।হোসাইন মইন।
(পর্ব-১)
বন্ধুরা, পদার্থবিজ্ঞানের এক চমকপ্রদ বিষয় চুম্বকত্বের সাথে পরিচিত তোমরা কমবেশি সবাই। অন্ততপক্ষে চুম্বকের সাথে পরিচিত নয় এমন লোক পাওয়া অমাবস্যার চাঁদের মতই ব্যাপার হবে। চুম্বকত্ব পদার্থবিজ্ঞানের এমন এক শাখা যার রহস্যভেদ করতে গিয়েই পদার্থবিজ্ঞান চিরায়ত এবং আধুনিক- এই দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে।
কিন্তু রহস্য কি শেষ হয়েছে এই রহস্যময় জগতের? চলো বন্ধুরা, ঘুরে আসি চুম্বকত্বের (Magnetism) সুন্দর এ দুনিয়া থেকে। আজ থেকে ৪০০০ হাজার বছর আগে গ্রীসের ম্যাগনেশিয়া নামক স্থানে এক আশ্চর্য পাথরের সন্ধান পেয়ে যায় ম্যাগনেস নামে এক অতি সাধারণ মেষপালক বালক।
পাথরখানা এমনভাবে তার লাঠির মাথার লোহার অংশকে ধরে রাখছে যেন কি এক মধুর বন্ধুত্ব পাথরখানার সাথে। অবাক হয়ে বালক ম্যাগনেস লক্ষ করল পাথরটির আচরণ। কৌতুহলী বালক মাটি খুঁড়ে আরও পাথর খন্ড বের করল। ম্যাগনেশিয়ায় পাওয়া গিয়েছিল অথবা ম্যাগনেস পেয়েছিল বলে পাথরখানার নাম হল ম্যাগনেট বা চুম্বক।
ধীরে ধীরে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে এই পাথর। কৌতুহলী মানুষ খেয়াল করল, দণ্ডাকার চুম্বক মুক্তভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় সবসময় কোন এক অজানা কারণে উত্তর-দক্ষিণ মুখ করে থাকে। মানুষ পেয়ে গেল দিকনির্ণয়ের এক অব্যর্থ হাতিয়ার– কম্পাস বা দিকদর্শন যন্ত্র।
তাই দণ্ড চুম্বকের দুই প্রান্তকে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু নামে নামকরণ করা হল। কেন চুম্বক এমন ধর্ম দেখায় কখনও ভেবে দেখেছ কি বন্ধুরা? আরও মজার ব্যপার হল দুইটি দণ্ড চুম্বকের একটির উত্তর মেরু অপরটির উত্তর মেরুকে বিকর্ষণ করে কিন্তু দক্ষিণ মেরুকে আকর্ষণ করে। দক্ষিণ মেরুদ্বয়ের জন্যও একই ব্যাপার প্রযোজ্য। এমন আচরণই বা কেন করে?
যুগে যুগে চুম্বকের এই ধর্মগুলো মানুষকে ভাবিয়েছে কিন্তু কোন কুলকিনারা করতে পারেনি সপ্তদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত। ব্রিটিশ রাজপরিবারের চিকিৎসক উইলিয়াম গিলবার্ট প্রথম পর্যবেক্ষণ করলেন যে, প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী নিজেই এক বিশাল দণ্ড চুম্বক।
যার উত্তর মেরু ভৌগলিক দক্ষিণমেরুর কাছাকাছি এবং দক্ষিণ মেরু ভৌগলিক উত্তর মেরুর কাছাকাছি। আমরা জানি, চুম্বকের বিপরীত মেরুদ্বয় পরষ্পরকে আকর্ষণ করে। তাই কোন দণ্ড চুম্বককে নিয়ে আমরা যদি পৃথিবীর উত্তরে যাই তাহলে দেখা যাবে এর উত্তরমেরু ভূপৃষ্ঠের দিকে হেলে পড়ে এবং ভূ-চুম্বকের উত্তরমেরু বিন্দুতে খাড়া হয়ে থাকে।
আমরা যদি এবার কোন চুম্বককে পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে নিয়ে যাই তাহলে চুম্বকের দক্ষিণ মেরু আগেরবার উত্তরমেরু যে আচরণ করেছে একই আচরণ করবে। আর শুরু হয়ে গেল চুম্বক নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা। কালের পরিক্রমায় শুরু হয়ে যায় চুম্বকত্বের যুগ।
আর আজকে আমরা বাস করছি তড়িৎ চুম্বকত্বের যুগে। কিভাবে আমরা ম্যাগনাসের সেই কাল থেকে আজকের এ যুগে আসলাম তাই জানবো ধাপে ধাপে।
