| মু. মারুফ রূসাফী |
প্রথমে এক লাইন গুরুগম্ভীর কথা বলে নেই।
“সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ এর লম্ব ও ভূমির বর্গের সমষ্টির সমান”।
খুবই পরিচিত লাগছে, তাই না? হ্যাঁ, এটাই পিথাগোরাসের উপপাদ্য। তবে এটা কিন্তু পিথাগোরাসের উদ্ভাবন নয়। তিনি প্রথম এর একটি গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দিয়েছিলেন মাত্র। এই বিখ্যাত উপপাদ্যটি গ্রিকরা ছাড়াও ব্যাবিলনীয়রাও জানতো। এছাড়াও মেসোপটোমীয়, ভারতীয় ও চীনা গণিতবিদগণও এই সূত্র এবং এর প্রমাণ করার উপায় জানতেন। আর এদের এই জানার বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ থেকেই এই সূত্রটির গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় এবং বোঝা যায় কিভাবে এটি প্রাচীনকাল থেকেই সব অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ইতিহাসটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি হচ্ছে “পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী” এর জ্ঞান এবং অন্যটি হচ্ছে “সমকোণী ত্রিভুজের সমকোণ এবং সমকোণ সংলগ্ন বাহুদ্বয়ের মধ্যে সম্পর্ক” স্থাপন। প্রাচীন প্রস্তর খন্ড থেকে জানা যায়, পিথাগোরাসের জন্মের প্রায় ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বে ব্যাবিলনবাসীরা বর্তমানে আমরা যাকে “পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী” বলে জানি সে সম্পর্কে জানত। তো “পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী” -টা আবার কী জিনিস?
যদি এমন তিনটি পূর্ণসংখ্যা পাওয়া যায় যারা একটি সমকোণী ত্রিভুজের ভূমি, লম্ব ও অতিভূজ গঠন করবে তবে এই তিনটি সংখ্যাকে একত্রে বলা হয় পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী। পিথাগোরাসের সূত্র থেকে আমরা জানি, কোন সমকোণী ত্রিভুজের ভূমি যদি ৩ মিটার এবং লম্ব ৪ মিটার হয় তবে ঐ সমকোণী ত্রিভুজের অতিভূজ হবে ৫ মিটার। তাহলে আমরা যে তিনটি সংখ্যা পাচ্ছি-অর্থাৎ ৩, ৪ ও ৫- এটাই প্রথম “পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী”। বলাই বাহুল্য, এরকম ত্রয়ী আরো অনেক আছে।
চলো খুঁজে বের করি পিথাগোরিয়ান ত্রয়ীদের
আগেই বলেছি ১ম পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী হচ্ছে ৩, ৪ এবং ৫। এখন পর্যায়ক্রমে স্বাভাবিক সংখ্যা দ্বারা এই ১ম পিথাগোরিয়ান ত্রয়ীকে গুণ করলে আমরা পরবর্তী ত্রয়ীগুলো সহজেই বের করতে পারবো। “পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী” বের করার এটা একটি সহজ পদ্ধতি। পরের অংশ পড়ার আগে এই পদ্ধতিতে কয়েকটি ত্রয়ী বের করে ব্রেইন চর্চা করে নাও।
কিন্তু আমি যদি ত্রিভুজের ভূমি ও লম্বের মানগুলো যে কোন স্বাভাবিক সংখ্যা নিই তবে কি আমরা অতিভুজের মান স্বাভাবিক সংখ্যা পাবো? হয়ত পাবো না। চলো তাহলে এই প্রশ্নেরই সমাধান বের করি।
পিথাগোরাসের সূত্র থেকে আমরা জানি যে, কোন সমকোণী ত্রিভুজের যদি ভূমি a, লম্ব b এবং অতিভুজ c হয় তবে সূত্র মতে,
a2 + b2 = c2 ———-(১)
a এর মান যদি ৪ হয় এবং b এর মান যদি ৭ হয় তবে c এর মান হবে ৮.০৬২২৫৭৭৪৮ । এখানে c এর মান কিন্তু পূর্ণসংখ্যা হয়নি। সেই জন্যই এই সংখ্যা তিনটি “পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী” নয়। আমরা জানি, সমকোণী ত্রিভুজের লম্ব অথবা ভূমি আলাদাভাবে অতিভুজের চেয়ে ছোট হয়। তাই ১ নং সমীকরণের উভয় পাশে b2 বিয়োগ করতে পারি কারণ যেহেতু c > b তাই c2 থেকে যদি আমরা b2 বিয়োগ করলেও ডানপক্ষের মান ধনাত্মকই থাকে।
a2 + b2 = c2
বা, a2 + b2 – b2 = c2 – b2
বা, a2 = c2 – b2
বা, a2 = (c+b)(c-b)———-(২)
এখন ধরি,
বা, (c+b) = 2m2 ———–(৩)
(c-b) = 2n2 ————(৪)
এখানে c+b এবং c-b এর মানের সাথে কেন একটি করে ২ গুণ করেছি তা একটু পরেই বুঝতে পারবে।
এখন c+b এবং c-b এর মানগুলি ১নং সমীকরণে বসাই-
