।নাজমুস সাদাত।

আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। একদিন সন্ধ্যায় ইলেকট্রোপ্লেটিং করতে বসে গেলাম। সেদিন স্কুলে রসায়নের শিক্ষক আমাদের ইলেকট্রোপ্লেটিং সম্পর্কে পড়িয়েছিলেন। আমার একটি বদ অভ্যাস ছিল। স্কুলে যা পড়তাম তা বাড়িতে এসে বুঝি বা না বুঝি তবুও হাতে কলমে মিলিয়ে করার চেষ্টা করতাম।

বিশেষ করে প্র্যাকটিক্যাল বিষয়গুলো। কয়েকবার ছোটখাটো বিপদেও পড়তে হয়েছে এজন্য। যাহোক, সেদিন একটি কাচের গ্লাসে (বিকারের অভাবে) পানি নিয়ে একটি লোহার চামচ নিলাম এবং আরেক পাশে নিলাম একটি লেডের (সিসা) দণ্ড। উদ্দেশ্য ছিল লোহার চামচের ওপর সিসার প্রলেপ পড়ে কিনা দেখা।

তোমরা নিশ্চয় জানো তড়িৎ বিশ্লেষণ (ইলেকট্রোলাইসিস) প্রক্রিয়ায় একটি ধাতুর ওপর অন্য একটি ধাতুর আবরণ দেয়াকে ইলেকট্রোপ্লেটিং বলে। এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত একটি সক্রিয় ধাতুর ওপর অন্য একটি কম সক্রিয় ধাতুর আবরণ দেয়া হয়। এতে ধাতব পদার্থের স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।

লোহার ওপর গোল্ড, সিলভার, নিকেল, ক্রোমিয়াম বা জিংকের প্রলেপ দিতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু বাড়িতে তা পাওয়া সহজলভ্য ছিল না। তখন কপার বা দস্তাও ছিল না। এজন্য বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম বাড়িতে থাকা নষ্ট ব্যাটারির (রিচার্জেবল লেড সেল) সিসা।

ব্যাটারির মধ্যে থাকা সিসা গলিয়ে এবং মাটির তৈরি ছাঁচে ঢেলে তা একটি দণ্ড আকারে তৈরি করে রাখা ছিল আগেই। সবকিছু ঠিক মতো এগুচ্ছিল, কিন্তু ইলেকট্রোপ্লেটিং করার জন্য শর্ত ছিল যে ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হবে সে ধাতুর লবণের দ্রবণ নিতে হবে। কিন্তু আমার কাছে তা ছিল না। তারপরও কৌতূহলী মন থেমে যায়নি। লবণের পরিবর্তে শুধু পানি দিয়েই কাজ শুরু করি।

চিত্র-১

বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ব্যাটারি (ডিসি কারেন্ট) ব্যবহার করার দরকার ছিল। কিন্তু ঐ বয়সে কি আর তত বুঝতাম! ব্যাটারির পরিবর্তে বাড়ির মেইন (এসি, ২২০ ভোল্ট) লাইন ব্যবহার করি। পজিটিভ (প্রকৃতপক্ষে হবে ফেজ) প্রান্তের সংযোগ দেই সিসার সাথে এবং নেগেটিভ (প্রকৃতপক্ষে হবে নিউট্রাল) প্রান্তের সংযোগ দেই লোহার চামচের সাথে।

প্রথম দিকে লক্ষ করলাম কিছু বুদবুদ উঠছে। অনেক সময় লাগবে ভেবে একটু বইয়ের পাতায় নজর দেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্লাসের পানি টগবগ করে ফুটতে শুরু করলো। আমি তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি করে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেই।

তখনও আমি কিছুটা আতঙ্কিত। করতে চাইলাম ইলেকট্রোপ্লেটিং আর তার পরিবর্তে পানি ফুটতে শুরু করল। লক্ষ করলাম লোহার চামচের ওপর তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। আমি পরীক্ষণটি পুনরায় করে দেখলাম এবং ফলাফল একই হলো। এবারো পানি আগের মতো ফুটতে শুরু করলো।

চিন্তা করলাম ব্যাপারটা তো মন্দ নয়। পানি গরম করার পদ্ধতি বের করে ফেললাম মনে হয়! নিজেকে ক্ষুদে বিজ্ঞানী মনে হতে লাগল। কিছুক্ষণ পর রুমে চাচাতো ভাই আসল। তাকে গর্বের সহিত নিজের আবিষ্কার দেখালাম। চাচাতো ভাই বাহবা দিল কিন্তু জানালো আমার এ আবিষ্কার নতুন কিছু নয়।

সে জানালো আমাদের বাজারের সেলুনের দোকানদাররা শীতকালে পানি গরম করে এভাবে। তারা পানির মধ্যে কারেন্টের সংযোগ দেয় এবং একটি তারের মাথায় ব্লেড লাগিয়ে রাখে। এভাবে আস্তে আস্তে পানি গরম হয়। তবে এ পদ্ধতিতে একটু তাড়াতাড়ি পানি গরম হচ্ছে। আমার আবিষ্কারের গর্ব তিরিশ মিনিটেই শেষ হয়ে গেল, স্কুলের বন্ধুদের সাথে গর্ব করে বলার আগেই…। ইস! তারা কেন এটা আগেই তৈরি করে ফেলল।