চিত্র: উইলিয়াম গিলবার্ট ও হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেড
উনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ভাবতো তড়িৎ ও চুম্বকত্ব দুটি ভিন্ন ধারার বিজ্ঞান । কিন্তু মানুষের ভিন্ন ভাবার অভ্যাস মানুষকে বসে থাকতে দেয় না। ১৮২০ সাল, এপ্রিলের একুশ তারিখে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবয়সী পদার্থবিজ্ঞানের এক আধ্যাপক ক্লাসে লেকচার দিতে গিয়ে দেখলেন তার ব্যবহৃত কম্পাসের পাশে রাখা বৈদ্যুতিক বর্তনীতে তড়িৎ প্রবাহিত হলে কম্পাস কাঁটা তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে।
কিন্তু কেন ? এমন তো হওয়ার কথা নয়! তিনি দেখলেন শুধুমাত্র তড়িৎ প্রবাহ থাকলেই এই বিচ্যুতি দেখা যায়। তার মানে তড়িৎ প্রবাহের সাথে চুম্বকের কোন না কোন সম্পর্ক আছে! আসলে এই হলো তড়িৎ চুম্বকত্বের যাত্রা শুরুর প্রথম পদক্ষেপ।
তার এই পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞানীদের মাঝে চুম্বক ও তড়িতের সম্পর্ক খুঁজতে উৎসাহের সঞ্চার করল। এই অধ্যাপক হলেন হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেড। চল বন্ধুরা, আসল ঘটনাটা একটু দেখে আসি।
ছবির বর্তনী যখন খোলা (সুইচ অফ) তখন কম্পাস কাঁটা ঠিক অবস্থানে আছে। ঠিক পাশের ছবিতে বর্তনী বদ্ধ (সুইচ অন) করা আছে। অর্থাৎ, তড়িৎ প্রবাহিত হচ্ছে বলে কম্পাস কাঁটা তার অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে। সহজ কথায় বললে তারের ভেতর দিয়ে যখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত তখন তারের চারপাশে নিচের চিত্রের মত করে চুম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়।
বন্ধুরা, চুম্বকক্ষেত্রের নাম শুনে আবার ভয় পেয়ে যেও না। একটা চুম্বক তার আশেপাশের যে অঞ্চলের মাঝে অন্য চুম্বক বা চুম্বক পদার্থ আসলে তার ওপর প্রভাব ফেলে সে অঞ্চলেরই গালভরা নাম চুম্বকক্ষেত্র।
যাই হোক, তারের চারপাশে উৎপন্ন চুম্বকক্ষেত্রের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল কিন্তু কিভাবে কোন দিকে উৎপন্ন হয় তা বুঝব কি করে? এসব চিন্তাভাবনা যখন চলছে বিজ্ঞানীমহলে তখন সেখানে ডানহাত ঠেলে দিলেন অ্যাম্পিয়ার সাহেব (André-Marie Ampère) ।
বললেন ডানহাতের বৃদ্ধা-আঙ্গুলখানা তড়িৎ প্রবাহের (I) দিকে তাক করে তারটিকে মুঠো করে ধরলেই বাকি আঙ্গুলগুলো আপনা আপনি চুম্বকক্ষেত্রের(B) দিকে মুখ করে থাকবে। চুকে গেল ঝামেলা! নিজেদের ঝামেলা না মিটলে আরেকবার তাকাও ছবিখানার দিকে।
বন্ধুরা, এই অংশটা মনে রেখো ভালভাবে, সামনে বারবার কাজে লাগবে এই ডানহাতের কারসাজি। আচ্ছা, তোমাদের মনে কি এই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে কেন তারের মধ্যে বিদ্যুৎ চুম্বকত্বের আগমন ঘটায়? প্রকৃতপক্ষে, এই বিদ্যুৎ চুম্বকের সম্পর্ক বিজ্ঞানীদেরও ভাবাত।
বিদ্যুৎপ্রবাহ তো আসলে চার্জের প্রবাহ! তবে কি চুম্বকত্বের জন্য চার্জের নড়াচড়া দায়ী? ম্যাক্সওয়েল সাহেবকে সাথে নিয়ে চার্জের দায়ভার আলোচনা হবে সামনের পর্বে। ততদিন ভাল থাকো।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৯। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৫
No Comment