।আদনান মুস্তারী।

শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ভেতরের তারুণ্যকে ধরে রাখার বাসনা কার না হয়? কবি চায় বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের ভিতরেও মেঘলুপ্ত সূর্যের ন্যায় প্রদীপ্ত যৌবন। আর আমাদের ধরিত্রী যেন ঠিক এ উপমারই এক মূর্ত প্রতিরুপ। কেননা বাস্তবিকই পৃথিবীর কেন্দ্রের বয়স কিন্তু তার পৃষ্ঠের সাথে সমান তালে বেড়ে চলেনি। বরং হিসাব-নিকাশ শেষে পৃথিবীর কেন্দ্রের বয়স বের হচ্ছে এর পৃষ্ঠের তুলনায় ঠিক ২.৫ বছর কম।

এখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন চলে আসবে- ভূপৃষ্ঠ আবার ভূকেন্দ্র থেকে বয়সে বড় হয় কীভাবে? বরং কেন্দ্রের বয়সই বেশি হওয়া উচিত। আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমদের যথারীতি দ্বারস্থ হতে হবে বর্তমান সময়ের অন্যতম সফল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ‘আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব’-এর কাছে।

সাধারণ আপেক্ষিকতার গোড়ার কথা

আলবার্ট আইনস্টাইন আমদের যে আপেক্ষিকতার নীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এসে এর প্রয়োগক্ষেত্র পূর্ববর্তী সকল ধারণার চেয়েও আরো অনেক বেশি বিস্তৃত। আমরা যেমনটা জানি, গ্রহ, নক্ষত্র বা ব্ল্যাকহোলের ন্যায় বৃহৎ ভরযুক্ত বস্তুর কাছাকাছি এসে আলোর গতি মন্থর হয়ে যায়।

আবার এই প্রভাব আমদের চারপাশের নগণ্য অভিকর্ষীয় ক্ষেত্রযুক্ত সাধারণ বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা যায়। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বানুযায়ী বস্তু যত বৃহৎ ভর বিশিষ্ট হবে, তা স্থানকালের জালককে তত বেশি বক্রতা তৈরি করবে। মূলত স্থানকালের এ বক্রতাই মহাকর্ষীয় বল হিসাবে অভিভূত হয়।

চিত্র-১ : স্থানকাল জালকের ওপর ভরের প্রভাব (উৎস : space.com)

মহাকর্ষের কবলে সময় :

কোনো বস্তুর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র যথেষ্ট শক্তিশালী হলে তা সেই বস্তুর পরিপার্শ্বস্থ সময়কেও বস্তুর দিকে বাঁকিয়ে দেয়। ফলে সেই বস্তুকে ঘিরে সময় তখন দ্রুত অতিবাহিত হয়। এই প্রভাব খুব সহজেই প্রত্যক্ষ করতে পারি ভূস্থির উপগ্রহগুলোর ক্ষেত্রে।

আমাদের সকল নেভিগেশন এবং জিপিএস ব্যবস্থা এই কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর ওপর নির্ভরশীল। আর এরকম একটি জিপিএস স্যাটেলাইটের ভেতরে যে আণবিক শক্তিচালিত সূক্ষ্মমানের ঘড়িগুলো থাকে সেগুলো প্রতিদিন পৃথিবীর ঘড়ি হতে ৩৮ মিলি-সেকেণ্ড এগিয়ে যায়।

স্যাটেলাইটের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি কম্পিউটার প্রতিদিন সেটিকে পৃথিবীর ঘড়ির সাথে মিলিয়ে ঠিক করে নেয়। তা না হলে মাত্র একদিনের ব্যবধানে কোনো লোকেশনের সত্যিকারের অবস্থানের সাথে জিপিএস থেকে প্রাপ্ত অবস্থানের পার্থক্য হতো দশ কিলোমিটার!