a2 = (c+b) (c-b)
বা, a2 = 2m2 2n2
বা, a2 = 4m2 n2
বা, a2 = (2mn)2
বা, a = ± 2mn
দৈর্ঘ্যরে মান যেহেতু ঋণাত্মক হতে পারে না, তাই ঋণাত্মক মান অগ্রাহ্য করে আমরা পাই-
a = + 2mn ————(৫)
এখন ৩ ও ৪ নং প্রথমে একবার যোগ করি এবং পরে বিয়োগ করে পাই-
প্রথম ক্ষেত্রে,
(c+b)+ (c-b) = 2m2 + 2n2
বা, 2c = 2(m2+n2)
[এখন নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো কেন বাড়তি একটি ২ নিয়েছিলাম]
তাহলে, c = m2+n2———-(৬)
আবার, (c+b)- (c-b) = 2m2 – 2n2
বা, 2b = 2(m2 -n2)
বা, b = m2 -n2 ———-(৭)
এখন আমরা আমাদের ইচ্ছেঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দিয়ে অনেক অনেক পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী বের করে ফেলতে পারবো। অর্থাৎ a, b এবং c এর অনেকগুলো মান বের করতে পারবো।
ধরো, আমরা m এবং n এর যে কোন দুইটি মান নিলাম। মানগুলো যদি আমরা উপরের সমীকরণগুলোতে বসাই তাহলে আমরা a, b এবং c এর জন্য যে মানগুলো পাবো, সেই মানগুলোই “পিথাগোরিয়ান ত্রয়ী” হবে। তাহলে চলো আমাদের টেকনিকের পরীক্ষা হয়ে যাক।
ধরলাম m = 2 এবং n = 1 , তাহলে ৫ নং থেকে a এর মান পাই 4, 6 নং থেকে পাই c এর মান 5 এবং ৭ নং থেকে পাই b এর মান 3 । তাহলে তো আমরা আমাদের ১ম ত্রয়ীটিই পেয়ে গেলাম। এভাবে তুমি অসংখ্য ত্রয়ী বের করতে পারো।
সংখ্যারেখায় পিথাগোরাসঃ
মনে করো আমরা -3, -2, -1, 0, 1, 2, 3 সংখ্যাগুলোকে সংখ্যারেখায় স্থাপন করতে চাই। কাজটি ভারী সোজা। এখানের সবগুলো সংখ্যাই কিন্তু মূলদ সংখ্যা। কিন্তু আমরা যদি অমূলদ সংখ্যাকে সংখ্যারেখায় বসাতে যাই তাহলেই তৈরি হয় জটিলতা। তোমাদের জানাই আছে, যে সংখ্যাগুলোকে দুইটি পূর্ণসংখ্যার অনুপাত আকারে লেখা যায়, তারাই হলো মূলদ সংখ্যা। এ কারণে সব পূর্ণ সংখ্যাই মূলদ সংখ্যা। কারণ এক্ষেত্রে অনুপাতে হরের মান হয় 1 ।
অন্যদিকে দশমিকযুক্ত সংখ্যার ক্ষেত্রে, যাদের দশমিকের পর সসীমসংখ্যক ঘর আছে, তারা মূলদ সংখ্যা। যেমন ৩.১৪। আর যদি দশমিকের পর অসীম ঘর থাকে কিন্তু অংকগুলোর মধ্যে একটি প্যাটার্ন থাকে তাহলে সংখ্যাটি মূলদ। যেমন ২.৩৪৩৪৩৪…। কিন্তু যদি দশমিকের পরে অসীম ঘর থাকে এবং তাদের মধ্যে কোন প্যাটার্নও না থাকে, তাহলে সেটিই অমূলদ সংখ্যা। যেমন আমাদের সবচেয়ে পরিচিত ধ্রুবক ‘পাই’ যার মান ৩.১৪১৫৬…।
এখন আমরা যদি চাই যে, অমূলদ সংখ্যাগুলো সংখ্যারেখায় দেখাবো তবেই আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় মহান গণিতবিদ পিথাগোরাসের কাছে।
ধরি, চিত্রের সংখ্যারেখায় OAB একটি সমকোণী ত্রিভুজ। যার A সমকোণের বাহুদ্বয়ের উভয়ের মান 1 । তাহলে পিথাগোরাসের সূত্র থেকে আমরা এই সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজ বের করতে পারি। অতিভুজের মান √2 হবে। তাহলে কম্পাসের সাহায্যে এর সমান ব্যাসার্ধ নিয়ে O -কে কেন্দ্র করে একটি বৃত্তচাপ অংকন করলে, সেই বৃত্তচাপটি সংখ্যারেখাকে যে বিন্দুতে ছেদ করে, সংখ্যারেখায় সেই বিন্দুটিই √2 । কিন্তু √3 কে তুমি কিভাবে সংখ্যারেখায় দেখাবে?
এটাও কোন কঠিন বিষয় না। সমকোণী ত্রিভুজে √2 কে ভুমি এবং 1 কে লম্ব ধরে নিয়ে হিসেব করলে অতিভুজের মান হবে √3 । তখন √3 কে ব্যাসার্ধ নিয়ে অংকিত বৃত্তচাপ সংখ্যারেখাকে যে বিন্দুতে ছেদ করে সেই বিন্দুটিই √3 । অমূলদ সংখ্যাগুলোকে এভাবে সংখ্যারেখায় দেখানো যায়। তাহলে এখন তো শিখে ফেললে কিভাবে অমূলদ সংখ্যাগুলোকে সংখ্যারেখায় দেখাতে হয়। তবে এখন অমূলদ সংখ্যা √5, √7, √11 কে সংখ্যারেখায় দেখাও দেখি। খাতায় করে ছবিটি এক্ষুনি আমাদের ফেসবুক পেজে ইনবক্স করে দাও। আর সবাইকে দেখিয়ে দাও যে, তুমিও গণিতে কোন অংশে কম নও। আজ পিথাগোরাস এই পর্যন্তই, এর পরের সংখ্যায় আবার পিথাগোরাসের আরেকাটি মজার বিষয় নিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারি।
No Comment