| মাহমুদুল হাসান কাজল |

পেসমেকার

মানবদেহে কোন আর্টিফিশিয়াল উপকরণ প্রতিস্থাপনের বিষয়টিকে মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় প্রোস্থেসিস (Prosthesis) বলা হয়। হৃৎপিন্ডে যে যন্ত্রটি স্থাপন করা হয় তাকে পেসমেকার বলে। কিন্তু আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি এই পেসমেকার সম্পর্কে?

পেসমেকার হচ্ছে এমন এক ধরনের ডিভাইস যেটি অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে প্রশ্ন চলে আসে অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন কি? মানুষের স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন মিনিটে ৬০-৯০ টি। যদি স্বাভাবিকের চেয়ে স্পন্দন কম হয়, তাহলে হৃদপিন্ডে স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, অর্থাৎ তখন শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত প্রবাহের জন্য হৃদপিন্ড কাজ করতে সক্ষম থাকে না।

হৃদস্পন্দন যখন কমে যায় তখন এটাকে স্বাভাবিক করার জন্য পেসমেকার ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মজার বিষয় হল পেসমেকার এর যিনি আবিষ্কারক, Wilson Greatbatch (১৯১৯-২০১১), তিনি জানতেনই না যে কি আবিষ্কার হতে চলেছে। দুর্ঘটনাবশত এই আবিষ্কার পরবর্তীতে সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

Wilson Greatbatch মূলত এমন একটি সমাধান খুঁজছিলেন যা ব্লক হার্টকে কার্যক্ষম করে তুলতে পারে। Cornell University তে থাকাকালীন, পশুদের হার্ট বিট এর শব্দ রেকর্ড করার জন্য তিনি একটি Oscillator আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ভুলবশত একটি ট্রাঞ্জিস্টর ঐ যন্ত্রে স্থাপন করেন। তিনি যখন বিষয়টি বুঝতে পারলেন, তখনো উৎসুক ছিলেন এরপর কি ঘটে তা দেখার জন্য। কিন্তু কোন ভাবেই প্রত্যাশা করেছিলেন না যে তার ‘ভুল’ কাজটি বৈপ্লবিক আবিষ্কারের জন্ম দিবে। তিনি যখন সুইচটি অন করলেন তখন চেনা কিছু শব্দের সাথে মিল খুঁজে পান। এটা এমন একটি ধরন মেনে চলছে যা মানুষের হৃদকম্পনের সাথে মিলে যায়।

image 19

পরবর্তীতে এর নাম দেয়া হল পেসমেকার। তিনি এই যন্ত্র পশুদের দেহে স্থাপন করে আরো গভীর পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষু চালান। সর্বশেষ ১৯৬০ সালে এটি মানুষের দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়।

লেন্স

চশমা বা লেন্স-এর ব্যবহার আজ একটা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই লেন্স না থাকলে আমার মত চশমা ব্যবহারকারীদের যে কী অবস্থা হতো কখনো কি কেউ ভেবে দেখেছে ? কিংবা যে ক্যামেরা দিয়ে আমরা হাজারো স্মৃতি সংরক্ষু করি সেটাই বা কিভাবে আবিষ্কৃত হত? লেন্স আবিষ্কার না হলে প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারও অনেক বিলম্বিত হত।

image 20

ইতিহাস মতে প্রথম যে লেন্স আবিষ্কৃত হয় তা শুধুমাত্র মানুষের চোখের জন্যই ব্যবহার করা যেত। ১৩ শতাব্দীর দিকে ইতালিতেই প্রথম মানুষের চোখে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত লেন্সের ব্যবহার শুরু হয়। তবে এখানেও ধারণা করা হয় যে ইতালিতে ব্যবহার করা এই উন্নত সংস্করণের চশমার পূর্বে চীনারাই প্রথম চশমার ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু মানের দিক থেকে ইতালিয়ানদের সংস্করণের তুলনায় চীনাদের সংস্করণটি নিম্নমানের হওয়ায় ইতালিই ইতিহাসে স্থান করে নেয়।

পরবর্তীতে দূরের বস্তুকে কাছে দেখার জন্য লেন্স আবিষ্কৃত হতে আরও ১০০ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। এই আবিষ্কারে অবদান রাখেন ডাচ অপটিশিয়ান অর্থাৎ চশমা প্রস্তুতকারী হ্যানস লিপারশে (Hans Lippershey)। তিনি এটার নাম দেন “লুকার” (Looker) এবং ১৬০৮ সালে ডাচ সরকারকে তার এই লুকারের প্রমাণ দেখানোর কিছুদিনের মাঝেই বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে প্রথম প্রথম এই লুকার শুধুমাত্র ডাচ মিলিটারিতেই ব্যবহৃত হত।

