাস কেটে গেল। কিন্তু বারটিলনের সূত্র অনুসারে একজনও ধরা পরল না। ভারী ভাবনায় পরলেন বারটিলন। এত চেষ্টা, এত যত্ন, এত পরিশ্রম, এত অধ্যাবসায়- সবই কি ব্যর্থ হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত?
শীতে জড়ো জড়ো ফেব্রুয়ারির বিকেল। একটি লোক ধরা পড়ে। সে তার নাম বলল, দ্যুঁপু। ফ্রান্সে দ্যুঁপু নামটা একেবারেই যদু মধুর মত সাধারণ নাম। চুরি করবার অভিযোগে ধরা হয়েছিল দ্যুঁপুকে। বারটিলন তার ইনডেক্স কার্ডে ঘাটাঘাটি শুরু করলেন। শেষটায় মার্টিন নামে একটি লোকের ইনডেক্স কার্ডও খুজে বের করলেন।
এই মার্টিনকেও চুরির অপরাধে দুমাস আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মার্টিনের শরীরের মাপের সাথে দ্যুঁপুর শরীরের মাপ হুবুহু মিলে গেল। বারটিলন দ্যুঁপুকে, মারটিনের ছবিটা দেখিয়ে জোর দিয়ে বললেন যে এটা দ্যুঁপুই। নাম পাল্টালে আর নাকের আকারটা বদলালে কী হয়েছে, শরীরের আকার তো আর সে বদলাতে পারে নি।
এই যে, সব মাপই তো হুবুহু মিলে গিয়েছে! এবার কিভাবে নাকচ করবে দ্যুঁপু। কঠিন সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে স্বীকার করতেই হল যে, হ্যাঁ, তার আসল নাম মার্টিন। আর দুমাস আগে সে একই অপরাধে ধরা পরেছিল। বিজ্ঞানসম্মতভাবে অপরাধীকে ধরার এই নতুন অথচ নিঁখুত কায়দা সবখানে ছড়িয়ে পরল।
বারটিলনকে প্রমোশন দিয়ে তার প্রতিভার স্বীকৃতি দিলেন পুলিশপ্রধান। বারটিলনের আর দম ফেলার সময় রইল না। প্রথম বছরেই ৭৩৩৬ জন অপরাধীরর ইনডেক্স কার্ড তৈরি হয়ে গেল। ৪৯ জন সন্দেহভাজনকে ইনডেক্স অনুসারে দ্বিতীয়বার অপরাধ করেছে বলে সনাক্ত করা হল। এর পরের বছর সেই সংখ্যাটা বেড়ে হল ২৪১।
ফ্রান্সের পুলিশ বিভাগ তখন সরকারিভাবে বারটিলনের সূত্র গ্রহণ করল, আর বারটিলন হলেন সনাক্তকারী বিভাগের প্রধান। মার নদী থেকে এক অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার করল পুলিশ। ফুলে পঁচে তার তখন এমন অবস্থা যে কেউ তাকে সনাক্ত করতে পারল না।
তখন বারটিলনের সাহায্য চাওয়া হল। বারটিলন মৃতদেহের করোটির মাপ নিয়ে ইনডেক্স কার্ডের সাহায্যে তার পরিচয় জানিয়ে দিলেন অনেকটা ম্যাজিকের মত, অতি সহজেই। তখন খুনিকে ধরে ফেলাও কঠিন হল না।
আরেকবার রোলিং নামে এক রাজমিস্ত্রি নিখোঁজ হলে তার স্ত্রী স্বজনরা মর্গে এসে একটি লাশকে রোলিং এর লাশ হিসেবে সনাক্ত করল। তার শেষকৃত্যের ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। খবর পেয়ে বারটিলন এলেন। মৃত দেহের বিভিন্ন অংশের মাপজোখ নিয়ে ইনডেক্স এর সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখলেন।
যার কার্ডের সাথে মিলে গেল দেখা গেল সে একজন কুখ্যাত খুনী। ওদিকে বেশ কদিন পরে রোলিংকেও পাওয়া গেল জীবিত অবস্থাতে। প্রমাণিত হল বারটিলনের কথাই ঠিক। দেখতে দেখতে অপরাধীদেও সনাক্তকরণে এই ইনডেক্স কার্ড প্রথা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুলিশ বিভাগগুলোও মেনে নিতে লাগল।
রাশিয়ার জার, দ্বিতীয় নিকোলাস তাকে সোনা ও মুক্তা খচিত ঘড়ি উপহার দিলেন। সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া দিলেন একটি মেডেল। সুইডেন আর অস্ট্রিয়াসহ ১৪টি দেশের সরকার সম্মান জানাল বারটিলনকে। বারটিলনের উদ্ভাবনী ক্ষমতা শুধু ইনডেক্স কার্ড তৈরি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে নানা হত্যা রহস্য সমাধান করেছেন আলফোঁজ বারটিলন।
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মোনালিসা চুরি হয়ে যাওয়ার পর সেটি পুনরায় ফিরে পাওয়া যায়। তখন সেটি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসাই কি না সেটিও বারটিলন, ভিঞ্চির অন্যান্য চিত্রকর্মের তুলির স্ট্রোকের সাথে মিলিয়ে বলে দেন, যে এটাই আসল মোনালিসা!
১৯১৪ সালে মাত্র ৬১ বছর বয়সে মারা যান এই ক্রিমিনাল বিশেষজ্ঞ। এভাবে কিছু মানুষ থাকেই যারা সময়ের চেয়ে এগিয়ে। ফরেনসিকের জন্য ছবি তোলার প্রথা তিনিই চালু করেছেন। আর যুগে যুগে অপরাধীদের ঘুমও হারাম করে দিয়েছেন আলফোঁজ বারটিলন।
মার্চ-এপ্রিল ২০১৯। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৬
No Comment