এবার নজর দেয়া যাক পৃথিবীর দিকে। আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্র যে বিশাল ভর ধারণ করে, তা কিন্তু ভূপৃষ্ঠের ওপর যথেষ্ট শক্তিশালী মহাকর্ষীয় প্রভাব তৈরি করে। যা আমাদের কাছে অভিকর্ষ বল হিসাবে পরিচিত। আর এ অভিকর্ষীয় বলের প্রভাবেই সময় ভূকেন্দ্রের তুলনায় ভূপৃষ্ঠে দ্রুত অতবাহিত হয়।

এই ধারণাটি সর্বপ্রথম বিজ্ঞানীমহলে তুলে ধরেন তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, স্থানকালিক বক্রতা তত্ত্বানুযায়ী পৃথিবীর কেন্দ্র ও ভূত্বকের মধ্যে কমপক্ষে এক বা দুইদিনের সময় পার্থক্য থাকা উচিত।

চিত্র-২ : রিচার্ড ফাইনম্যান

অতঃপর বিজ্ঞানী এসে দাঁড়ালেন গবেষণার মঞ্চে!

ফাইনম্যানের রিসার্চ পেপারগুলো এবার বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলল। ভূকেন্দ্র আর ভূপৃষ্ঠের মধ্যে সময়ের পার্থক্য রয়েছে এটাতো স্পষ্ট হলো, এবার পার্থক্যটা ঠিক কতো সেটিও বের করে ফেলা প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজন বোধহয় সবচেয়ে বেশি অনুভব করলেন পদার্থবিদ উলরিক ইঙ্গার্সলেভ উগারহোজ (Ulrik Uggerhøj)।

ডেনমার্কের প্রখ্যাত আরহাস ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক তার তত্ত্বাবধানে একটি দল গঠন করে মনোনিবেশ করলেন ভূকেন্দ্র ও ভূপৃষ্ঠের মহাকর্ষীয় বিভব বা Gravitational potential-এর জটিল সব হিসাব নিকাশ মেলাবার কাজে ।

চিত্র-৩ : উলরিক ইঙ্গার্সলেভ উগারহোজ (সূত্র : Aarhus University)

অপারেশন ‘আসল বয়স’!

পৃথিবী তৈরি হয়েছে মাত্র ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। আর সেই শুরু থেকেই পৃথিবীর কেন্দ্র পৃষ্ঠের ওপর অভিকর্ষ বল প্রয়োগ করে আসছে। হিসাবের সুবিধার্থে প্রথমে গবেষক দলটি পৃথিবীকে একটি সুষম ঘনত্বের গোলক হিসাবে কল্পনা করে নিল।

পৃথিবীর ঘনত্ব যদিও সুষম নয়, কিন্তু হিসাব নিরুপণ সহজ ও মোটামুটি নির্ভুল একটি গড় মান বের করার জন্য তারা এটি ধরে নিয়েছিলেন। তো তারা পর্যবেক্ষণ করলেন ভূপৃষ্ঠের প্রতি ১ সেকেণ্ড সময়ের জন্য কেন্দ্রে প্রায় ০.০০০০০০০০০৩ সেকেণ্ডের সময় ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়।

আপাতদৃষ্টিতে এটিকে খুবই নগণ্য মনে হলেও ৪.৫ বিলিয়ন বছরে কিন্তু এ ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ বছরে। একে তো পৃথিবীর ঘনত্ব অবস্থানভেদে ভিন্ন, উপরন্তু, পৃথিবীর কেন্দ্রের ঘনত্ব এর পৃষ্ঠের তুলনায় অনেক বেশি। তাই আরো নির্ভুল ফলাফল পেতে দলটি এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘনত্ব ডিসট্রিবিউশনকে বিবেচনায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিভিন্ন সময়ে ভূতত্ত্ববিদরা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে বেশ কিছু মডেল তৈরি করেছেন। এর মধ্যে গবেষক দলটি যে মডেলটি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয় সেটি হলো ‘Preliminary Reference Earth Model’− যেখানে পৃথিবীর অভ্যন্তরকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করে দেখানো হয়েছে।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই এবার হিসাবগুলো বেশ জটিল হয়ে গেলো। অথচ এবারের ফলাফলও আগের ফলাফলের বেশ কাছাকাছি আসে। আর সবচেয়ে সূক্ষ্ম হিসাবের পর তারা যে বয়স পার্থক্য পেয়েছিলেন− সেটি ঠিক ২.৫ বছর!