তবে হাল ছাড়িনি সহজে। দুজন মিলে চেষ্টা শুরু করলাম কিভাবে আরো দ্রুত পানি গরম করা যায়। দোকান থেকে দুটি ব্লেড কিনে আনলাম। এবার বৈদ্যুতিক তারের ফেজ এবং নিউট্রাল প্রান্তে ব্লেড দুটি লাগিয়ে সাবধানের সাথে (যাতে নেগেটিভ পজেটিভ একসাথে লেগে শর্ট সার্কিট না হয়) পানির ভিতর প্রবেশ করিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিলাম।

ফলফল অতি দ্রুত গ্লাসের পানি ফুটতে শুরু করল। শর্ট সার্কিটের সম্ভাবনা কমিয়ে আনার জন্য এবং ব্লেড দুটিকে আরো কাছাকাছি আনার জন্য কিছু পাতলা ও সরু কাঠি (বিদ্যুৎ অপরিবাহী যে কোনো জিনিস, যেমন : দেয়শলাইয়ের কাঠি) ব্যবহার করি।

চিত্র-২

এবার এক কাপ পানি গরম করতে আমাদের সময় লাগলো মাত্র ৩০ সেকেণ্ড (সতর্কতা− পানি গরম করার পাত্রটি বিদ্যুৎ পরিবাহী হলে শর্ট সার্কিট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে; এজন্য গ্লাস, সিরামিক বা প্লাস্টিকের পাত্র নেওয়া জরুরি) । পানি গরম করে চা খেয়ে সেদিনের মতো ক্ষ্যান্ত দিলাম।

পরের দিন স্কুলের বন্ধুদের কাছে গর্ব করে বলতে লাগলাম আমি এমন একটি যন্ত্র বানাতে পারি যার মাধ্যামে এক গ্লাস পানি গরম করতে মাত্র ৩০ সেকেণ্ড সময় লাগবে। তখন বাজারে পানি ফুটানো মগ (ইলেকট্রোড ওয়াটার হিটার) পাওয়া যেত না। এজন্য বন্ধুরা এ সিস্টেমের সাথে পরিচিতও ছিল না।

তাই তাদের কৌতূহলও ছিল তুঙ্গে। তারা আবদার ধরল প্রক্রিয়াটি দেখানোর জন্য এবং শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। তাদেরকে দেখিয়েছি বা কী শর্তে শিখিয়েছি সেটা না হয় আজ নাই বললাম। এখন আমরা জানার চেষ্টা করি-পানিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ করলে কেন পানি গরম হয়? এর পিছনে কী বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে?

ব্যাপন বন্ধুরা, তোমরা এখন বাসা বাড়িতে অনেক ধরনের পানি গরম করার যন্ত্র দেখতে পাও। এর মধ্যে এক ধরনের ওয়াটার হিটার আছে যেখানে একটি জগ আকৃতির পাত্রের মধ্যে দুটি চামচ আকৃতির লোহার পাত/দণ্ড থাকে। এ পাত্রে পানি ঢেলে তাতে বিদ্যুৎ (এসি কারেন্ট) সংযোগ দিলেই কিছুক্ষণের মধ্যেই তা অনেক গরম হয়। আমরা আজকে জানার চেষ্টা করবো এ ধরনের ওয়াটার হিটারে পানি কীভাবে গরম হয়।

পানি আল্লাহ তা’য়ালার এক বড় নিয়ামত। এ পানির ওপর নির্ভর করে গোটা বিশ্বের জীবকূল বেঁচে আছে। আমরা জানি এক অণু পানি গঠিত হয় দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু ও একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে। এর রাসায়নিক সংকেত H2O । যাহোক, তোমরা শুনে অবাক হবে বিশুদ্ধ পানি কিন্তু বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে না।

কি অবাক হচ্ছো! আসলে অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। কারণ আমরা টিউবয়েল থেকে যে বিশুদ্ধ পানি পাই বা বাজার থেকে যে বিশুদ্ধ বোতলজাত পানি ক্রয় করি তা বিদ্যুৎ পরিবহন করে। উক্ত পানি ওয়াটার হিটারে প্রবেশ করিয়ে বিদ্যুৎ চালনা করে টেস্টার দিয়ে পানি স্পর্শ করলে দেখতে পাবো সেখানে বিদ্যুৎ আছে।

আসল কথা হলো এ পানি খাবারের জন্য বিশুদ্ধ হলেও তা রাসয়ানিকভাবে বিশুদ্ধ নয়। কারণ উক্ত পানিতে প্রচুর পরিমাণ লবণ, খনিজ পদার্থ বা মিনারেল আছে। এ লবণ ও খনিজ পদার্থ আয়নিত অবস্থায় থাকে− যা বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য দায়ী।