এর এক বছর পরই অর্থাৎ ১৬০৯ সালে আকাশ নিয়ে গবেষণা করার জন্য গ্যালিলিও (Galileo) লুকারের একটি উন্নত সংস্করণ আবিষ্কার করেন। গ্যালিলিও এর নাম দেন টেলিস্কোপ যা দূরের কোন বস্তুকে ২০ গুণ বড় বা কাছে দেখাতে সক্ষম হত। ১৭ শতকের দিকে হল্যান্ড লেন্স নিয়ে গবেষণায় অনেক এগিয়ে যায়। তবে ধারণা করা হয় এরও আগে ১৬ শতকের শেষের দিকে মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃত হয়।

১৬ শতকেই ডাচ প্রাণিবিজ্ঞানী অ্যান্টনি ফন লিউয়েনহোক (Antoni van Leeuwenhoek)) তাঁর নিজের তৈরি মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া এবং প্রোটোজোয়ার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে এই মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমেই বিভিন্ন রোগের ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়।

তারহীন যোগাযোগব্যবস্থা

বর্তমানে বিজ্ঞান অনেকাংশই ওয়ারলেস কমিউনিকেশন বা তারহীন যোগাযোগব্যবস্থার ওপর নিভর্রশীল। ইন্টারনেট, মোবাইল, জিপিএস, ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, ওয়াইম্যাক্স এসবই তারহীন যোগাযোগব্যবস্থার একেকটি রূপ যা ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি কল্পনাও করা যায় না। আর এসবের শুরুটা হয়েছিল রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে। রেডিও ওয়েভ হল আলোক রশ্মি, তড়িৎ চৌম্বক রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি, ইনফারেড রশ্মি এবং এক্সরে রশ্মিরই আরেকটি রূপ।

image 23

১৮৮৮ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হেনরিক হার্টজ (Heinrich Hertz) প্রথম রেডিও ওয়েভ আবিষ্কার করেন এবং প্রমাণ করেন যে এই ওয়েভ আলোর গতিতে চলে। পরবর্তীতে ইতালিয়ান ইঞ্জিনিয়ার মার্কোনি (Guglielmo Marconi) হার্টজের গবেষণাকে তারহীন যোগাযোগব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেন। ১৮৯৪ সালে হার্টজের গবেষণা সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা লাভ করে মার্কোনি এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা ও সম্ভাবনা উপলব্ধি করেন। ১৮৯৫ সালের শেষদিকে মার্কোনি একটি ট্রান্সমিটার ও রিসিভার আবিষ্কার করেন যা ২.৫ কিলোমিটার বা ১.৫ মাইল পর্যন্ত রেডিও সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম হয়। এরপর ১৯০১ সালে তিনি এর একটি উন্নত সংস্করণ তৈরি করেন যা গোটা আটলান্টিক মহাসাগরেই সিগন্যাল পাঠাতে পারতো।

১৯ শতকেই রেডিও সিগন্যাল এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ১৯১২ সালে টাইটানিক বৃহৎ বরফ খন্ডে দুর্ঘটনায় পড়লে এই রেডিওসিগন্যালের মাধ্যমেই সাহায্যের আবেদন করে। যদিও ২২২০ যাত্রীর মাঝে শুধুমাত্র ৭০০ জনকেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ধারণা করা হয় রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার না করলে এই সংখ্যা আরও অনেক কম হত। এরপর রেডিও ওয়েভের ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পায়। কানাডায় জন্ম নেয়া আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী ফেসেনডার (Reginald Fessender) রেডিও ওয়েভের এক অভিনব ব্যবহার আবিষ্কার করেন যার ফলে শব্দের পাশাপাশি ছবিও পাঠানো যেত। এই রেডিও সিগন্যালের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই ১৯২৮ সালে টেলিভিশন রিসিভার আবিষ্কার করা হয়। এর পরের ইতিহাস কেবলই রূপকথা। আমরা যে ইন্টারনেটে এখন লিখছি-পড়ছি তা এই রেডিও ওয়েভেরই উন্নত সংস্করণ।