অর্থাৎ এবার আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি, পৃথিবীর কেন্দ্র হয়তো এর পৃষ্ঠের আগেই গঠিত হয়েছে কিন্তু সময়ের ওপর মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবের কারণে কেন্দ্রের বয়স পৃষ্ঠের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে পারেনি।

চিত্র-৪

পরিশেষে :

সময়ের ওপর মহাকর্ষের এই প্রভাবকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায় সূর্যের ন্যায় বৃহৎ ভরের বস্তুর ক্ষেত্রে। গবেষক দলটি হিসাব করে দেখিয়েছে সূর্যের কেন্দ্র তার পৃষ্ঠের তুলনায় প্রায় ৪০,০০০ বছরের ছোট। যদিও সূর্যের কেন্দ্রের উপদানসমূহ যেহেতু প্রতিনিয়তই নতুন উপাদান তৈরির মাধ্যমে পরিবর্তিত হচ্ছে, তাই কোনোরূপ আপেক্ষিক আলাপ বাদেই এর কেন্দ্রকে পৃষ্ঠের তুলনায় কম বয়সী বলা চলা। তবে উপাদানের এই পরিবর্তনকে কিন্তু বয়সের পার্থক্য বের করার হিসাবে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

আপেক্ষকিকতা তত্ত্ব হয়তো সবচেয়ে শক্তিশালী তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি, কিন্তু দিনশেষে এটিও কেবলই একটি তত্ত্ব। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কেন্দ্র পর্যন্ত গর্ত খুঁড়ে সরাসরি সেখানকার কোনো নমুনা নিয়ে এসে পরীক্ষা না করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত আসলে কেন্দ্রের সত্যিকারের বয়স জানা সম্ভবপর নয়।

কিন্তু তবুও গবেষক দলটির এ প্রচেষ্টা আমাদেরকে সময়ের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাবকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করবে। এ উপলব্ধি হয়তো সময় নিয়ে আমাদের ভাবনার জগতের নতুন দুয়ার উন্মোচন করে দেবে। কে জানে, এক সময় হয়তো মানুষ এই সময় প্রবাহেও তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নেবে!

References:

মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১

ইলেকট্রোপ্লেটিং থেকে ওয়াটার হিটার

পার্কার সোলার প্রোব : সূর্যকে ছোঁয়ার মহাকাব্যিক অভিযান

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চাঁদ

চন্দ্রাভিযান  (পর্ব-১)

পানির অপর নাম তরমুজ!

ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি

অ্যাপেন্ডিক্স কি আসলেই অপ্রয়োজনীয়!

বিটকয়েনের দৌরাত্ন্য

রেডিয়েশন : অসাধারণ ত্যাগের আবিষ্কার

আবরার নাফির ফিজিক্সে রৌপ্য জয়ের গল্প

চুম্বকত্বের আদ্যোপান্ত

চিনে রাখি অসুখগুলি

দুরন্ত বাড়ন্ত e

অবলোহিত আলো দেখতে চাও?

মস্তিষ্ক দখল

মহাবিশ্বের স্ফীতি

মাটির ভুবনে

তোমাদের প্রশ্ন আমাদের উত্তর

কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন

সহজে মিলাও সুডোকু

ফোটোনিক্স ও গবেষণা

মস্তিষ্ক দখল

ইভিএম কীভাবে কাজ করে?

পৃথিবীর বিপদ যত!