আমরা জানি, বিদ্যুৎ প্রবাহ মানে ‍ঋণাত্মক আধান যুক্ত মুক্ত ইলেক্ট্রনের প্রবাহ। কোনো পরিবাহীর মধ্যে দিয়ে যখন এ ইলেক্ট্রন প্রবাহিত হয় তখন তা উক্ত পরিবাহীর অণুগুলোর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সংঘর্ষের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়। কোনো পরিবাহীর বিদ্যুৎ প্রবাহ বাধা দেওয়ার এ ক্ষমতাকে রেজিস্ট্যান্স (রোধ) বলে।

পরিবাহীর রেজিস্ট্যান্স (রোধ) যতো বেশি হয়, সেখানে ইলেক্ট্রন বেশি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং বিদ্যুৎ প্রবাহে তাপ উৎপন্ন করে। বৈদ্যুতিক হিটার এবং টাংস্টেন বাল্ব এ পদ্ধতিতে কাজ করে।

চিত্র-৩ : ওয়াটার হিটার

আগেই জেনেছি ১০০% বিশুদ্ধ পানি বিদ্যুৎ অপরিবাহী। এজন্য আলোচ্য ওয়াটার হিটারে বিশুদ্ধ পানি উত্তপ্ত করতে পারে না। কিন্তু সাধারণ পানি অনেক আয়ন বহন করায় তা বিদ্যুৎ পরিবাহী। টিউবয়েল, ট্যাপ বা বাজারের বোতলজাত খাবার পানি এ ওয়াটার হিটারে নিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করলে তা গরম হয়। এমনকি পানি ফুটতে থাকে।

কারণ আয়ন দ্বারা পানির মধ্যে ইলেক্ট্রন প্রবাহিত হয় এবং পানির অণুর সাথে সংঘর্ঘে লিপ্ত হয়ে তাপ উৎপন্ন করে। এখানে পানির মধ্যকার আয়নগুলো ইলেক্ট্রন প্রবাহে সহযোগিতা করে এবং পানির অণুগুলো ইলেক্ট্রন প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে।

বিদ্যুৎ প্রবাহের হার, সময় এবং বিভব পার্থক্য যতো বাড়ানো হয় তাপের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পায়। পানির মধ্যে ডুবন্ত পরিবাহক দণ্ড বা পাতের ক্ষেত্রফল যতো বৃদ্ধি পায় পানি তত দ্রুত গরম হয়। আবার পানিতে যদি অল্প পরিমাণ লবণ বা অ্যাসিড যুক্ত করা হয় তখন ইলেক্ট্রন প্রবাহ তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পায়।

ফলে পানিও দ্রুততার সাথে গরম হতে থাকে। তবে লবণ বা অ্যাসিডের পরিমাণ সামান্য পরিমাণ থেকে বেশি হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের মান অত্যধিক পরিমাণ বেড়ে গিয়ে শর্টসার্কিট হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে।

বি.দ্র. :- ওয়াটার হিটার দিয়ে পানি গরম করার জন্য অলটারনেটিভ কারেন্ট (এসি কারেন্ট) প্রবাহ করতে হয়। ডাইরেক্ট কারেন্ট (ডিসি) ব্যবহার করলে পানির তড়িৎ বিশ্লেষণ ঘটে এবং পানি ভেঙে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন গ্যাসে পরিণত হয়। এক্ষেত্রেও তাপ উৎপন্ন হয় তবে তার পরিমাণ অনেক কম।

বাসা-বাড়িতে বিদ্যুতের যে সাপ্লাই লাইন থাকে তা এসি কারেন্ট এবং সকল প্রকার ব্যাটারি হলো ডিসি কারেন্টের উৎস। এসি এবং ডিসি কারেন্টের কী পার্থক্য তা তোমাদের হোম ওয়ার্ক থাকলো।

মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১

পার্কার সোলার প্রোব : সূর্যকে ছোঁয়ার মহাকাব্যিক অভিযান

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চাঁদ

চন্দ্রাভিযান  (পর্ব-১)

পানির অপর নাম তরমুজ!

ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি

অ্যাপেন্ডিক্স কি আসলেই অপ্রয়োজনীয়!

বিটকয়েনের দৌরাত্ন্য

রেডিয়েশন : অসাধারণ ত্যাগের আবিষ্কার

আবরার নাফির ফিজিক্সে রৌপ্য জয়ের গল্প

চুম্বকত্বের আদ্যোপান্ত

চিনে রাখি অসুখগুলি

দুরন্ত বাড়ন্ত e

অবলোহিত আলো দেখতে চাও?

মস্তিষ্ক দখল

মহাবিশ্বের স্ফীতি

মাটির ভুবনে

তোমাদের প্রশ্ন আমাদের উত্তর

কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন

সহজে মিলাও সুডোকু

ফোটোনিক্স ও গবেষণা

মস্তিষ্ক দখল

ইভিএম কীভাবে কাজ করে?

পৃথিবীর বিপদ যত!

ইউরেনিয়াম: অবিশ্বাস্য শক্তির ভ্রুণ